মিনার

মিনার শব্দটি আরবি অথবা ফারসি শব্দ মানার বা মানারা এর ভারতীয় রূপ। শাব্দিক অর্থে এর দ্বারা এমন স্থানকে বুঝায় যেখানে আগুন জ্বালানো হয়। এ ব্যবস্থার প্রথম প্রয়োগ দেখা যায় আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘরে (pharos), যেখানে নাবিকদের সতর্ক করার জন্য রাতে আগুন জ্বালানো হতো। আরবি কবিতায়ও নির্দেশক দন্ড (signpost) অথবা খ্রিস্টান ধর্ম যাজকের কক্ষে ব্যবহূত কুপি হিসেবে এর ব্যবহার দেখা যায়। ক্রমান্বয়ে শব্দটির অর্থ নির্মাণ শৈলীতে সম্প্রসারিত হয় এবং এর দ্বারা বাতিঘরকে বোঝানো হয়। মুসলিম আমলে এর দ্বারা শুধু মসজিদ টাওয়ারকেই (মাজান- আজান থেকে) বোঝানো হতো না, বরং যে কোন ধরনের উঁচু কাঠামোকেই বোঝাত। এ কাঠামোটি ভবন থেকে বিচ্ছিন্ন কিংবা ভবনের অংশ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য অথবা শোভাবর্ধনের জন্যও হতে পারত। পরবর্তী সময়ে এ শব্দটি ইংরেজি ভাষায় টাওয়ার অথবা টারেট-এর সমার্থকে পরিণত হয়।

ছোট পান্ডুয়ার মিনার

সিরিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় মুসলিম আমলের মিনারসমূহ ছিল বর্গাকৃতির এবং মাজানা হিসেবে ব্যবহার করা ছাড়াও মিনার আবাসিক বাড়ি হিসেবে (সাওয়ামী, সাওমার- বহুবচন) ব্যবহূত হতো। আট শতকের পরবর্তী সময়ে অনারব দেশ ইরানে বর্গাকৃতির পরিবর্তে গোলাকৃতি ধারণাটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। ভারতে গজনভী এবং ঘুরীদের বিজয়ের সঙ্গে এটা ভারতে প্রবর্তিত হয়। ভারতে টিকে থাকা মিনারের সবচেয়ে পুরাতন উদাহরণ হলো পাঞ্জাবের সোহদ্রা এবং দিল্লির কুতুব মিনার। এ মিনারগুলির আকার এবং উচ্চতা (কুতুব মিনারের উচ্চতা ৭৫ মিটারেরও বেশি) তাদের উচ্চতা ও জাঁকজমকের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন উপস্থাপন করে। মিনারগুলিতে লাগানো শিলালিপি থেকে সুলতানের প্রশংসা এবং ইসলামের গৌরবের বিবরণ ছাড়া যথার্থভাবে অন্য কিছুই জানা যায় না।

ফিরুজ মিনার

এ কথা সত্য যে, একজন মুয়াজ্জিনের পক্ষে এত উঁচুতে উঠে প্রতিদিন কয়েকবার নামাজের জন্য আহবান করা প্রায় অসম্ভব এবং এ মিনারগুলির কয়েকটি যেমন- গজনী, জাম এবং ইরান ও ভারতের অন্যান্য স্থানের মিনারগুলি মসজিদের সঙ্গে যুক্ত নয়। এর থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সংশ্লিষ্ট স্থানসমূহের ইসলামিকরণ এবং ধর্মের গৌরব ও বিজয়ের প্রতীক হিসেবে ইসলাম ও শাসকের শক্তি (কুওয়াত) প্রদর্শনের জন্যই এ মিনারগুলি নির্মিত হয়েছিল। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, এ ধরনের প্রতীকীকরণের কাজ বর্তমান কালেও হচ্ছে। অনেক দেশেই এ ধরনের টাওয়ার জাতির গৌরব প্রকাশ করছে, যেমন- লন্ডনের নেলসন টাওয়ার, প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, টরেন্টোতে কানাডার জাতীয় টাওয়ার এবং ঢাকার অন্তর্গত সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ।

