মানুচি, নিকোলো: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
২ নং লাইন: ২ নং লাইন:
'''মানুচি, নিকোলো''' (১৬৩৯-১৭১৭)  ভেনিশীয় পর্যটক। তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করে এই দেশ ও অধিবাসীদের সম্পর্কে এক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে জন্মগ্রহণকারী মানুচি মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে স্মীর্না গামী এক জাহাজে চড়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেন। ভাইকাউন্ট বেলমন্ট তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এশিয়া মাইনর হয়ে হরমুজ থেকে জাহাজ যোগে সুরাট পৌঁছেন। অতঃপর বিজাপুর, গোলকুন্ডা, গোয়ালিয়র ও দোলপুর হয়ে তাঁরা দিল্লির নিকটবর্তী একটি স্থানে পৌঁছেন। এখানেই ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই অকস্মাৎ বেলমন্ট-এর মৃত্যু হয়। মানুচি দিল্লি পৌঁছেন এবং দারাহশিকোর অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরি নেন। মানুচি সামুগড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দারার পরাজয়ের পর পলায়ন করেন। তিনি লাহোরে দারার সাথে পুনরায় মিলিত হন। এরপর বক্কর দুর্গের পতন হলে তিনি বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
'''মানুচি, নিকোলো''' (১৬৩৯-১৭১৭)  ভেনিশীয় পর্যটক। তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করে এই দেশ ও অধিবাসীদের সম্পর্কে এক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে জন্মগ্রহণকারী মানুচি মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে স্মীর্না গামী এক জাহাজে চড়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেন। ভাইকাউন্ট বেলমন্ট তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এশিয়া মাইনর হয়ে হরমুজ থেকে জাহাজ যোগে সুরাট পৌঁছেন। অতঃপর বিজাপুর, গোলকুন্ডা, গোয়ালিয়র ও দোলপুর হয়ে তাঁরা দিল্লির নিকটবর্তী একটি স্থানে পৌঁছেন। এখানেই ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই অকস্মাৎ বেলমন্ট-এর মৃত্যু হয়। মানুচি দিল্লি পৌঁছেন এবং দারাহশিকোর অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরি নেন। মানুচি সামুগড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দারার পরাজয়ের পর পলায়ন করেন। তিনি লাহোরে দারার সাথে পুনরায় মিলিত হন। এরপর বক্কর দুর্গের পতন হলে তিনি বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।


[[Image:ManucciNicclao.jpg|thumb|right|400px|নিকোলো মানুচি]]
নিকোলো মানুচি সম্ভবত ১৬৬২-৬৩ খ্রি. বাংলা পরিভ্রমণ করেন। তিনি রাজমহল হয়ে নদীপথে (গঙ্গা) বাংলায় প্রবেশ করেন। তাঁর মতে, রাজমহল থেকে ঢাকায় পৌঁছুতে সময় লেগেছিল ১৫ দিন। তিনি লিখেছেন, ঢাকার পথে একস্থানে তিনি মীরজুমলার প্রেরিত বিরাট নৌকা দেখেছিলেন। সম্ভবত এগুলিতে আসাম বিজয়ে অধিকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। স্থানটি পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ধারার পরবর্তী কোন অংশ হবে বলে ধারণা করা হয়। মানুচি ঢাকাতে কতদিন ছিলেন, তা উল্লেখ করেননি। [[মীরজুমলা|মীরজুমলা]] আসামে থাকার কারণে তার সাথে মানুচির সাক্ষাৎ হয়নি। ১৬ শাবান, ১০৭২ হি (১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ) মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও অধিকার করেন। গড়গাঁওয়ের পতনের ফলে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি মীরজুমলা ঢাকায় প্রেরণ করেন যা মানুচি নদীপথে দেখেছিলেন। সুতরাং ধারণা করা যায় যে, মীরজুমলার গড়গাঁও বিজয়ের পরে কোন এক সময় মানুচি ঢাকা পৌঁছেন। ২ রমজান ১০৭৩ হিজরি (১৬৬৩ খ্রি. ৩০ মার্চ) মীরজুমলা ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের নিকট খিজিরপুরে মারা যান। এর আগেই মানুচি হুগলির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। অর্থাৎ ১৭ মার্চ ১৬৬২ এবং ৩০ মার্চ ১৬৬৩ এই দুই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে মানুচি কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।
নিকোলো মানুচি সম্ভবত ১৬৬২-৬৩ খ্রি. বাংলা পরিভ্রমণ করেন। তিনি রাজমহল হয়ে নদীপথে (গঙ্গা) বাংলায় প্রবেশ করেন। তাঁর মতে, রাজমহল থেকে ঢাকায় পৌঁছুতে সময় লেগেছিল ১৫ দিন। তিনি লিখেছেন, ঢাকার পথে একস্থানে তিনি মীরজুমলার প্রেরিত বিরাট নৌকা দেখেছিলেন। সম্ভবত এগুলিতে আসাম বিজয়ে অধিকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। স্থানটি পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ধারার পরবর্তী কোন অংশ হবে বলে ধারণা করা হয়। মানুচি ঢাকাতে কতদিন ছিলেন, তা উল্লেখ করেননি। [[মীরজুমলা|মীরজুমলা]] আসামে থাকার কারণে তার সাথে মানুচির সাক্ষাৎ হয়নি। ১৬ শাবান, ১০৭২ হি (১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ) মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও অধিকার করেন। গড়গাঁওয়ের পতনের ফলে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি মীরজুমলা ঢাকায় প্রেরণ করেন যা মানুচি নদীপথে দেখেছিলেন। সুতরাং ধারণা করা যায় যে, মীরজুমলার গড়গাঁও বিজয়ের পরে কোন এক সময় মানুচি ঢাকা পৌঁছেন। ২ রমজান ১০৭৩ হিজরি (১৬৬৩ খ্রি. ৩০ মার্চ) মীরজুমলা ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের নিকট খিজিরপুরে মারা যান। এর আগেই মানুচি হুগলির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। অর্থাৎ ১৭ মার্চ ১৬৬২ এবং ৩০ মার্চ ১৬৬৩ এই দুই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে মানুচি কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।


