বিশ্ব উষ্ণায়ন

বিশ্ব উষ্ণায়ন (Global Warming)  বর্তমান বিশ্বে পরিবেশগত প্রধান সমস্যাসমূহের অন্যতম। এটি জলবায়ুগত এমন এক পরিবর্তন আসন্ন করছে, যা প্রক্রিয়াগতভাবে গ্রিনহাউজ প্রভাবের সাথে তুলনীয়। সমস্যাটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি এজন্য যে, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের রাসায়নিক গঠনটি একশত বৎসর পূর্বের অবস্থা থেকে ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে বর্তমানের প্রযুক্তিগত অর্জনের মাধ্যমে নিকট ভবিষ্যতে এই পরিবর্তিত অবস্থাকে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। একশত বৎসর পূর্বের গড় তাপমাত্রার তুলনায় বর্তমান বিশ্বে গড় তাপমাত্রা প্রায় ০.৬০°সে বৃদ্ধি পেয়েছে। কম্পিউটার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ুগত পরিবর্তন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, ২১ শতকের সমাপ্তিকালের মধ্যে বিশ্ব তাপমাত্রায় আরও অতিরিক্ত ২.৫° থেকে ৫.৫°সে তাপমাত্রা যুক্ত হতে পারে। ফলে, পৃথিবীপৃষ্ঠের পানির স্ফীতি, অত্যুচ্চ পর্বতের বরফশীর্ষ এবং মেরু অঞ্চলের হিমবাহের দ্রুত গলনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতার ক্ষেত্রে একটি বৃহৎ পরিবর্তন ঘটতে পারে।

বিশ লক্ষ বৎসর পূর্বে পৃথিবীর তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। সে সময় থেকে পৃথিবী হিমযুগ-আন্তঃহিমযুগ-হিমযুগ এই চক্রের মধ্য দিয়ে এগিয়েছে। প্লাইসটোসিন যুগের এই একটি হিমযুগ থেকে আর একটি হিমযুগীয় চক্রের মধ্যে দোলায়মানতার কারণ হলো সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর কক্ষপথের ভিন্নতা এবং পৃথিবীর তির্যক হয়ে আবর্তনের সঙ্গে সূর্যের সম্পর্কের বিষয়টি। হিমযুগ থেকে আন্তঃহিমযুগ অতিক্রম করে আরেকটি হিমযুগের সূত্রপাতের এই চক্রটির আবর্তন ঘটে প্রায় প্রতি ১ লক্ষ বৎসর পরে। হিমযুগে পৃথিবীর তাপমাত্রা পরবর্তী হিমযুগের অন্তর্বতী সময়ের তাপমাত্রার তুলনায় ৪° থেকে ৫°সে কম ছিল। সর্বশেষ হিমযুগটির সমাপ্তি ঘটে প্রায় ১০ হাজার বছর পূর্বে এবং এর ফলে মহাদেশীয় হিমবাহের পশ্চাদপসরণ ঘটে। গত ১০ হাজার বছর সময়ে বিশ্বের তাপমাত্রা ২°সে-এর অধিক উঠানামা করে নি।

সাম্প্রতিক বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় বায়ুমন্ডলে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট গ্রিনহাউজ গ্যাসসমূহের উপস্থিতির মাত্রার উত্তরোত্তর বৃদ্ধিকে। বায়ুমন্ডলীয় এই গ্যাসসমূহ হ্রস্বতরঙ্গের সৌর রশ্মির পৃথিবীতে পৌঁছতে বাধার সৃষ্টি করে না, অথচ দীর্ঘতরঙ্গের অবলোহিত বিকিরণ পৃথিবী থেকে বহির্বিশ্বমন্ডলে যেতে বাধার সৃষ্টি করে, যার ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠ উষ্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাসগুলি হলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন এবং বায়ুমন্ডলের জলীয়বাষ্প। শিল্পায়ন, কৃষি সম্প্রসারণ, বিশেষত আর্দ্র ধান চাষ, স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের সংখ্যাগত বৃদ্ধি, বনাঞ্চল উজাড় হওয়া- এ সবগুলিই প্রথম চারটি গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধিতে তাৎপর্যময় ভূমিকা রাখে।

জলবায়ুগত পরিবর্তন  বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশে জলবায়ুগত পরিবর্তন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার পরিবর্তন এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ও বণ্টনের ধরনে পরিবর্তন সংঘটিত হতে পারে বলে বিজ্ঞানিগণ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় সাধারণ আবর্তন মডেলসমূহ ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রার পরিবর্তনের পরিসীমাটি হবে ১.৫° থেকে ৪.৫° সেলসিয়াস। অবশ্য তখন থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তঃসরকারি পর্ষদের মাধ্যমে একটি নিম্নগামী পর্যালোচনায় ধারণা করা হয় যে, ২০০০ সালের মধ্যে এই পরিবর্তনের মাত্রার পরিসীমা ৩.৩° সেলসিয়াস। এই নিম্নগামী পর্যালোচনা বায়ুমন্ডলের স্ট্রাটোসফেয়ারের ওজোন স্তর হ্রাস এবং বায়ুমন্ডলে সালফেট এরোসলের উপস্থিতির ফলে বায়ুস্তর শীতল হওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় এনেছে।

