ব্যাধিগ্রস্ততা

ব্যাধিগ্রস্ততা (Morbidity)  সাধারণভাবে ব্যাধিগ্রস্ততা বা মরবিডিটি বলতে মানুষের ভিতরে বিদ্যমান যে কোন রোগের পরিস্থিতি বোঝায়। অত্যধিক জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার তিন-পঞ্চমাংশ হচ্ছে মা ও শিশু। জনসংখ্যার এই অংশের মধ্যেই রোগব্যাধি এবং মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, যদিও অনেক রোগই সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলির তুলনায় বাংলাদেশে প্রসূতি মা ও শিশুমৃত্যুর আনুপাতিক হার অনেক বেশি। নানাবিধ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক অবস্থা, দেশে বিদ্যমান স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা ইত্যাদি মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং পুষ্টিজনিত অবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অধিকন্তু, কম বয়সে বিয়ে এবং অধিক সন্তান জন্মদানের ফলে মহিলারা খুব তাড়াতাড়ি মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, যা পরিণামে তাদের স্বাস্থ্যের চরম অবনতি ঘটায়। এ দেশে অধিকাংশ মহিলাই খুব সামান্য স্বাস্থ্য-সহায়তা পান, কিংবা মোটেই পান না। এমনকি গুরুতর কোন ঘটনা ব্যতীত সাধারণভাবে মৃত্যুর কারণ উদঘাটনের জন্য ময়না তদন্তের ব্যবস্থাও নেই। রোগ বা মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করা হয় বিকল্প তথ্যসূত্র বা মৌখিক জিজ্ঞাসাবাদ, অর্থাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনার পরবর্তী ফলাফলের বিবরণ থেকে।

বাংলাদেশে রোগব্যাধির অবস্থা নির্ভর করে জনসংখ্যার বয়স, লিঙ্গ এবং গ্রাম/শহরে তাদের অবস্থানভেদে। ছেলে শিশুর রুগ্নতার হার মেয়ে শিশুর চেয়ে কিছুটা বেশি। তবে সন্তান ধারণক্ষম মহিলাদের ক্ষেত্রে রুগ্নতার হার সবচেয়ে বেশি। শিশুদের মধ্যে (ছেলে ও মেয়ে) ১-৪ বছর বয়সীদের রগ্নতার হার প্রতি ১,০০০-এ ২০০ জন এবং ৫-১৪ বছর বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে ৮৬ জন। আবার ১৫-২৯ বছর বয়সের ছেলেদের ক্ষেত্রে রুগ্নতার হার প্রতি ১,০০০-এ ৯০ জন এবং মেয়েদের মধ্যে ১৩৫ জন। ৩০-৪৯ বছর বয়সের পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা যথাক্রমে ১৬২ এবং ২১৬। ৫০-৫৯ বছর বয়সের পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি যথাক্রমে ২২০ এবং ৩০৭। সন্তান জন্মদানের সময় প্রতি এক লক্ষ প্রসূতির মধ্যে প্রায় ৪৫০ জন রোগাক্রান্ত হয়। এই হার ১৫-১৯ বছর বয়সী প্রসূতিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রজনন বয়সের প্রায় ৪০ শতাংশ মহিলা নানা ধরনের দীর্ঘস্থায়ী এবং অজানা রোগে ভোগে। গ্রাম ও শহর উভয় স্থানেই মহিলাদের মধ্যে রুগ্নতার হার বেশি। তবে, অধিকাংশ মহিলাই তাদের অসুস্থতার কথা সাধারণত প্রকাশ করেন না।

বাংলাদেশে সচরাচর সংক্রমিত রোগসমূহের মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, আমাশয়, কৃমি সংক্রমণ, হাম, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, ধনুষ্টঙ্কার, ফুসফুসের যক্ষ্মা, পোলিও, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, জন্ডিস, টাইফয়েড, অজীর্ণ/পাকস্থলীর প্রদাহ রোগ, ম্যালেরিয়া, মেনিনজাইটিস, জলাতঙ্ক, চোখের রোগ, পেপটিক আলসার, সাধারণ সর্দি ও চর্মরোগ প্রভৃতি। পুড়ে যাওয়া এবং অন্যান্য আঘাতেও মানুষ অসুস্থ হয়। হূদরোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল রোগই গ্রামের সহায়-সম্বলহীন নিঃস্ব পরিবারগুলির মধ্যে অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। সাধারণ রোগব্যাধি ছাড়াও মহিলারা গর্ভজনিত রোগে ভুগে থাকে। অনেক মহিলাই নানা ধরনের জরায়ুর রোগ এবং প্রজননস্বাস্থ্য সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত হয়। নিঃস্ব পরিবারগুলির মহিলাদের মধ্যে প্রতি এক হাজারে ১৩ জন মহিলা গর্ভজনিত রোগে ভোগে। পরিণত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ পুরোপুরি ভিন্ন রকমের। বয়স্কদের ক্ষেত্রে রোগের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। অজীর্ণ রোগ, পেপটিক ও গ্যাসট্রিক আলসার, জ্বর প্রভৃতি রোগে বয়স্করা, বিশেষ করে মহিলারা বেশি আক্রান্ত হয়। ১৫-৪৯ বছর বয়সের পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ এবং হূদরোগের হার কম দেখা যায়। হরমোনঘটিত কারণেই এই তারতম্য হয়ে থাকে। রক্তচাপ ও হূদরোগ, হাঁপানি, শ্বাসযন্ত্রের রোগ, নিউমোনিয়া ও যক্ষ্মায় মহিলারা কম আক্রান্ত হয়। পুরুষ ও মহিলাদের বার্ধক্যজনিত সাধারণ রোগের মধ্যে রয়েছে বাতজ্বর, হাঁপানি, আলসার, জ্বর এবং শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ। শহর এলাকার মানুষের রোগের ধরন কিছুটা পৃথক। জলবসন্ত, ভাইরাস জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হূদরোগ প্রভৃতির প্রকোপ শহরাঞ্চলে অধিক মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। যথাসময়ে সঠিক পরিচর্যা ও চিকিৎসার অভাবে রোগগুলি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধি ও বিকলাঙ্গতা ঘটায়, এমনকি মৃত্যুও ঘটিয়ে থাকে। শহরে বসবাসরত ৩,৪৭,১৫০ জন লোকের ওপর পরিচালিত এক সাম্প্রতিক জরিপ থেকে দেখা যায় যে, এই লোকগুলির ৪,৪৪৭ জন রোগ-প্রতিবন্ধী যার মধ্যে ২,৪৫৬ জন পুরুষ এবং ১,৯৯১ জন মহিলা।

বাংলাদেশে পুরুষ জনসংখ্যার প্রতি ১০,০০০ জনের মধ্যে ৬৯ জন রাতকানা রোগে ভোগে। এর কারণ সুষম এবং ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা। এদের মধ্যে ১০,০০০-এ ১০ জন অন্ধ। একই কারণে রাতকানা মহিলার সংখ্যা প্রতি ১০,০০০-এ ৭২ জন এবং অন্ধ মহিলার সংখ্যা ১০,০০০-এ ২১ জন। ব্যাপক ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে বেশ কয়েক বছর দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা যায়নি। কিন্তু ১৯৯০ সালের প্রথম দিক থেকে আবার ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং সে সময় অনেক লোক এ রোগে মারা যায়। ১৯৯৬ সাল থেকে এ রোগের প্রকোপ কমে আসে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগটি কয়েকটি এলাকার মধ্যেই সীমিত থাকে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও টেকনাফ ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৯৬ সালে দেশে কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০,০০০। কার্যকর প্রতিরোধ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তরুণদের মধ্যে যক্ষ্মার সংক্রমণ যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে, তবে বৃদ্ধদের, বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে এখনও এ রোগ দেখা যায়। আয়োডিনের অপর্যাপ্ততা এবং জমিতে পুষ্টি পরিপোষক পদার্থের অভাবজনিত কারণে দেশের সমগ্র জনসংখ্যাই গলগন্ড রোগের হুমকির মুখে উপনীত। ১৯৯৩ সালে ৫-১১ বছর বয়সের প্রায় ৫০% এর মধ্যে গলগন্ড রোগের লক্ষণ দেখা যায়। আয়োডিন স্বল্পতার কারণে ১.৮ মিলিয়ন লোকের মধ্যে মানসিক বৈকল্য দেখা দেয় যা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞাত রয়ে গেছে।

কয়েক বছর যাবৎ দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই জ্বর মহামারীর রূপ ধারণ করে এবং এতে বহুসংখ্যক লোকের প্রাণহানি ঘটে। সাম্প্রতিক সময়ের উদ্বেগজনক কয়েকটি রোগের মধ্যে রয়েছে জননাঙ্গের সংক্রমণ এবং যৌনরোগ, যার অন্তর্ভুক্ত এইচআইভি এবং এইডস। রক্তের সিরাম-সংক্রান্ত জরিপ থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে এইচআইভি/এইডস-এর সংখ্যা কম। রোগনির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষার সুযোগ-সুবিধা এখানে খুবই কম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের (BSMMU) ভায়রোলজি বিভাগ এবং আইসিডিডিআরবি-তে উক্ত রোগগুলির পরীক্ষাদি সম্পন্ন হয়। BSMMU-এর হিসাব অনুযায়ী ১৯৯৬ সালে এ হাসপাতালে ৭৯ জন এইচআইভি পজিটিভ রোগী পাওয়া যায়। তবে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের হিসাবমতে ১৯৯৬ সালে দেশে প্রায় ২০,০০০ জনের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ ঘটে। কিন্তু ২০০৭ সালে জাতিসংঘের একটি যৌথ পরিসংখ্যানে বলা হয় বাংলাদেশে প্রায় ১২,০০০ জন এইচআইভি রোগে আক্রান্ত রোগী রয়েছে।   [মোঃ শাহাদাত হোসেন]