ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য

ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য  বাংলার উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্নস্থলে মাটির নিচ থেকে ঢালাইকৃত ধাতব ভাস্কর্যের সঞ্চিত ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ভাস্কর্যসমূহ মূলত হিন্দু দেব-দেবীর এবং এগুলির সময় ১১-১২ শতক। দক্ষিণ অঞ্চলের ভাস্কর্যসমূহ প্রধানত বৌদ্ধ দেবদেবীর। এগুলি নির্মিত হয়েছে ৭ম শতক থেকে শুরু করে দীর্ঘকাল ব্যাপী। এসব ভাস্কর্য বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর, ময়নামতী প্রত্নস্থল জাদুঘর প্রভৃতি বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত রয়েছে। কিছু কিছু ভাস্কর্য ভারতীয় জাতীয় জাদুঘর, কলকাতা, আশুতোষ সংগ্রহশালা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা এবং দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। এছাড়া পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্প বাজারে প্রায়শই প্রচুর পরিমাণ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য পরিলক্ষিত হয়। ‘অজানা উৎস’ থেকে সংগৃহীত বলা হলেও এসব ভাস্কর্য সম্ভবত এই গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলেই নির্মিত। এটাও সত্য যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন সরকারি সংগ্রহশালা থেকে অদৃশ্য হওয়া ভাস্কর্যসমূহ পাশ্চাত্যের শিল্প বাজারে স্থান পেয়েছে।

ভাস্কর্যশৈলী ও গঠন  ভাস্কর্যসমূহের ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষিতে বিচারের জন্য যথাযথ রীতিগত বিশ্লেষণ এবং মূর্তিলক্ষণ বৈশিষ্ট্যের মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এ প্রচেষ্টা ভাস্কর্যসমূহের মূর্তিতাত্ত্বিক রূপের পথ সুগম করতে পারে।

ভাস্কর্যসমূহের গঠনে রীতিসম্মত নিয়মকানুন কঠোরভাবে পালন করা হয়। বৈশিষ্ট্যগতভাবে একটি ভাস্কর্যে দেবতা বা দেবী একটি বেদির উপর দন্ডায়মান বা উপবিষ্ট থাকেন এবং তাঁর পেছন দিকে থাকে একটি পৃষ্ঠপট। ভাস্কর্যের এ দুই অংশেই বিভিন্ন প্রকার মূর্তিলক্ষণ চিহ্ন উপস্থাপন করা হয়। এসব চিহ্ন ভাস্কর্যসমূহের প্রতীকীরূপ নির্ণয়ে সহায়তা করে, যেমন একটি পদ্ম বেদির উপরে মূর্তিকে ধারণ করে আবার মূর্তির সামনে থাকে মূর্তির বাহন। আত্মোৎসর্গকারী মানবমূর্তি সামনের দিকে নতজানু হয়ে থাকে। দেবতার আসন বা বেদিকে ব্রহ্মান্ডের সর্বনিম্নস্তর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভাস্কর্যের পৃষ্ঠপটে বিভিন্ন দৈব চিহ্ন থাকতে পারে। পৃষ্ঠপটের প্রান্তদেশে যেন দেবতার শরীর থেকে অগ্নিশিখা জ্বলে ওঠে। পেছনে পদ্মের আকৃতির জ্যোতিশ্চক্র যেন স্বর্গকে উপস্থাপন করে। পাথরের ভাস্কর্যে সাধারণত যে ধরনের চিহ্ন দেখা যায়, ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে সে ধরনের চিহ্ন কম। যেমন পাথরের ভাস্কর্যের মতো ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যে কেন্দ্রীয় মূর্তির সুরক্ষার্থে বিচিত্র ও প্রাণবন্ত প্রাণিমূর্তি কীর্তিমুখ দেখা যায় না। কেন্দ্রীয় দেবমূর্তি সাধারণত দুপাশের সহচরমূর্তির চাইতে দীর্ঘকায় হয়। উভয় মূর্তিই দর্শক অভিমুখী এবং পরম পূজনীয় হয়; কখনও কখনও শিব ও পার্বতীর বিয়ের মতো বর্ণনামূলক দৃশ্য উৎকীর্ণ করা হয়।

চিত্র-১ : বজ্রসত্ত্ব, অষ্টধাতু, ময়নামতি

প্রতিটি অঞ্চলেই কিছু আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। এ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ভাস্কর্যের বিভিন্ন অংশে কোন বিশেষ মোটিফ নির্বাচন ও ব্যবহার, কোন নির্দিষ্ট মাত্রার উপস্থাপন এবং ভাস্কর্য রচনার বিভিন্ন উপাদানের জন্য নির্দিষ্ট অংশের সুষম বণ্টন প্রভৃতি অন্যতম। সময়ের সাথে সাথে বিভিন্ন মোটিফের আকৃতি বদলে যায়। এ পরিবর্তন থেকে ভাস্কর্যসমূহের ক্রমবিবর্তন এবং পরোক্ষ সময় নির্ণয় করা যায়।

চিত্র-২: বিষ্ণু , আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগো

ভাস্কর্যসমূহের নির্মাণকাল এবং নির্মাণের স্থান ছাড়া সঠিক মূর্তিলক্ষণ বৈশিষ্ট্যের চর্চা করা যায় না। অনুরূপভাবে এ চর্চা ছাড়া মূর্তির রীতি-বৈশিষ্ট্য বা মূর্তিতত্ত্ব আলোচনা করা সম্ভব নয়। আদি পর্বের (৭ম-৮ম শতক) একটি বিষ্ণুমূর্তির সঙ্গে ১২ শতকের একটি বিষ্ণুমূর্তির বিস্তর ব্যবধান দেখা যায়। এ সময় অনেক নতুন মোটিফের উদ্ভব হয়েছে। ভাস্কর্য হয়েছে আরও পরিমার্জিত এবং স্বর্গীয় ভাবসম্পন্ন। ভাস্কর্যে আঞ্চলিকতা এবং পারিপার্শ্বিকতার রূপান্তর লক্ষ্য করা যায়।

লালমাই পার্বত্য অঞ্চল এ অঞ্চলের প্রাচীনতম ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যটির প্রাপ্তিস্থান জানা যায়নি। আনুমানিক ৭০০ খ্রিস্টাব্দে রাজা দেব খড়গের স্ত্রী প্রভাবতী এটি দান করেন। কুমিল্লা থেকে প্রাপ্ত এ ভাস্কর্য একটি নতুন রীতির প্রবর্তন করেছে। পরবর্তীকালে ময়নামতী এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এ রীতির প্রচুর ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য নির্মিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার ধাতব ভাস্কর্যের সূচনায় এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ রীতির ভাস্কর্যের বৌদ্ধ প্রত্নস্থলে এবং আসামের কালহিপারার হিন্দু ভাস্কর্যে দেখা যায়। এ নিদর্শনগুলিও এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে। এসব নিদর্শন থেকে এ অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র স্কুলের গুরুত্ব প্রকাশ পায়। এ স্কুলের শিল্প-নৈপুণ্যের চূড়ান্ত পর্যায়ের একটি নিদর্শন বিশালাকৃতির বজ্রসত্ত্ব মূর্তি সম্প্রতি ময়নামতীর উৎখননে আবিষ্কৃত হয়েছে (চিত্র-১)।

চিত্র-৩: বিষ্ণু , ভারতীয় যাদুঘর

অবশেষে একটি নির্দিষ্ট ভাস্কর্যরীতি উদ্ভূত হয় (চিত্র-২)। এ রীতির ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মসৃণ আকৃতি, গোলাকার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, ডিম্বাকার ও পূর্ণমুখমন্ডল, সম্পূর্ণ উন্মিলিত চোখ এবং স্মিত হাস্য মুখ। শরীরের গতি ও সংস্থানে রয়েছে মার্জিত ও সহজভাব যা শান্তি ও সঙ্গতির পরিচয় দেয়। বেশির ভাগ ভাস্কর্যের কতগুলি বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় ভাস্কর্যের বেদিগুলি সাধারণত নিচ্ছিদ্র এবং আয়তাকার হয়। এগুলির উপর ও নিচের প্রান্ত জুড়ে প্রসারিত থাকে সরু আস্তরণ-রেখা। প্রান্তদেশে অগ্নিশিখার অলঙ্করণযুক্ত একটি সমতল গোলাকৃতির পৃষ্ঠপট এতে সংযুক্ত থাকে। সব শেষে একটি তরঙ্গায়িত রেখার সঙ্গে এক সারি পুঁতি-নকশা উৎকীর্ণ থাকে। ওপরের দিকের এই মুকুটে বক্রতা থাকে এবং মাথায় থাকে একটি ছোট্ট কুঁড়ি।

চিত্র-৪: সদাশিব, ফাইন আর্ট মিউজিয়াম অব শিকাগো

ঝেওয়ারি (চট্টগ্রাম জেলা)  চট্টগ্রামের আশে-পাশে বিভিন্ন অঞ্চলে কতগুলি একই বৈশিষ্ট্যের বৌদ্ধ ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে যেগুলির বেশিরভাগই বুদ্ধের মূর্তি। কতগুলি ভাস্কর্যে কোন বেদি বা পৃষ্ঠপট ছাড়াই বুদ্ধকে গদিতে উপবিষ্ট দেখানো হয়েছে। এধরনের ব্রোঞ্জমূর্তি পার্শ্ববর্তী মায়ানমারেও পাওয়া গেছে। এ মূর্তির প্রশস্ত শিরস্ত্রাণ বা উষ্ণীষে অসংখ্য ছোট ছোট চুলের কুন্ডলি থাকে। চোখ লম্বাটে এবং সম্পূর্ণ উন্মিলিত। স্মিত হাস্য মুখ কিছুটা কৌণিক। বাম কাঁধে ঝুলে থাকা পোশাকের ভাঁজ দেখাতে সমান্তরাল রেখা খোদাই করা হয়েছে। কতগুলি সংক্ষিপ্ত অনুভূমিক রেখায় এসে এগুলি শেষ হয়েছে। এ ধরনের অলঙ্করণও মায়ানমারে দেখা গেছে। কতগুলি বুদ্ধমূর্তি অনেক বেশি পরম্পরাগত। এসব মূর্তির লম্বাটে মুখমন্ডল, বাঁকানো ঠোঁট, আচড় কেটে তৈরি ভ্রু এবং সামনের দিকে সমান ও চাপা থাকে। এসব মূর্তিতে একটা ধ্যানমগ্ন হাসি দেখা যায়। আবার কতগুলি ক্ষুদ্রাকৃতির দলবদ্ধ মূর্তিতে লালমাই পাহাড়ের রীতিশৈলী প্রতিফলিত হয়েছে। এগুলিতে হয় একটি বড় পৃষ্ঠপট ও ফুলমালা বেষ্টিত ছত্র অথবা অগ্নিশিখা ও বক্ররেখায় সজ্জিত বড় গোলাকার জ্যোতিশ্চক্র থাকে।

চিত্র-৫: অবলোকিতেশ্বর, বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর

বিক্রমপুর  এ অঞ্চলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধাতব ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। সেগুলির মধ্যে রয়েছে একটি বিষ্ণুর রৌপ্যমূর্তি। এটি ১২ শতকের অন্যতম সেরা প্রত্ননির্দশন (চিত্র-৩)। লালমাই পার্বত্য অঞ্চলের ভাস্কর্যসমূহ অনেক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে নির্মিত হলেও এ মূর্তির গঠনরীতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে আগেরগুলির সাদৃশ্য দেখা যায়। যেমন উঁচু বেদিমূল উভয়ক্ষেত্রেই একই ধরনের। তবে পেছনের আন্তরণ-রেখাগুলি গভীর এবং সমতল যা এখন কুলুঙ্গিতে সংযোজিত। পৃষ্ঠপটটি পেছন দিকে খোলা। এখনও একটি সমান ও প্রশস্ত খিলান দ্বারা সংরক্ষিত। খিলানটির প্রান্তদেশের বহির্ভাগ ও অভ্যন্তরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা এবং মাথায় একটি বড় আকৃতির কীর্তিমুখ আছে। দেবতার শরীর জাঁকালো অলঙ্কারে ভূষিত। তাদের মাথায় অতিক্রান্ত উঁচু মুকুট। প্রত্যেকটি মূর্তি গোলাকার করে নির্মিত। এ ধাতব ভাস্কর্যসমূহে দেবতাদের মধ্যে স্বর্গীয় প্রাচুর্যের প্রকাশ পেয়েছে। তাই লালমাই অঞ্চলের অনাড়ম্বর ভাস্কর্যের সঙ্গে এর পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ব্রোঞ্জের আদি মূর্তিগুলির সঙ্গে এ অঞ্চলে নির্মিত শিবের অনেকগুলি মূর্তি পাওয়া গেছে, যেমন তামিলনাড়ুর চিদাম্বরম্ মন্দিরে পূজিত সম্ভবত কোন রাজগুরুর নিয়ে আসা শিবের নটরাজ মূর্তি (চিত্র-৪)। এসব মূর্তিতে রীতি-বৈশিষ্ট্য মানা হয়নি যা তাদের এ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারে। যদিও সময়ের দিক থেকে এগুলি বিষ্ণুর চেয়েও প্রাচীন।

চিত্র-৬: বৈষ্ণবত্রয়ী, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

উত্তরবঙ্গের বৌদ্ধ প্রত্নস্থল  পাহাড়পুর বা মহাস্থানগড়ের মতো প্রত্নস্থলে ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের উল্লেখযোগ্য কোন সঞ্চিত ভান্ডার আবিষ্কৃত না হলেও উত্তরবঙ্গ থেকে হিন্দু ও জৈন ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন মূর্তি-লক্ষণ এবং বিভিন্ন যুগের ভাস্কর্য সংগৃহীত হয়েছে। তুলনামূলকভাবে দুষ্প্রাপ্যতার কারণে এ অঞ্চলের ভাস্কর্যের রীতিশৈলী নির্ধারণ সম্ভব নয়। তাই দক্ষিণ বঙ্গের সঙ্গে এ অঞ্চলের ভাস্কর্যে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন অবস্থা লক্ষ্য করা যায়। যদিও কিছু বড় আকৃতির ব্রোঞ্জমূর্তি প্রাপ্তি থেকে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এ অঞ্চলের শিল্পশালাসমূহে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভাস্কর্য ঢালাই সম্ভব ছিল। উদাহরণস্বরূপ মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত গিলটি করা বোধিসত্ত্ব (চিত্র-৫) অথবা পাহাড়পুরে প্রাপ্ত অপূর্ণাঙ্গ বুদ্ধমূর্তির (চিত্র-৯) কথা উল্লেখ করা যায়। উভয় মূর্তিতেই চমৎকার শিল্পনৈপুণ্য এবং দেহের নমনীয়তার নির্ভুল উপলব্ধি ও বাহ্যিক মসৃণতা প্রতিফলিত হয়েছে। উভয় মূর্তিতেই সারনাথ এবং বিহারের অন্যান্য বৌদ্ধ মূর্তির রীতি-শৈলীর সাদৃশ্য সুষ্পষ্ট।