মানুচির বর্ণনানুসারে নদী তীরবর্তী ঢাকা ছিল নাতিবৃহৎ শহর। তিনি শহরবাসীর সংখ্যাধিক্যের উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ বাড়িই ছিল খড়ের তৈরী। তখন ঢাকায় মাত্র দুটি বিদেশী কুঠি ছিল ইংরেজদের ও  ওলন্দাজদের। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে রফতানির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ঢাকার নদীবন্দরে সাদা সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র (সম্ভবত মসলিন) ও রেশমীবস্ত্র জাহাজে ভর্তি করা হতো। ঢাকায় বহু খ্রিস্টান এবং শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় [[পর্তুগিজ, জাতি|পর্তুগিজ]] বাস করত। মানুচি মীরজুমলার একজন ইংরেজ সভাসদ টমাস প্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি নৌবাহিনীর তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি রণতরী ও নৌযুদ্ধের গোলাবারুদ মজুদ করতেন।
মানুচির বর্ণনানুসারে নদী তীরবর্তী ঢাকা ছিল নাতিবৃহৎ শহর। তিনি শহরবাসীর সংখ্যাধিক্যের উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ বাড়িই ছিল খড়ের তৈরী। তখন ঢাকায় মাত্র দুটি বিদেশী কুঠি ছিল ইংরেজদের ও  ওলন্দাজদের। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে রফতানির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ঢাকার নদীবন্দরে সাদা সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র (সম্ভবত মসলিন) ও রেশমীবস্ত্র জাহাজে ভর্তি করা হতো। ঢাকায় বহু খ্রিস্টান এবং শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় [[পর্তুগিজ, জাতি|পর্তুগিজ]] বাস করত। মানুচি মীরজুমলার একজন ইংরেজ সভাসদ টমাস প্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি নৌবাহিনীর তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি রণতরী ও নৌযুদ্ধের গোলাবারুদ মজুদ করতেন।
[[Image:ManucciNicclao.jpg|thumb|right|নিকোলো মানুচি]]


সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা থেকে হুগলি পৌঁছতে মানুচির ৪০ দিন সময় লাগে। মানুচির মতে [[সুন্দরবন|সুন্দরবন]] বাঘ, বন্যমহিষ ও জলহস্তীর জন্য বিখ্যাত। বিশেষত বাঘের উপদ্রব ছিল ভয়ঙ্কর। মানুচি মীর জুমলা প্রেরিত যে মালবাহী নৌবহর ঢাকার পথে দেখেছিলেন তার বর্ণনায় বলেছেন, নৌকাগুলির চার পাশ ছিল খুব উঁচু আর অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। নৌকার সম্মুখভাগের গঠন ও আকৃতি ভয়ের সঞ্চার করতো। হুগলিতে মানুচি দুমাস অতিবাহিত করেন। তিনি বলেছেন হুগলিতে পর্তুগিজদের লবণের কুঠি ছিল। সন্দ্বীপেও পর্তুগিজদের লবণ কারখানার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। মানুচি এখান থেকে তিন দিনের দূরত্বে কাসিমবাজারে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা থেকে হুগলি পৌঁছতে মানুচির ৪০ দিন সময় লাগে। মানুচির মতে [[সুন্দরবন|সুন্দরবন]] বাঘ, বন্যমহিষ ও জলহস্তীর জন্য বিখ্যাত। বিশেষত বাঘের উপদ্রব ছিল ভয়ঙ্কর। মানুচি মীর জুমলা প্রেরিত যে মালবাহী নৌবহর ঢাকার পথে দেখেছিলেন তার বর্ণনায় বলেছেন, নৌকাগুলির চার পাশ ছিল খুব উঁচু আর অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। নৌকার সম্মুখভাগের গঠন ও আকৃতি ভয়ের সঞ্চার করতো। হুগলিতে মানুচি দুমাস অতিবাহিত করেন। তিনি বলেছেন হুগলিতে পর্তুগিজদের লবণের কুঠি ছিল। সন্দ্বীপেও পর্তুগিজদের লবণ কারখানার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। মানুচি এখান থেকে তিন দিনের দূরত্বে কাসিমবাজারে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

০৪:৩৫, ৪ মার্চ ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

মানুচি, নিকোলো (১৬৩৯-১৭১৭)  ভেনিশীয় পর্যটক। তিনি ভারতের বিভিন্ন অংশে পরিভ্রমণ করে এই দেশ ও অধিবাসীদের সম্পর্কে এক নির্ভরযোগ্য বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে জন্মগ্রহণকারী মানুচি মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে স্মীর্না গামী এক জাহাজে চড়ে প্রথম যাত্রা শুরু করেন। ভাইকাউন্ট বেলমন্ট তাঁর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরা ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে এশিয়া মাইনর হয়ে হরমুজ থেকে জাহাজ যোগে সুরাট পৌঁছেন। অতঃপর বিজাপুর, গোলকুন্ডা, গোয়ালিয়র ও দোলপুর হয়ে তাঁরা দিল্লির নিকটবর্তী একটি স্থানে পৌঁছেন। এখানেই ১৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই অকস্মাৎ বেলমন্ট-এর মৃত্যু হয়। মানুচি দিল্লি পৌঁছেন এবং দারাহশিকোর অধীনে গোলন্দাজ বাহিনীতে চাকরি নেন। মানুচি সামুগড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং দারার পরাজয়ের পর পলায়ন করেন। তিনি লাহোরে দারার সাথে পুনরায় মিলিত হন। এরপর বক্কর দুর্গের পতন হলে তিনি বাংলার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

নিকোলো মানুচি

নিকোলো মানুচি সম্ভবত ১৬৬২-৬৩ খ্রি. বাংলা পরিভ্রমণ করেন। তিনি রাজমহল হয়ে নদীপথে (গঙ্গা) বাংলায় প্রবেশ করেন। তাঁর মতে, রাজমহল থেকে ঢাকায় পৌঁছুতে সময় লেগেছিল ১৫ দিন। তিনি লিখেছেন, ঢাকার পথে একস্থানে তিনি মীরজুমলার প্রেরিত বিরাট নৌকা দেখেছিলেন। সম্ভবত এগুলিতে আসাম বিজয়ে অধিকৃত দ্রব্যাদি ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল। স্থানটি পদ্মা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত ধারার পরবর্তী কোন অংশ হবে বলে ধারণা করা হয়। মানুচি ঢাকাতে কতদিন ছিলেন, তা উল্লেখ করেননি। মীরজুমলা আসামে থাকার কারণে তার সাথে মানুচির সাক্ষাৎ হয়নি। ১৬ শাবান, ১০৭২ হি (১৬৬২ সালের ১৭ মার্চ) মীরজুমলা আসামের রাজধানী গড়গাঁও অধিকার করেন। গড়গাঁওয়ের পতনের ফলে প্রাপ্ত দ্রব্যাদি মীরজুমলা ঢাকায় প্রেরণ করেন যা মানুচি নদীপথে দেখেছিলেন। সুতরাং ধারণা করা যায় যে, মীরজুমলার গড়গাঁও বিজয়ের পরে কোন এক সময় মানুচি ঢাকা পৌঁছেন। ২ রমজান ১০৭৩ হিজরি (১৬৬৩ খ্রি. ৩০ মার্চ) মীরজুমলা ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের নিকট খিজিরপুরে মারা যান। এর আগেই মানুচি হুগলির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। অর্থাৎ ১৭ মার্চ ১৬৬২ এবং ৩০ মার্চ ১৬৬৩ এই দুই তারিখের মধ্যবর্তী সময়ে মানুচি কিছুদিন ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।

