মহিষদল

মহিষদল  একটি প্রত্নস্থল। এটি ভারতের পশ্চিম বাংলার বীরভূম জেলার বর্তমান মহিষদল গ্রামের সিকি কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কোপাই নদীর বাম তীরে অবস্থিত। এলাকাটি পশ্চিম বাংলার লাল মৃত্তিকা অঞ্চলে অবস্থিত, যা বীরভূম জেলার পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে  বিস্তৃত ছিল। ১৯৬৩-৬৪ সালে Archaeological Survey of India প্রত্নস্থলটি উৎখনন করে।

আইএআর কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুসারে প্রত্নস্থলটির মূল এলাকা ছিল ২৩০ মি × ১৩৫ মি, কিন্তু সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে বর্তমানে এর অধিকাংশই ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়ে গেছে। উৎখননের মাধ্যমে এখানে দুটি সাংস্কৃতিক যুগপর্ব উন্মোচিত হয়েছে। প্রথম যুগটি ক্ষুদ্র প্রস্তর, কালো-লাল মৃৎপাত্র (নিরাভরণ ও অঙ্কিত) এবং লাল মৃৎপাত্র, সামান্য পরিমাণ তামা, স্টিটাইট ও স্বল্প মূল্যবান পাথরের গুটিকা, হাড়ের হাতিয়ার/বালা, পোড়ামাটির খেলার সামগ্রী ও অলঙ্কৃত চিরুনি ইত্যাদি সাংস্কৃতিক নিদর্শনের প্রতিনিধিত্ব করছে। মৃৎপাত্রসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান একটি নলওয়ালা পাত্র, একটি চওড়া তল বিশিষ্ট পাত্র যা কিছুটা স্ফীত হয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে ও প্রান্তটি কিছুটা বৃত্তাকার এবং একটি উত্তল প্রান্তযুক্ত পাত্র। মাটির নিচে দুই স্তরে পোড়ামাটির চূর্ণে গড়া মেঝের উপস্থিতি দুই স্থাপত্যিক পর্বকে চিহ্নিত করে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় আবিষ্কার হচ্ছে আগুনে ধ্বংসপ্রাপ্ত মাটির গর্তে অবস্থিত একটি শস্যাগার। এখান থেকে কয়লা হয়ে যাওয়া বেশ কিছু চাল উদ্ধার করা হয়েছে। অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে একটি পোড়ামাটির লিঙ্গমূর্তি আবিষ্কার সমকালীন মানুষদের ধর্মাচারণের প্রতি আলোকপাত করে। এই যুগের প্রাচীনতম কাল ১৬১৯-১৪১৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। বড় কোন অগ্নিকান্ডের ফলেএই যুগ-পর্বের সমাপ্তি ঘটে বলে ধারণা করা হয়।

দ্বিতীয় পর্বটি ৭৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অব্যাহতভাবে প্রলম্বিত ছিল। এখানে প্রাপ্ত এ সময়ের লৌহনির্মিত দ্রব্যের মধ্যে তীরের ফলা, বর্শার ফলা, বাটালি, পেরেক ইত্যাদির পাশাপাশি রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ আকরিক লৌহ; তামার প্রতিনিধিত্ব করছে একটি মাছ ধরার বড়শি এবং কিছু বালা ও আংটি। পূর্ববর্তী যুগের মৃৎপাত্রের ঐতিহ্য এ যুগেও অব্যাহত ছিল, তবে এর গঠনশৈলী অনেকটা স্থূল হয়ে পড়ে। এ যুগের নতুন সংযোজন ধূসর মৃৎপাত্র হলেও সাংস্কৃতিক দৃশ্যপটের বিচারে তা ছিল পূর্ববর্তী যুগেরই ধারাবাহিকতা। পোড়ানো নয় এমন কাদা মাটির সিল পাওয়া গেছে- যার সামনের পিঠে রয়েছে প্রতীক চিহ্ন, যাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি এবং পেছনের পিঠে রয়েছে একটি ক্রস চিহ্ন। কাদার প্রলেপ দেখে ঘর বানানোর প্রক্রিয়ার কথা ধারণা করা হয়। অগ্নিকান্ডের মধ্য দিয়ে সম্ভবত এই যুগেরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

মহিষদল একই ভৌগোলিক এলাকার কালো ও লাল মৃৎপাত্র সমৃদ্ধ অন্যান্য প্রত্নস্থলের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বিচার্য। বাংলায় কালো ও লাল মৃৎপাত্র প্রত্নস্থল ছড়িয়ে ছিল লাল মাটির এলাকা এবং অপেক্ষাকৃত প্রাচীন পাললিক অঞ্চলে। এই প্রত্নস্থলগুলিকে আলোচ্য অঞ্চলসমূহের নির্ধারিত প্রাকৃতিক বিভাজনের আলোকে শ্রেণিকরণ করা যায়। এভাবে এর মধ্য দিয়ে বাংলার প্রাক-ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে যে সংকট রয়েছে তাকে অতিক্রম করা সম্ভব।  [বিষ্ণুপ্রিয় বসাক]