বিগত ১০০ বৎসরে তাপমাত্রা ০.৫°সে বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু পরবর্তী ৫০ বৎসরে, অর্থাৎ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে তাপমাত্রা ১.৫°-২.০° সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে এমন ধারণা করা হয়। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী পানিচক্রের তীব্রতার বৃদ্ধি ঘটে এবং বাষ্পীভবনের হার ১২% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। পর্যায়ক্রমে তা বিশ্বব্যাপী অধঃক্ষেপণ (বৃষ্টিপাত, তুষারপাত, শিশিরপাত ইত্যাদি)-এর মাত্রা বৃদ্ধি করবে। এক্ষেত্রে অধঃক্ষেপণের পরিমাণগত দিক থেকে আঞ্চলিক বিভিন্নতা থাকতে পারে, তবে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাবে। আইপিসিসি উদ্ভাবিত জলবায়ু মডেল নির্দেশ করছে যে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ অধিক বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হবে। বাংলাদেশ প্রায়শই ধ্বংসাত্মক বন্যা কবলিত হয়। গত দুই দশকের মধ্যে ব্যাপক বন্যার ঘটনা ঘটে ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালে। এসব বন্যায় দেশের অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে এবং শস্যক্ষেত্রের ফসল বিনষ্ট হয়। এসময়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও মারাত্মক করে তোলে।

বিজ্ঞানিগণ আরও আশঙ্কা করছেন যে, বিশ্ব উষ্ণায়ন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়সমূহের সংখ্যা এবং প্রচন্ডতা বৃদ্ধি করবে। ২৭° সেলসিয়াসের অধিক সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির সহায়ক। বিশ্ব উষ্ণায়ন বর্তমান সময়ের চেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি করবে, ফলে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতাও অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ বরাবর সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় কবলিত হয়ে আসছে। ১৯৯১ সালে এরূপ এক ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হানলে ১,৫০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় এবং এই আকস্মিক দুর্যোগ পশুসম্পদ ও অন্যান্য সম্পদের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। একটি উষ্ণতর জলবায়ু বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে এ ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের প্রকোপ আরও বৃদ্ধি করবে এবং তাতে দেশের উন্নয়ন প্রচেষ্টা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন  স্থানীয় পর্যায়ে প্রতিটি এলাকায় জোয়ারভাটা, বায়ুমন্ডলীয় চাপ এবং বাতাসের বেগের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের অবিরাম পরিবর্তন ঘটে, তবে দীর্ঘমেয়াদে সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তন একমাত্র বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে থাকে। বিশ্ব উষ্ণায়ন সমুদ্রের পানির একটি তাপগত স্ফীতি ঘটাবে। তাপমাত্রার বৃদ্ধি মেরু ও পর্বতের বরফশীর্ষ এবং বরফের চাঁই গলনেও ভূমিকা রাখবে। বদ্বীপীয় ভূমি হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশাল এলাকা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জলমগ্ন হবে। দেশটির কত অংশ সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যেতে পারে তা নির্ভর করবে এর সঙ্গে সম্পর্কিত সমুদ্রপৃষ্ঠ পরিবর্তনের ওপর। একটি টাস্কফোর্স প্রতিবেদন এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলে প্রায় ২২,৮৮৯ বর্গ কিমি ভূমি সমুদ্রে হারিয়ে যাবে, যা বাংলাদেশের মোট এলাকার প্রায় ১৫.৮%।

একটি নিম্নাঞ্চলীয় এবং উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জোয়ারভাটার তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় এলাকাসমূহে ভূমিক্ষয় এবং প্লাবনের মতো ঘটনা ঘটবে। সমুদ্রের পানিবৃদ্ধি জোয়ারের সময় লোনাপানিকে আরও অভ্যন্তর ভূমিতে অনুপ্রবেশে সহায়তা করবে। কৃষিজমি এবং মিঠাপানির প্রাণী ও উদ্ভিদ ধ্বংস হবে। সমুদ্র-তটরেখা মূলভূমির অভ্যন্তরে প্রবেশের ফলে উপকূলীয় সীমানা আকৃতির পরিবর্তন ঘটবে। এতে বাংলাদেশের ভূভাগ সংকুচিত হবে।

ধারণা করা হয় যে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ১.৮° থেকে ৬.৩° সেলসিয়াসের মতো বৃদ্ধি পেতে পারে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বৃদ্ধি পাবে এবং মিসিসিপি থেকে বাংলাদেশে উচ্চ মাত্রায় জনসংখ্যা অধ্যুষিত উপকূলীয় এবং বদ্বীপ এলাকাসমূহে ব্যাপক প্লাবনের হুমকি দেখা দেবে। জলবায়ুগত দুর্যোগসমূহ যেমন, হারিকেন, ঘূর্ণিঝড় ও খরা ঘনঘন দেখা দেবে এবং এদের তীব্রতা বৃদ্ধি পাবে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগসমূহ যেমন, ম্যালেরিয়া এবং কলেরা বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে বিষুবরেখা অঞ্চলের উত্তর ও দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বাংলাদেশে অধিক বৃষ্টিপাত, ব্যাপক বন্যা, ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়, খরা প্রভৃতি জলবায়ুগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও টেকসই উন্নয়ন কৌশল পৃথিবী ও তার পরিবেশকে এবং বাংলাদেশের মতো দেশসমূহ বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিত বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে। [মাসুদ হাসান চৌধুরী]