ভূঅবনমন

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:৩৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

ভূঅবনমন (Subsidence)  এক ধরনের ব্যাপক বিচলন যাতে ভূ-পৃষ্ঠস্থ পদার্থসমুহ প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারণে অভ্যন্তরীণ ভার বহন করার সমর্থন হারিয়ে নিম্নগামী বা স্থানচ্যুত হয়। এটি ভূ-গাঠনিক ক্রিয়া, সমস্থিতিক উপযোজন (isostatic adjustment), ঘনবিন্যস্ত অবক্ষেপ, তরল অপসারণ এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থানের ফলাফল স্বরূপ। অধিকাংশ বদ্বীপীয় অঞ্চল তুলনামূলকভাবে ব্যাপক অবনমনের শিকার হয়। আবার প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পরিমাণ নদীবাহিত অবক্ষেপের দ্বারা এই ঘাটতি পূরণ হয়ে ভারসাম্য রক্ষা হচ্ছে। তবে নদীখাত সৃষ্টি করা হলে, প্রাকৃতিকভাবে নদী দিক পরিবর্তন করলে অথবা অন্য কোনভাবে গতিপথ ক্ষতিগ্রস্থ হলে অবনমনজনিত ঘাটতি পূরণ সম্ভব হয় না। কিছু কিছু অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে অন্তর্ভূপৃষ্ঠ পদার্থসমূহের দৃঢ়করণ দ্রুত হয় যা অবনমন বৃদ্ধি করে। বঙ্গীয় অববাহিকার অধিকাংশ জুড়ে যে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপ রয়েছে, তা হিমালয় পর্বতমালার উত্থানের কারণে ভূত্বকের সমাস্থিতিক সমন্বয় হেতু এবং মায়ো-প্লায়োসিন সময়ের বদ্বীপীয় অবক্ষেপের নিচে অবস্থিত আদি বঙ্গ উপবদ্বীপীয় অবক্ষেপের অন্তঃস্তরীয় জল প্রচন্ড চাপে বের হয়ে যাওয়ার কারণে ধীরে ধীরে অবনমিত হয়ে যাচ্ছে। বঙ্গীয় অববাহিকা ও গাঙ্গেয়- ব্রহ্মপুত্র বদ্বীপের অবনমনের গতির হার স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন এবং অববাহিকায় উত্থিয়মান হিমালয় থেকে অবক্ষেপের সরবরাহ প্লেট বিচলন দ্বারা প্রভাবিত। ঢাকার উত্তর-পশ্চিমে হাজীপুর কূপ থেকে প্রাপ্ত অন্তর্ভূপৃষ্ঠ উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে বঙ্গীয় অববাহিকার অন্তত একটি অংশ বছরে ২.৪ সেমি হারে অবনমিত হচ্ছে। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত হিজলা-মুলাদী কূপ থেকে প্রাপ্ত উপাত্তে এই অবনমনের হার বছরে আনুমানিক ২.০ সেমি। ফরিদপুর খাদ, হাতিয়া খাদ ও সিলেট খাদও সম্ভবত উপরোল্লিখিত হারে অথবা দ্রুততর হারে অবনমিত হচ্ছে। খুলনা অঞ্চল বছরে প্রায় ৪ মিমি হারে অবনমিত হচ্ছে বলে মনে হয়। ঢাকার নিম্নাঞ্চলে অবনমনের হার বছরে ১.৮৮ মিমি। ঢাকা মহানগরীর মিরপুরের নিম্নাঞ্চলে বছরে ০.৯৬ মিমি এবং রামপুরায় ০.৬০ মিমি হারে ভূমি দেবে যাচ্ছে। ঢাকা মহানগর অঞ্চলে গড় অবনমনের বাৎসরিক হার ০.৬৫ মিমি।