চিত্র-৭: মনসা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর

উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুভাস্কর্য  হিন্দু ভাস্কর্যের কিছু নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিক্ষিপ্ত অঞ্চলের সঞ্চিত ভান্ডার থেকে। রংপুর জেলার সাহেবগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি, রাজশাহী জেলার মান্দইল বা নিমদিঘি প্রভৃতি এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এসবের মধ্যে কোন কোন ব্রোঞ্জমূর্তি বড় আকৃতির (চিত্র-৮))। এ মূর্তিসমূহ ১০ ও ১১ শতকের। এসব মূর্তিতে এক ধরনের রীতিশৈলীর প্রকাশ দেখা যায় যা তাদের দক্ষিণ অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য থেকে স্বতন্ত্র করেছে। যেমন উভয়ক্ষেত্রেই ভাস্কর্যের বেদিমূল একই ধরনের মনে হলেও দক্ষিণ অঞ্চলের ভাস্কর্যের বেদিমূল একটির উপর একটি আস্তরণ-রেখার উপরিস্থাপনের মাধ্যমে নির্মিত হয়। আর এ অঞ্চলে মূর্তি পায়ের উপর ধারণ করা হয়। বিহারের ব্রোঞ্জ  মূর্তিসমূহ এ ধরনের। আবার পৃষ্ঠপট উভয়ক্ষেত্রেই অলঙ্কৃত হলেও তার উপাদানসমূহ সম্পূর্ণরূপে আলাদা।

চিত্র-৮: মঞ্জুশ্রী , ব্রোঞ্জ , মহাস্থানগড়

ভাস্কর্যরচনায় ভারসাম্য থাকলেও অলঙ্করণের ক্ষেত্রে অবনত ভাব রয়েছে (চিত্র-৬ ও ৭)। পৃষ্ঠপটের সঙ্গে সাধারণত পাতলা লম্বাটে পদ্মপাঁপড়ির আকৃতিবিশিষ্ট জ্যোতিশ্চক্র সংযুক্ত থাকে। এর শীর্ষবিন্দুতে একটি ত্রিকোণাকৃতির অলকৃত মুকুট থাকে (সাহেবগঞ্জের ব্রোঞ্জমূর্তি)। এ অলঙ্কারকে সম্ভবত ছাতার বিকল্প মনে করা হয় যা মূর্তিকে রক্ষা করে (মান্দইল ব্রোঞ্জমূতি)। বেদিমূল একটির উপর একটি আস্তরণ রেখার উপরিস্থাপন এবং দু’পায়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়। প্রতিটি কুলুঙ্গি থেকে সাধারণত নিচের দিকে ঝুলন্ত কৌণিক অলঙ্করণ থাকে।

চিত্র-৯: বুদ্ধ , ব্রোঞ্জ , পাহাড়পুর

১০ ও ১১ শতকের ভাস্কর্যে দেহভঙ্গিমা এবং পরম্পরা দেখা যায়, কিন্তু পরবর্তীকালে ১২ শতকের ভাস্কর্যে ত্রিমাত্রিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ দিনাজপুরের হাটপুকুরি থেকে সংগৃহীত ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের কথা বলা যায়। সেখানকার তিনটি মূর্তিই বিভিন্ন ভঙ্গিতে দন্ডায়মান (চিত্র-৬)। এ ভঙ্গি তাদের নমনীয়তা এবং গতিময়ভাব রচনার সূচনা করে।   পৃষ্ঠপটটিও এক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে বড়, যা ১১ শতকের ভাস্কর্য এবং শেষ পর্বের ধাতব ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য। অলঙ্করণের ভারঅবনত ভাব যা সমকালীন অলঙ্করণ বৈশিষ্ট্যের পরিচয় বহন করে (চিত্র- ৩ ও ৬)।  [ক্লোডিন বাউৎজে পিকরণ]

গ্রন্থপঞ্জি Sisir Kumar Mitra, (ed), East Indian Bronzes, Calcutta University, Calcutta, 1979; Debala Mitra, Bronzes from Bangladesh: A study of Buddhist Images from District Chittagong, Delhi, 1982; Nihar Ranjan Ray, Karl Khandalavala and Sadashiv Gorakshkar, Eastern Indian Bronzes, Lalit Kala Akademi, New Delhi, 1986; Asok K Bhattacharya, Jhewari Bronze Buddhas, A Study in History and Style, Indian Museum, Calcutta, 1989.