মানুচির বর্ণনানুসারে নদী তীরবর্তী ঢাকা ছিল নাতিবৃহৎ শহর। তিনি শহরবাসীর সংখ্যাধিক্যের উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ বাড়িই ছিল খড়ের তৈরী। তখন ঢাকায় মাত্র দুটি বিদেশী কুঠি ছিল ইংরেজদের ও  ওলন্দাজদের। ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে রফতানির উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ঢাকার নদীবন্দরে সাদা সূক্ষ্ম কার্পাসবস্ত্র (সম্ভবত মসলিন) ও রেশমীবস্ত্র জাহাজে ভর্তি করা হতো। ঢাকায় বহু খ্রিস্টান এবং শ্বেতকায় ও কৃষ্ণকায় পর্তুগিজ বাস করত। মানুচি মীরজুমলার একজন ইংরেজ সভাসদ টমাস প্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি নৌবাহিনীর তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি রণতরী ও নৌযুদ্ধের গোলাবারুদ মজুদ করতেন।

সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ঢাকা থেকে হুগলি পৌঁছতে মানুচির ৪০ দিন সময় লাগে। মানুচির মতে সুন্দরবন বাঘ, বন্যমহিষ ও জলহস্তীর জন্য বিখ্যাত। বিশেষত বাঘের উপদ্রব ছিল ভয়ঙ্কর। মানুচি মীর জুমলা প্রেরিত যে মালবাহী নৌবহর ঢাকার পথে দেখেছিলেন তার বর্ণনায় বলেছেন, নৌকাগুলির চার পাশ ছিল খুব উঁচু আর অদ্ভুতভাবে বাঁকানো। নৌকার সম্মুখভাগের গঠন ও আকৃতি ভয়ের সঞ্চার করতো। হুগলিতে মানুচি দুমাস অতিবাহিত করেন। তিনি বলেছেন হুগলিতে পর্তুগিজদের লবণের কুঠি ছিল। সন্দ্বীপেও পর্তুগিজদের লবণ কারখানার কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। মানুচি এখান থেকে তিন দিনের দূরত্বে কাসিমবাজারে পৌঁছেন এবং সেখান থেকে আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

বাংলা সম্পর্কে মানুচির বিবরণ প্রায় সবটাই সমসাময়িক ইতিহাসের কথা। তার বর্ণনায় শাহ সুজা, মীরজুমলা ও মগ-পর্তুগিজ হামলা প্রধান্য পেয়েছে। সুজা ও মীরজুমলার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের যে বর্ণনা মানুচি দিয়েছেন তা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা নয়, কারণ তিনি তখন পশ্চিম ভারতে লড়াইয়ে ব্যস্ত। সুতরাং তার এ বিবরণ অন্যের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে লেখা। তাঁর বর্ণনায় পূর্ববঙ্গে আরাকানি মগ এবং পশ্চিমবঙ্গে মারাঠা হামলার (বর্গী) কথা জানা যায়। মানুচির বিবরণ অনুযায়ী পর্তুগিজদের আস্তানা ছিল চট্টগ্রামে। তিনি চট্টগ্রামকে বাংলা ও আরাকানের সীমান্তবর্তী ‘সংগ্রাম কেন্দ্র’ বলে উল্লেখ করেছেন।

বাংলার রাজস্ব সম্পর্কে মানুচি তাঁর বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন যে, মীরজুমলা কর্তৃক সংগৃহীত রাজস্ব তাঁর উত্তরাধিকারী শায়েস্তা খান  সম্রাট আওরঙ্গজেবের নিকট প্রেরণ করেন। এর পরিমাণ ছিল তিনশ গরুর গাড়ি রৌপ্য ও পঞ্চাশ গাড়ি স্বর্ণ। বাংলা থেকে ফিরে দিল্লিতে অবস্থানকালে তিনি এগুলি প্রত্যক্ষ করেন। মানুচির বিবরণীর ২য় খন্ডে ২৪টি প্রদেশের বার্ষিক রাজস্বের যে তালিকা দেওয়া হয়েছে তাতে বাংলার রাজস্বের পরিমাণ ছিল ৪ কোটি টাকা। ১৭০৭ খ্রি. রাজস্ব-তালিকায় এর পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৫০ হাজার টাকা।