ভূতাত্ত্বিক স্তরের অবনমনের লক্ষণকে ভূ-পৃষ্ঠের সাধারণ নিচু হওয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করা ঠিক হবে না। এটা অসংহত অবক্ষেপ অঞ্চলে একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কারণ এটি অতিরিক্ত ভারের চাপে ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে অবস্থিত অবক্ষেপের ক্রমশ সংবদ্ধনেরই প্রতিফলন। সাধারণত ভূ-পৃষ্ঠে সরবরাহকৃত অবক্ষেপ আর অবনমনের মধ্যে একটা সাম্যাবস্থা বিরাজমান থাকে যাতে ভূ-পৃষ্ঠের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন সাধিত না হয়। অবশ্য মানুষের কার্যক্রমে অবক্ষেপের সংবদ্ধনের হার বেড়ে গিয়ে এবং অবক্ষেপ সরবরাহের পরিমাণ হ্রাস পেয়ে ভূ-পৃষ্ঠে অবনমন ঘটতে পারে। ব্যাপক বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প অথবা নদীর গতি পরিবর্তন অবক্ষেপ সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করতে পারে। আবার ভূ-অভ্যন্তরের পানি ব্যাপক পরিমাণে তুলে নিলে ভূগর্ভস্থ পানির চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যেতে পারে যা অবক্ষেপের উল্লম্ব সংবদ্ধন বৃদ্ধি করে। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে অবনমনের বড় বড় ঘটনা ব্যাঙ্কক, টোকিও, মেক্সিকো সিটি, ভেনিস ও ক্যালিফোর্ণিয়ার সান জোয়াকুইন উপত্যকায় সংঘটিত হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নেমে গেছে। কিন্তু এর ফলে উল্লেখযোগ্য অবনমনের কোন প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রা কমে গেলে গোপালগঞ্জ-খুলনা পিট অববাহিকায় অবনমন ও বাতাস তাড়িত মৃত্তিকা ক্ষয়ের আশংকা বেশি। অতএব এই সব অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উন্নয়ন কার্যক্রম সীমিত করতে হবে।  [মো. সাজ্জাদ হোসেন]

পার্থক্যমূলক অবনমন (Differential subsidence)  বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মাত্রায় ভূমির অবনমন বা বসে যাওয়া। স্থানচ্যুতি যদি অতর্কিত বা আকস্মিক হয়, তখন তাকে ধ্বস (collapse) বলে। বড় বড় শিলাখন্ড অথবা পানি বা হাইড্রোকার্বনের মতো তরল পদার্থ বহুল পরিমাণে অপসারণের ক্ষেত্রে অবনমন ও ধ্বস গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। ভূগর্ভস্থ খননকার্য ভূমি বসে যাওয়ার আবশ্যিক কারণ যা সহায় সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। অবশ্য ভূগর্ভস্থ পানি বা হাইড্রোকার্বন উত্তোলনের কারণে যে ভূমি অবনমন ঘটে তা ভূগর্ভস্থ খননকার্যের চেয়ে কম। খনিজ সম্পদ উত্তোলনের কারণে ভূমি অবনমনের যেমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে তেমনি ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে অবনমনের ঘটনা উপরে বর্ণিত হয়েছে।

বাংলাদেশে খনিজ সম্পদের জন্য ভূগর্ভস্থ খননকার্য তেমন একটা না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে ভূমি অবনমনের কোন ঘটনা জানা নেই। অবশ্য অতি সম্প্রতি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, অগভীর পাম্প বসিয়ে মাটির অন্তর্তল থেকে বালু উত্তোলনের কারণে বগুড়া অঞ্চলে ভূমি অবনমন ঘটছে। বগুড়ার কয়েক স্থানে বিগত দশ বছরে কয়েকটি বৃহৎ পুকুরের সৃষ্টি হয়েছে। নববই দশকের গোড়ার দিকে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে মাটি যতটা দাবছে, ভূ-গাঠনিক উত্থানের (tectonic upliftment) কারণে আবার ততটাই জেগে উঠে একটা সুসমতা বজায় থাকছে। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকার বাড়ি ঘরে ফাটল সৃষ্টি হওয়ার যে খবর পাওয়া যায় তার কারণ হয়ত বিল, ঝিল, জলাভূমি বা পীটের ডোবায় ভূমি বা জৈব পদার্থের অবনমন।

[কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ]