মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা

মঙ্গল শোভাযাত্রা এক রঙিন সাংস্কৃতিক পদযাত্রা এবং আনন্দমিছিল, যা বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এটি বাংলা নববর্ষ তথা পহেলা বৈশাখে উদ্যাপিত হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা প্রত্যেক বছর ১৪ই এপ্রিল নতুন বাংলা পঞ্জিকার সূচনা উপলক্ষে এটির আয়োজন করে। মঙ্গল শোভাযাত্রা অর্থ হলো মঙ্গলার্থে পদযাত্রা। বাংলাদেশের মানুষের সাম্য ও সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক এই সোৎসাহ শোভাযাত্রা।

ঢাকা ফাইন আর্টস ইনস্টিটিউট (যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ)-এর তিন জন ছাত্র মাহাবুব জামাল শামীম, মোকলেসুর রহমান ও হিরণ্ময় চন্দ্র সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার ধারণা নিয়ে আসেন। এই তিন জন ও তাঁদের বন্ধুবান্ধবদের দ্বারাই ১৯৮৯ সালে শোভাযাত্রার সূচনা হয়, তবে এর অনুপ্রেরণা তাঁরা পান ১৯৮৫ সালে যশোরে অনুষ্ঠিত একটি শোভাযাত্রা থেকে। তৎকালীন ছাত্ররা অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে একটি সাংস্কৃতিক লড়াই চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাঁরা চেয়েছিল আশির দশকে সাধারণ মানুষের মনে উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের আশা জাগাতে, যখন সর্বগ্রাসী বন্যা ও সামরিক শাসনের অত্যাচার-সহ অজস্র বেদনার্ত ঘটনা তাদের হৃদয়কে ভারাক্রান্ত করে রেখেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বড়ো বড়ো প্রতিষ্ঠানসমূহের বাণিজ্যিক ছাপ মঙ্গল শোভাযাত্রার উপর পড়তে দেয়নি; বরং সাবেক ও বর্তমান ছাত্র ও শিক্ষকেরা অর্থের যোগান নিশ্চিত করতেন সচরাচর নিজেদের বানানো চিত্রকর্ম, সানকি, মুখোশ, শিল্পকর্ম ইত্যাদি বিক্রির মাধ্যমে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোকাচারের প্রসারের লক্ষ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বিভিন্ন প্রাণির আকৃতি, হরেক রঙের মুখোশ, পাখি ও প্রজাপতির প্রতিরূপ, পুতুল ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দেশীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখার জন্যে প্রতি বছরই নতুন নতুন বিষয় শোভাযাত্রায় যুক্ত হতো। উক্ত শোভাযাত্রা উৎসাহিত করা হতো বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি, সাম্য ও সহানুভূতি, এবং জোরদার করা হতো বাঙালির চিরায়ত ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রা আরো প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে সঙ্গীত, নৃত্য, নাট্য প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র, যেমন ঢোল, বাঁশি ও করতাল বাজিয়ে উদ্দীপিত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকেই পরিধান করে ঐতিহ্যবাহী পোশাকাদি, সঙ্গে থাকে ব্যানার-ফেস্টুন, মুখাবরণ, যা বিভিন্ন বিষয়কে তুলে ধরে।

পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইউনেস্কো বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় ৩০শে নভেম্বর ২০১৬ সালে, ইথিওপিয়ার আদ্দিস আবাবায় অনুষ্ঠিত অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষার জন্য আন্তঃসরকার কমিটির ১১তম অধিবেশনে।

সংক্ষেপে, এটি একটি সার্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব, যা বাংলাদেশীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক চেতনা, এবং সহানুভূতিসম্পন্ন একাত্মতা প্রচার করে। [গোবিন্দ চক্রবর্তী]