ভট্টাচার্য, আশুতোষ

ভট্টাচার্য, আশুতোষ (১৯০৯-১৯৮৪)  সাহিত্যিক, লোকসংস্কৃতিবিদ। ১৯০৯ সালের ১৭ জানুয়ারি  কিশোরগঞ্জ জেলার ঝালুয়া গ্রামে মাতুলালয়ে তাঁর জন্ম। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল একই জেলার বকজোড়গান্দি গ্রামে। তাঁর পিতা মুরারিমোহন ভট্টাচার্য ছিলেন একজন আইনজীবী।

আশুতোষ বরাবরই একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কিশোরগঞ্জ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (১৯২৬) এবং ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আইএ (১৯২৮) পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  সংস্কৃত ও বাংলায় অনার্সসহ বিএ (১৯৩১) এবং বাংলায় এমএ (১৯৩২) ডিগ্রি লাভ করেন। এখান থেকে তিনি ১৯৫৯ সালে পিএইচডি ডিগ্রিও লাভ করেন।

আসানসোল রেলওয়ে স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে আশুতোষ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি ১৯৩৭ সালে বাংলার লেকচারার হিসেবে যোগদান করে কয়েক বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। ১৯৫৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারার হিসেবে যোগদান করে তিনি পর্যায়ক্রমে রবীন্দ্র অধ্যাপক (১৯৬৭) ও বিভাগীয় প্রধান (১৯৭১) হন এবং ১৯৭৭ সালে অবসর গ্রহণ করেন। মাঝে কয়েক বছর তিনি প্রখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ ভেরিয়ার এলউইনের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট হিসেবে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ায় সাত বছর কাজ করেন। লোকসংস্কৃতি পরিষদ, নিখিলবঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলন ইত্যাদি সম্মেলনে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন এবং আমেরিকা, রাশিয়া ও ইংল্যান্ডসহ পৃথিবীর বহু দেশে  লোকসাহিত্য সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। পুরুলিয়ার ‘ছৌ’ নৃত্যকলাকে তিনিই প্রথম বিশ্বজনসমক্ষে তুলে ধরেন।

একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লোকসংস্কৃতিবিদ হিসেবেই আশুতোষের প্রধান পরিচয়। তিনি মধ্যযুগের বাংলা  মঙ্গলকাব্য এবং আধুনিক যুগের বাংলা নাটকের ইতিহাস রচনা করেও খ্যাতি অর্জন করেন। বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস (১৯৩৯), বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস (১ম ও ২য় খন্ড: ১৯৫৫ ও ১৯৬১) এবং বাংলা সামাজিক নাটকের বিবর্তন (১৯৬৪) তাঁর এ বিষয়ক তিনটি মৌলিক গ্রন্থ। বাংলা লোকসাহিত্য সম্পর্কেও তাঁর একাধিক গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যথা: বাংলার লোকসাহিত্য (৬ খন্ড, ১৯৫৪-১৯৭২), বাংলার লোকশ্রুতি (১৯৬০), বঙ্গীয় লোকসঙ্গীত রত্নাকর (৪ খন্ড ১৯৬৬-৬৭), বাংলার লোকনৃত্য (২ খন্ড ১৯৭৬, ১৯৮২), বাংলার লোকসংস্কৃতি (১৯৭৯), Chhau Dance of Purulia (১৯৭২), The Sun and the Serpentlore of Bengal (১৯৭৭), Folklore of Bengal (১৯৭৮) ইত্যাদি।

আশুতোষ ছৌ-নৃত্যের পুনরুজ্জীবন ও ভূমিজ শিল্পিদের সংগঠিত করে দেশে-বিদেশে এর প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। ‘রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ফোক-কালচার’ (১৯৬০) প্রতিষ্ঠা এবং লোকশ্রুতি (১৯৬৮) পত্রিকা সম্পাদনা করে তিনি  লোকসংস্কৃতি চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। তাঁর মৌলিক ও সম্পাদিত অন্যান্য গ্রন্থ হলো: বাংলার কথাসাহিত্যের ইতিহাস (১৯৬৪), মহাকবি শ্রীমধুসূদন (১৯৬৪), রবীন্দ্র-নাট্যধারা (১৯৬৬), রবীন্দ্রনাথ ও লোকসাহিত্য (১৯৭৩), দ্বিজেন্দ্রলালের প্রহসন (১৯৭৪), বাইশ কবির মনসামঙ্গল বা বাইশা (১৯৫৪), শিবায়ন (১৯৫৬), গোপীচন্দ্রের গান (১৯৫৯), পদ্মাপুরাণ (১৯৭০), কৃত্তিবাসী রামায়ণ (১৯৭৬), কাশীদাসী মহাভারত (১৯৭৬), নটী বিনোদিনী রচনা সমগ্র (১৯৮৭) ইত্যাদি। এ ছাড়াও তিনি কয়েকখানি কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনী রচনা করেন। ভ্রমণকাহিনীর মধ্যে সোভিয়েতে বঙ্গ-সংস্কৃতি (১৯৬৫), পুরুলিয়া থেকে প্যারিস (১৯৭৫), সুন্দরী ইন্দোনেশিয়া (১৯৭৬), ইরান ভ্রমণ (১৯৭৭), অজানা অস্ট্রেলিয়া (১৯৭৮), জাপানের আঙ্গিনায় (১৯৮১), অন্ধকারের আন্দামানে (১৯৮৩) উল্লেখযোগ্য।

আশুতোষ সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরোজিনী বসু স্বর্ণপদক (১৯৫০), শিশিরস্মৃতি স্বর্ণপদক (১৯৬১), কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির বি.সি.এল স্বর্ণপদক (১৯৮৩) এবং দিল্লির সঙ্গীত নাট্য আকাদেমির ফেলোর (১৯৬৭) সম্মাননা লাভ করেন। ১৯৮৪ সালের ১৯ মার্চ কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [মানস মজুমদার]