বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর

বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট ইংল্যান্ড প্রথম মহাযুদ্ধে যোগ দিলে ব্রিটিশ ভারতীয় সরকারের প্রণোদনায় বাংলার স্থানীয় রাজা-মহারাজা, নবাব, জমিদার এবং বিশিষ্ট নেতৃবর্গ ১৪ আগস্ট কলকাতা টাউন হলে এক সভায় মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, তাঁরা অর্থ, দ্রব্যসামগ্রী, লোকবল ইত্যাদি দিয়ে ইংল্যান্ডকে যুদ্ধে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। এ সভায় প্রাথমিকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে একটি চিকিৎসা দল প্রেরণের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ২০ আগস্ট ভারতের ভাইসরয় বাঙালিদের নিয়ে একটি চিকিৎসা দল বা বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠনের জন্য বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চাঁদ মাহতাব এবং বেঙ্গল মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা এস পি সর্বাধিকারী মুখ্য ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আগস্ট মাসের মধ্যেই প্রশিক্ষণ শেষ করে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ অসম্ভব বিধায় উদ্যোগটি সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়।

১৯১৪ সালের অক্টোবর মাসের প্রথমদিকে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর কমিটির প্রতিনিধিরা কলকাতা ফোর্ট উইলিয়মে সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি সৈন্য নিয়োগের বিষয়ে নতুনভাবে আলোচনা শুরু করেন। প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে বাংলাদেশ থেকে ১৫ জন ডাক্তার এবং ১৭৫ জন কম্পাউন্ডার, ড্রেসার, স্ট্রেচার বিয়ারার নিয়ে একটি চিকিৎসাসেবা দল গঠন করা হবে। ১৯১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বাঙালিদের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রথম ইউনিট তথা ওরিভার অ্যাম্বুলেন্স গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। এ রিভার অ্যাম্বুলেন্স মেসোপটেমিয়ার শাতিল আরব নদীতে পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। প্রস্তাবিত জনবল কমিয়ে ১০০ জনে নামিয়ে আনা হয়। ৬ মার্চ ভাইসরয় রিভার অ্যাম্বুলেন্স গঠনের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। রিভার অ্যাম্বুলেন্সের অধিনায়ক হিসেবে যোগ দেন লে. কর্নেল এ এইচ নট।

বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি এ কোরের জন্য একটি ভাসমান হাসপাতাল তৈরি করা হয়। এর নামকরণ হয় ‘বেঙ্গলি’। অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা রেলযোগে রওনা দেয়ার পূর্বে ‘বেঙ্গলি’ কলকাতা থেকে সমুদ্রপথে মেসোপটেমিয়া অভিমুখে যাত্রা করে। কিন্তু দুর্যোগ কবলিত হয়ে মাদ্রাজের কাছাকাছি এসে ১৭ মে ‘বেঙ্গলি’ সমুদ্রে ডুবে যায়।

মে মাসের শেষের দিকে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর মেসোপটেমিয়ায় ‘স্টেশনারি হাসপাতাল’ চালু করবে। এ জন্য বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের ৭৭ জন অফিসার ও অন্যান্য পদবীর সৈনিক এবং ৪১ জন চিকিৎসাকর্মী কলকাতা থেকে ইরাকের আমারা শহরে পৌঁছে। ১৭ জুলাই থেকে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতাল চালু করে। এ হাসপাতাল ১৯১৬ সালের ৩১ মে পর্যন্ত চালু থাকে। প্রায় ১১ মাসের দায়িত্বকালে বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতালে ৭৯২২ জন সামরিক রোগী চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। এ সকল রোগী ছাড়াও প্রতিদিন প্রায় ২০০ জন বেসামরিক বা স্থানীয় রোগীদের হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতালের কর্মকান্ড ও উন্নত সেবা প্রদানের জন্য বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর সর্বত্র প্রশংসিত হয়। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ড (১৯১৬-১৯২১) সদ্য বিলুপ্ত বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতাল এবং এ দলের উদ্যোক্তাদের প্রশংসা করেন।

যুদ্ধের ময়দানে সেবা প্রদানে আগ্রহী বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বেঙ্গল স্টেশনারি হাসপাতালের ৩৭ জন সদস্যকে  হাবিলদার এ সি চম্পটির নেতৃত্বে ২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স বাগদাদ দখলের জন্য ১৯১৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর কূত আল আমারার উদ্দ্যেশ্যে রওনা হয়। কূত দখলের পর ২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্স বাগদাদ অভিমুখে রওনা হয়। কূত থেকে বাগদাদের পথে টেসিফোন এলাকায় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের একজন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফেরত পাঠানো হয়। টেসিফোন এলাকায় পৌঁছানোর পর ব্রিটিশ বাহিনী তুর্কী বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। ব্রিটিশ বাহিনী এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কূতে ফিরে আসে। ফেরার সময় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের  ৬ জন অসুস্থ সদস্য তুর্কীদের হাতে বন্দী হয়। কূতে পৌঁছার পর অ্যাম্বুলেন্স কোরের ১২ জন সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের কূত থেকে ফেরত পাঠানো হয়। বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের বাকি ১৮ জন সদস্য ২ ফিল্ড অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য কূতে থেকে যায়। তুর্কী বাহিনী কূত অবরোধ করে রাখে এবং ১৯১৬ সালের ২৯ এপ্রিল ব্রিটিশ বাহিনী তুর্কী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। একজন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর সদস্য অসুস্থ থাকায় আত্মসমর্পণের পরপরই তাকে ছেড়ে দেয়া হয় এবং বাকি ১৭ জনকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে তুর্কীরা বাগদাদ নিয়ে যায়। ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৮ জন বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর সদস্য বন্দি বিনিময়ের মাধ্যমে ছাড়া পায়, বাকি যুদ্ধবন্দিরা যুদ্ধ বিরতির (১১ নভেম্বর ১৯১৮) পর মুক্তি পায়।

বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর গঠন ও পরিচালনার  সিংহভাগ ব্যয় বাংলার জনগণই বহন করে। সরকার থেকে শুধু অস্ত্র, রেশন ও পরিবহণ খরচ দেয়া হয়। সৈনিকের বেতন-ভাতা, পোশাকসহ প্রায় সব ধরনের ব্যয় বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোর কমিটির সংগৃহীত চাঁদা থেকে নির্বাহ করা হয়। ভাসমান হাসপাতাল ‘বেঙ্গলি’ ক্রয় করার অর্থও কোর কমিটি বহন করে। এ কাজে কোর কমিটি প্রায় তিন লক্ষ টাকা চাঁদা ও অনুদান সংগ্রহ করে। টেসিফোনের যুদ্ধ এবং কূতের অবরোধে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্যরা যে বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দেন এর জন্য কেউ কেউ সরকারি স্বীকৃতি পান। তাদের সার্বিক কর্মকান্ড নিয়ে জিওসি জেনারেল টাউন্ডশেন্ড  বলেন, ‘মসীজীবী বাঙালি যে সৈনিকের কাজের সম্পূর্ণ উপযুক্ত এ প্রমাণ তারা দিয়েছেন।’  [মুহাম্মদ লুৎফুল হক]