সুলতানি আমলের ছোট পান্ডুয়ার মিনার, গৌড়ের ফিরুজ মিনার এবং মুগল আমলের নিমসরাই মিনার বাংলায় এখনো অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। প্রথমোক্ত মিনার দুটি মসজিদের সাথে সম্পর্কিত, কিন্তু শেষোক্তটি নাবিকদের জন্য বাতিঘর হিসেবে কালিন্দি ও মহানন্দা নদীর সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। অপর দুটি মিনারও পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। এর একটি হযরত পান্ডুয়ার আদিনা মসজিদ এর পেছনের দিকে নির্মিত হয়েছে বলে মনে করা হয় এবং অপরটি দেবীকোটে নির্মিত। এটি একটি ‘মাজানা’। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগের মতোই সাধারণভাবে ভারতে এবং বিশেষ করে বাংলায় ‘মাজানা’ তেমন জনপ্রিয় ছিল না।

নিমসরাই মিনার

দশ শতকের আরব ভূগোলবিদ ইবনে হওকল এর কারণ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, কতিপয় শাসকের গোঁড়ামী এর পেছনে কাজ করেছিল। কারণ, মসজিদের এ বৈশিষ্ট্য মদীনার নবীজির মসজিদে দেখা যায় না এবং এটি খোলাফায়ে রাশেদীন-এর শেষের দিকে প্রবর্তিত হয়, যা খলিফারা অতিরিক্ত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। এ কারণেই ভারতের শাসকগণ মসজিদ পরিকল্পনা থেকে ‘মাজানা’ বাদ দিয়েছিলেন। মসজিদের শিলালিপিসমূহ থেকেও এ বিষয়ের সমর্থন লাভ করা যায়। যেখানে মসজিদের সকল শিলালিপিতে আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা) এবং হায়দারকে যথাক্রমে ইসলাম ধর্মের চিরাগ (বাতি), মসজিদ, মিহরাব এবং মিম্বর হিসেবে তুলনা করা হয়, সেখানে মিনারকে কারও সঙ্গে তুলনা করা হয়নি। বাংলাসহ ভারতের মসজিদগুলিতে (এ মসজিদগুলিতে মাজানা ছিল না) মদীনার নবী (স)-এর মসজিদ উল নববীর মতোই নামাজের জন্য আহবান করা হতো ছাদের উপর থেকে অথবা মসজিদের প্রবেশপথ থেকে। যে সকল মসজিদে সিঁড়ি ছিল না, সে সকল মসজিদে বর্তমানকালের মতো মসজিদের সম্মুখ স্থান বা নিকটস্থ উঁচু স্থান থেকেই নামাজের জন্য আহবান করা হতো। আধুনিককালে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে এবং বিভিন্ন রকমের মাজানা, কখনও কখনও চমকপ্রদ পরিকল্পনায় মসজিদসমূহের নিকটেই মিনার নির্মিত হচ্ছে।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশে মিনারের রয়েছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ। ভাষা আন্দোলনের  শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফটকে ছাত্রদের দ্বারা যে মিনার নির্মিত হয়, তা শহীদ মিনার হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এটি তার গঠন ও অর্থে পাকিস্তানি শাসকদের নির্যাতনের বিমূর্ত এক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত। সারাদেশে, বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে, এর অনুকরণে মিনার নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মেডিকেল কলেজের উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত দেশ ও জাতির প্রতিনিধিত্বকারী মিনারটির স্থপতি হলেন বিখ্যাত চিত্রশিল্পি হামিদুর রহমান। বর্তমানে এটি একটি বড় প্লাজা এবং ভাষা শহীদ দিবসকে স্মরণ করার জন্য ছাত্র-জনতা প্রতি বছর শহীদ মিনার পরিদর্শন করে। এখানে স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য নির্যাতন ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে জাতি নতুন করে শপথ নিয়ে থাকে। অন্যদিকে এ মিনার হলো স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের প্রতীক।  [এ.বি.এম হোসেন]