বোনাজ

বোনাজ  বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী। এদের আদি নিবাস ভারতের উড়িষ্যা রাজ্য। ব্রিটিশ শাসনামলে বোনাজরা চা-শ্রমিক হিসাবে সিলেট জেলায় আসে। ধীরে ধীরে এদেশে তারা স্থায়ী বসত গড়ে তোলে। বোনাজদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার এবং তাদের অধিকাংশই মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানাধীন বিভিন্ন চা বাগানে চা-শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত।

বোনাজরা কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত। যেমন- নাগ, খান্ডা, টনিডিয়া, দুধুষা, রক্ত কুশিলা, সূর্যবংশ, বাঘাবংশ এবং মহানন্দিয়া। বোনাজ সমাজে নিজ গোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ। বিবাহের ক্ষেত্রে একবিবাহ প্রথা স্বীকৃত। বাল্যবিবাহ বোনাজ সমাজে এখন অপ্রচলিত। ছেলের বয়স বিশ এবং মেয়ের বয়স ষোল বছর অতিক্রম করলে বিয়ের উপযুক্ত বলে গণ্য করা হয়। মা বাবা অথবা অভিভাবকরাই বিয়ের প্রস্তাব আদানপ্রদান করে ও বিয়ের যাবতীয় প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে। বোনাজ জনগোষ্ঠী মঙ্গলাচরণ, মূল বিবাহ, কাপড়কাঁচা ইত্যাদি বিবাহ অনুষ্ঠান পালন করে। সধবা বোনাজ মহিলারা সিঁথিতে সিঁধুর ও হাতে শাঁখা করে। সমাজে কন্যাপণ এবং যৌতুক প্রথা চালু রয়েছে। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথা রয়েছে।

বোনাজ সমাজ পিতৃপ্রধান। ছেলেরা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। বিয়ের পর কনে নিয়ে বর পিতৃগৃহে বসবাস করে। যে কোনো সামাজিক এবং পারিবারিক বিচারকাজ সমাজ কাউন্সিলের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। সমাজ কাউন্সিলের প্রধানকে বলে বেহেড়া। বিচারের শাস্তি হিসেবে রয়েছে সমাজচ্যুতি বা অর্থদন্ড। সামাজিকভাবে ভোজের আয়োজন করে শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

তবে অনেক প্রবীণ বোনাজ নিজেদের ঐতিহ্যগত উড়িয়া ভাষায় কথা বলে। বোনাজ সমাজে শিক্ষার হার খুবই কম। বর্তমানে মাত্র শতকরা দশ জনের মতো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বোনাজরা আমিষভোজী।

ধর্মবিশ্বাসে বোনাজরা হিন্দু। হিন্দুধর্মের পাশাপাশি তারা তাদের সনাতনধর্ম পালন করে। লক্ষ্মীদেবী এবং মঙ্গলচন্ডীকে তারা তাদের পারিবারিক দেবী হিসাবে উপাসনা করে। এসব দেবীর পাশাপাশি তারা দুর্গা, কালী প্রভৃতি দেবীর পূজা করে থাকে। পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক সম্পর্কে তাদের বিশ্বাস রয়েছে। তারা পুনর্জন্মেও বিশ্বাসী। তারা তীর্থ ভ্রমণকে ধর্মের একটি অঙ্গ হিসেবে মনে করে। ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে দুর্গোৎসব, ফাগুয়া প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বোনাজ সম্প্রদায় মৃতদেহ দাহ করে। মৃত ব্যক্তির জ্যেষ্ঠ পুত্র অথবা তার অবর্তমানে অন্য কোনো পুত্র মুখাগ্নি করে। মৃত ব্যক্তির নিকট আত্মীয়েরা দশদিন অশৌচকাল পালন করে। একাদশ দিনে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালিত হয়। বোনাজ সমাজে মৃত ব্যক্তির পিন্ডদান বাধ্যতামূলক।

মুখ সাহিত্যে বোনাজ সমাজ খুবই সমৃদ্ধ। বোনাজরা গল্পকাহিনী, লোকগাঁথা বংশ পরম্পরায় সংরক্ষণ করে এবং বিভিন্ন সামাজিক উৎসবে তারা এসব লোকগাঁথা, লোকগল্প পরিবেশন করে বিশেষ আনন্দ পায়। বিভিন্ন উৎসবে নাচগান করাও বোনাজ সমাজের বৈশিষ্ট্য।  [সুভাষ জেংচাম]