মখদুম শাহ (রঃ)

মখদুম শাহ  বাংলার আউলিয়া-দরবেশদের মধ্যে খুবই পরিচিত ও শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে পুরানো শাহী মসজিদের পার্শ্ববর্তী কবরস্থানে তিনি শায়িত আছেন। স্থাপত্যরীতির বিবেচনায় বলা যায় যে, শাহজাদপুর মসজিদটি মুগলপূর্ব যুগে নির্মিত। কিন্তু মসজিদ গাত্রে কোন অভিলেখ না থাকায় এর নির্মাণ তারিখ নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে এবং লিখিত সাক্ষ্যের অনুপস্থিতিতে দরবেশ মখদুম শাহ-এর পরিচিতি ও ইতিহাস সঠিক ভিত্তির উপর দাঁড় করানো সম্ভব নয়।

এতদঞ্চলে প্রচলিত একটি জনশ্রুতিই মখদুম শাহ সম্বন্ধে জানার একমাত্র উৎস। প্রায় একশত বছর পূর্বে এ কাহিনী সংগ্রহ করে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।

প্রচলিত কাহিনী অনুযায়ী ইয়েমেনের জনৈক রাজা মুয়াজ বিন জবলের এক কন্যা ও দুই পুত্রের একজন ছিলেন মখদুম শাহ দৌলাহ। পিতার অনুমতি নিয়ে তিনি নিজে এবং আরও বারোজন আউলিয়াসহ বিধর্মীদের দেশে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হন। এছাড়া স্বীয় বোন এবং খাজা কালান দানিশমন্দ, খাজা নূর ও খাজা আনোয়ার নামে তাঁর তিন ভাগনে তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন। পথিমধ্যে বোখারাতে শেখ জালালুদ্দীন বোখারীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ তিনি মখদুম শাহকে ধূসর রঙের একজোড়া কবুতর উপহার দেন। বোখারা থেকে দলটি বাংলা অভিমুখে যাত্রা করে। তিনি দলবলসহ বাংলায় এসে জনৈক হিন্দু রাজার শাসনাধীন শাহজাদপুর নামক লোকালয়ে বসবাস শুরু করেন। ঐ রাজার রাজ্য বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মখদুম শাহ ও তাঁর অনুসারীদের উৎখাত করার জন্য রাজা আদেশ দেন। ফলে দুই দলের মধ্যে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে খাজা নূর ব্যতীত মখদুম শাহ ও তাঁর অন্যান্য সঙ্গী শাহাদত বরণ করেন। এ বিষাদময় ঘটনা থেকে পরিত্রাণ পেয়ে পরবর্তীসময়ে খাজা নূর সোনারগাঁও এর এক রাজকুমারীকে বিয়ে করেন। শাহজাদপুর পরিবার যারা মখদুম শাহ দৌলার বংশ বলে দাবি করে আসছে, তারা সম্ভবত খাজা নূর ও সোনারগাঁয়ের রাজকুমারীর বংশধর।

মখদুম শাহ দৌলাহ শহীদ যে পরিবেষ্টিত প্রাঙ্গণে শায়িত আছেন ঠিক সেখানে শাহ ইউসুফের সমাধিসৌধ অবস্থিত। মখদুম শাহের অন্যান্য অনুসারীদেরকে পাশের একটি আঙ্গিনায় কবর দেওয়া হয়। শামসুদ্দীন তাব্রিজিকে (প্রখ্যাত ‘মসনভি’ রচয়িতা শেখ জালালুদ্দীন রুমির শিক্ষক শামসুদ্দীন তাব্রিজি নন। তিনি কখনও বাংলায় এসেছেন বলে জানা যায় না) শাহ দৌলাহ শহীদের অনুসারী বলে ধরা হয়। পৃথক অন্য একটি আঙ্গিনায় শামসুদ্দীন তাব্রিজি শায়িত আছেন। অন্যান্যরা যাঁদেরকে মখদুম শাহের সঙ্গী ধরা হয় এবং যাঁদের সমাধি একই আঙ্গিনায় অবস্থিত তাঁরা হলেন শাহ খিনগার, শাহ আজমল, হাসিল পীর, শাহ বোদলা, শাহ আহমদ এবং শাহ মাহমুদ। তাঁর অন্যান্য কিছু সহচরদের গণকবর দেওয়া হয় এবং তা গঞ্জ-ই-শহীদান নামে পরিচিত। মখদুম শাহের বোন নিকটবর্তী নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং ঐ জায়গাটি এখনও ‘সতীবিবির ঘাট’ নামে পরিচিত। যেহেতু মখদুম শাহ ইয়েমেন রাজ্যের শাহজাদা নামে পরিচিত, তাই তাঁর নামানুসারে স্থানটির নামকরণ করা হয় শাহজাদপুর। মুসলিম আমলে শাহজাদপুর পরগণা ইউসুফশাহীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইউসুফ শাহ-এর নামানুসারেই এ পরগণার নামকরণ হয়। ৭২২ বিঘা জমি নিয়ে এক বিরাট এস্টেট শাহজাদপুর দরগাহ ও মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দান করা হয়। এ এস্টেট এখনও মখদুম শাহের ভাগনে খাজা নূরের বংশধরেরা ভোগ-দখল করছেন।

মখদুম শাহ দৌলাহর বাংলায় আগমনের তারিখ নির্ণয় করা যায়নি। প্রচলিত কাহিনী অনুসারে, তুর্কি আক্রমণের পূর্বে বারো শতকে তিনি এবং তাঁর সহচরগণ বাংলায় আসেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অবশ্য আধুনিক পন্ডিতগণ এ ধারণার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। ইয়েমেনের সুলতান মুয়াজ বিন জবলকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ মুয়াজ বিন জবল নবী হজরত মুহম্মদ (স.)-এর সাহাবি ছিলেন। তিনি ১৭ বা ১৮ হিজরিতে মারা যান। তাই নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, লোককাহিনীর মুয়াজ এবং মুহম্মদের (স.) সাহাবি মুয়াজ কোনক্রমেই অভিন্ন ব্যক্তি নন। জালালুদ্দীন বোখারী, যাঁর সঙ্গে মখদুম শাহের দেখা হয়েছিল বলে বলা হয়, তাঁর, ১২৯১ সালে মৃত্যু হয়। অতএব এ ব্যক্তিবর্গের সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা যায় যে, মখদুম শাহ চোদ্দ শতকের পূর্বে বাংলায় আসেননি এবং নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, বখতিয়ারের বাংলা বিজয়ের পর তিনি এদেশে আসেন।

শাহজাদপুর দরগাহে প্রতি বছর চৈত্র মাসে (মধ্য-এপ্রিল) একমাস ব্যাপী মেলা হয়। মেলার সময় এখানে সকল সম্প্রদায়ের লোকের সমাগম হয়। দরগায় উৎসর্গীকৃত সামগ্রীর মধ্যে চাল, চিনি, মিষ্টি, মোরগ এবং চেরাগ (এক ধরনের ব্রতমূলক বাতি) প্রধান।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি  Journal of the Asiatic Society of Bengal, Calcutta, 1904; Muhammad Enamul Haq, A History of Sufism in Bengal, Dhaka, 1975; Abdul Karim, Social History of Muslims in Bengal (2nd ed), Chittagong, 1985.