বাংলা থেকে মানুচি আগ্রায় ফিরে যান এবং রাজা জয়সিংহের গোলোন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। জয়সিংহ-এর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মানুচি গোয়ায় পৌঁছেন। ১৬৭১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে তিনি লাহোরে ফিরে চিকিৎসা বিদ্যায় তার অনুশীলন শুরু করেন। ১৬৭৬ খ্রি. দিকে সালসেটি (Salcette) দ্বীপে তিনি তাঁর আবাস স্থাপন করেন। তিনি আবার দিল্লিতে আসেন এবং যুবরাজ মুয়াজ্জম (পরবর্তী কালে সম্রাট প্রথম শাহ-আলম)-এর স্ত্রীকে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলেন। এর ফলে ১৬৭৮ খ্রি. জানুয়ারিতে তিনি যুবরাজের রাজ সভায় চিকিৎসক পদে যোগ দেন।

১৬৮৩ খ্রি. প্রথম দিকে তিনি যুবরাজের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে আবার সুরাটে যান। এরপর ওখান থেকে গোয়ায় পৌঁছেন এবং পর্তুগিজদের সহযোগী হিসেবে মারাঠা-পর্তুগিজ দ্বন্ধে অংশ নেন। পুরস্কার হিসেবে পর্তুগিজরা তাঁকে নাইট উপাধিতে ভুষিত করেন। এরই মধ্যে যুবরাজ তাঁকে তাঁর চাকরিতে পুনরায় যোগ দিতে বাধ্য করেন। এরপর কয়েকবারের চেষ্টায় মানুচি ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে মাদ্রাজে ইংরেজদের কাছে পালিয়ে পন্ডিচেরীতে যেতে সক্ষম হন। তিনি পুনরায় চিকিৎসা বিদ্যায় অনুশীলন শুরু করেন এবং শল্য চিকিৎসা এবং পাথর ও ঔষধ ব্যবসায় পরিচিত হয়ে ওঠেন। পন্ডিচেরীতেই ১৭১৭ খ্রি. মানুচির মৃত্যু হয়।

১৭০২ খ্রি. একজন ফরাসি অফিসার ডেল্যান্ডের মাধ্যমে মানুচি তাঁর পান্ডুলিপির প্রথম তিন অধ্যায় প্যারিসে পাঠিয়েছিলেন। ১৭০৫ খ্রি. প্যারিসে জেসুইট ধর্মযাজক ফ্রাঙ্কুইস ক্যাটরু ভারতে মুগল ইতিহাসের একটি খন্ড প্রকাশ করেন। তিনি ডেল্যান্ডের মাধ্যমে প্রেরিত মানুচির পান্ডুলিপি ব্যাবহার করার কথা স্বীকার করেছিলেন। ১৭০৬ থেকে ১৭১২ খ্রি. মধ্যে মানুচি তাঁর লিখিত পান্ডুলিপির শেষ দুই অংশ ইউরোপে পাঠান।

১৭১৫ খ্রি. ক্যাটরু আওরঙ্গজেবের ইতিহাস প্রকাশ করেন এবং স্বীকার করেন যে, তিনি মানুচির পান্ডুলিপি থেকে তথ্যাবলি নিয়েছেন। বার্লিন কোড (Barlin Codex) নামের গ্রন্থটি তিনটি খন্ডে বিভক্ত। ১ম খন্ডটি মানুচির ভ্রমণ থেকে শুরু হয়েছে এবং তৈমুরলং-এর সময় থেকে আওরঙ্গজেবের সিংহাসন আরোহণ পর্যন্ত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। ২য় খন্ডে ১৬৯৯ খ্রি. পর্যন্ত আওরঙ্গজেবের যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং ৩য় খন্ডে প্রতিবেশী রাজন্যবর্গের প্রতিপত্তি ও অসাধারণ সব ঘটনা আলোচনা করা হয়েছে। মানুচি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি সরকারি ঘটনাপঞ্জি থেকে এই সব তথ্য সংগ্রহ করেছেন। মানুচি অন্য একটি খন্ডে ভারতীয়দের দেবতা, পুরোহিত, মুগল সম্রাটদের প্রতিকৃতি ও মুগল পরিবারের ছবি দেন। এই দুই খন্ড ভেনিস কোড (Venice Codex) নামে পরিচিত, যা আংশিক ইটালিয়ান ও আংশিক ফরাসি ভাষায় লিখিত। মানুচি প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কিছু চিত্রকলা পাঠিয়েছিলেন, যা প্যারিসের জাতীয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। [অনিরুদ্ধ রায়]