বিদ্যাবিনোদিনী, নূরন্নেছা খাতুন

বিদ্যাবিনোদিনী, নূরন্নেছা খাতুন (১৮৯৪-১৯৭৫) প্রথম মুসলিম মহিলা ঔপন্যাসিক। তিনি ১৯৯৪ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার শাহপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা খোন্দকার হাবিবুস সোবহান সরকারি চাকুরে ছিলেন। পূর্ব-পুরুষ শাহ তাহের ছিলেন পীর। পীর-বংশের কন্যা হিসাবে অবরোধ প্রথার গন্ডির মধ্যে থেকে নূরন্নেছা খাতুনের পক্ষে সামান্য গৃহশিক্ষা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ সম্ভব হয়নি।

১৯১২ সালে তিনি আইনজীবী কাজী গোলাম মোহাম্মদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর স্বামী ২৪-পরগনা জেলার কাজী পাড়ার অধিবাসী ছিলেন। স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি ইংরেজি শিক্ষার ও সাহিত্যচর্চার সুযোগ পান। স্বামীর কর্মোপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে গমন ও ভ্রমণের ফলে বহির্জগত সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পায়। ফলে একজন সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে। কোহিনুর মাসিক পত্রিকার ১৩১৮ সনের বৈশাখ সংখ্যায় নূরন্নেছা খাতুনের ‘আহবান-গীতি’ নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস স্বপ্নদৃষ্টা ১৯২৩ সালে শ্রীরামপুর (হুগলী) থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, বেগম রোকেয়ার (১৮৮০-১৯৩৩) পদ্মরাগ উপন্যাসটি এর এক বছর পর ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। এদিক থেকে প্রথম মুসলিম মহিলা ঔপন্যাসিক হিসাবে নূরন্নেছা খাতুন ঐতিহাসিক মর্যাদা পেয়ে থাকেন। পরে নূরন্নেছা খাতুন একে একে জানকী বাঈ বা ভারতে মোসলেম বীরত্ব (১৯২৪), আত্মদান (১৯২৫), ভাগ্যচক্র, বিধিলিপি, নিয়তি প্রভৃতি উপন্যাস ও উপন্যাসধর্মী রচনা করেন। এগুলির অধিকাংশ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্যে পারিবারিক উপন্যাস স্বপ্নদৃষ্টাই শ্রেষ্ঠ। মুসলিম পরিবারের খুঁটিনাটি চিত্র সরল ভাষায় বর্ণনা করেছেন। জানকী বাঈ ঐতিহাসিক উপন্যাস। দেবগিরির রাজা রামদাসের ভ্রাতুষ্পুত্রী জানকী বাঈয়ের সঙ্গে আলাউদ্দীন খিলজীর সেনাপতি ইউসুফ খানের প্রণয়কাহিনী এর বিষয়বস্ত্ত। আত্মদান উপন্যাসে গার্হস্থ্য জীবনের বিয়োগান্তক কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাঁর পরের রচনাগুলি আখ্যানধর্মী; সেখানে মানবচরিত্র অপেক্ষা সমাজচিত্র প্রাধান্য পেয়েছে। তিনি ১৯২৬ সালে মোসলেম বিক্রম ও বাংলার মোসলেম রাজত্ব নামে একটি ইতিহাসমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এতে আরবের হজরত আবু বকরের সময় থেকে আরম্ভ করে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার পতন পর্যন্ত মুসলমানের বীরত্ব ও গৌরবের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।  জানকী বাঈ গ্রন্থেও তিনি ভারতের মুসলমানের গেীরব ও কীর্তির কথা প্রকাশ করেছেন। ১৯২৯ সালে তাঁর সব রচনার সংকলন নূরন্নেছা গ্রন্থাবলী প্রকাশিত হয়। সওগাত পত্রিকায় ১৩৩৩  সনের মাঘ সংখ্যায় তাঁর লিখিত ‘সভানেত্রীর অভিভাষণ’ এবং ১৩৩৬ সনের ভাদ্র সংখ্যায় ‘আমাদের কাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘বঙ্গীয় মোসলেম মহিলা সঙ্ঘে’র সভানেত্রী হিসাবে তিনি সাংগঠনিক কর্মকান্ডে জড়িত ছিলেন।

সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘নিখিল বঙ্গ সাহিত্য সমিতি’ তাঁকে ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ এবং ‘নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ’ ‘সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫২ সালে তিনি মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করে ঢাকায় স্থায়িভাবে বসবাস করেন। কথাসাহিত্যিক ও সংগীতশিল্পী খালেদা মনযূর-এ খুদা তাঁর কন্যা। ১৯৭৫ সালের ৬ই এপ্রিল ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।  [ওয়াকিল আহমদ]