বাহাদুর খান মসনদ-ই-আলা

বাহাদুর খান মসনদ-ই-আলা  হিজলির আফগান জমিদার এবং বাংলার বিখ্যাত ভূঁইয়াদের অন্যতম। যে অঞ্চল জুড়ে তাঁর জমিদারি বিস্তৃত ছিল বর্তমানে তা পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার কাঁথী মহকুমার অন্তর্ভুক্ত। রসুলপুর নদীর তীরবর্তী তাঁর রাজধানী হিজলি ছিল পাচেটের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত দুর্ভেদ্য দুর্গবেষ্টিত সুরক্ষিত নগরী।

মুগল সুবাহদার ইসলাম খান এর ভাটি অভিযানকালে সলিম খান মসনদ-ই-আলা ছিলেন হিজলির জমিদার। তিনি ১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে সুবাহদার ইসলাম খানের নিকট নামমাত্র আনুগত্য প্রদর্শন করেন। সম্ভবত ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে বা এর কিছুকাল পূর্বে সলিম খানের মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর খান হিজলির মসনদে অধিষ্ঠিত হন। পার্শ্ববর্তী অপরাপর জমিদারদের তুলনায় বাহাদুর খান ছিলেন দুর্বিনীত। তাঁর উপাধি ছিল মসনদ-ই-আলা এবং আচার আচরণে তিনি নিজেকে একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে জাহির করতেন। কাশিম খান চিশতির সুবাহদারি আমলে (১৬১৪-১৬১৭) বাহাদুর খানকে দমন করার দায়িত্ব অর্পিত হয় বর্ধমানের ফৌজদার মির্জা মক্কীর উপর। কিন্তু তিনি এতে খুব একটা সাফল্য পাননি। পরবর্তী সুবাহদার ইবরাহিম খান ফতেহ জঙ্গ (১৬১৭-১৬২৪) বাহাদুর খানকে ঢাকায় তাঁর দফতরে ডেকে পাঠান। কিন্তু বাহাদুর খান বাংলার পূর্বতন সুবাহদার ও তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধু মুকাররম খানের সহযোগিতায় প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং বাংলার সুবাহদারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করেন। মুকাররম খান তখন উড়িষ্যার সুবাহদার পদে যোগদানের জন্য বাংলা ত্যাগ করছিলেন। বাহাদুর খানকে দমনের জন্য বর্ধমানের নতুন ফৌজদার মুহম্মদ বেগ আবাকাশকে প্রেরণ করা হয়। বাহাদুর খান তখন মুকাররম খানের নিকট সৈন্য সাহায্য চেয়ে পাঠান। মুকাররম খান অবিলম্বে এক হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের এক বাহিনী তাঁর সাহায্যে প্রেরণ করেন। এ সাহায্য পেয়ে বাহাদুর খান তাঁকে দমন বা সুরক্ষিত রাজধানী হিজলি থেকে তাঁকে বিতাড়িত করতে মুগল সেনাপতির সকল চেষ্টা বানচাল করে দেন।

এদিকে সুবাহদার ইবরাহিম খান যশোর অভিমুখে অগ্রসর হন এবং কাগরঘাটা পৌঁছে মির্জা আহমদ বেগ, মির্জা ইউসুফ, জালায়ের খান, মুসা খান এবং অপরাপর জমিদারদের অধীনে এক বিশাল স্থল ও নৌবাহিনী মুহম্মদ বেগ আবাকাশের সাহায্যে প্রেরণ করেন। মুহম্মদ বেগ তখন হিজলি সীমান্তে তাঁর নবনির্মিত দুর্গে অবস্থান নিয়ে সৈন্য সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

এই যৌথ মুগল বাহিনী নদীপথে হিজলির উপর প্রবল আক্রমণ পরিচালনা করে। বাহাদুর খান মুকাররম খানের নিকট থেকে সামরিক সাহায্যের অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সুবাহদার ইবরাহিম খান যশোরে পৌঁছার পরপরই মুকাররম খান তাঁর অগ্রসরমান বাহিনী উড়িষ্যায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। এ অবস্থায় সংঘর্ষের পথ পরিহার করে সন্ধির প্রস্তাব পাঠানো ছাড়া বাহাদুর খানের গত্যন্তর ছিল না। মির্জা আহমদ বেগ ও অন্যান্য সেনানায়কদের নিকট থেকে তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পর বাহাদুর খান যশোরে এসে মুগল সুবাহদারের নিকট আত্মসমর্পণ করেন (জুন ১৬২১)। সুবাহদার তাঁর অবাধ্যতার জন্য তিন লক্ষ টাকা জরিমানা করে বাহাদুর খানকে তাঁর জায়গিরে পুনর্বহাল করেন।

রূপনারায়ণ থেকে সুবর্ণরেখা নদী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকা বাহাদুর খানের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৬৫১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাসহ উড়িষ্যা প্রদেশের সুবাহদারির দায়িত্ব গ্রহণ করে শাহজাদা মুহম্মদ শাহ সুজা এ অঞ্চলের জন্য বাহাদুর খানের নিকট বর্ধিত হারে রাজস্ব দাবি করেন। বাহাদুর খান তখন তাঁর জ্ঞাতি ভাই ও ভগ্নিপতি জয়েনউদ্দিন খানের প্ররোচনায় ঘটিত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার। জয়েনউদ্দিন খানের ষড়যন্ত্রের ফলে মুগল সুবাহদার কর্তৃক দাবিকৃত রাজস্ব পরিশোধে বিলম্ব ঘটে এবং এর ফলে বাহাদুর খান দায়বদ্ধ হয়ে পড়েন। শাহ সুজা কর্তৃক প্রেরিত এক শাহী বাহিনী হিজলি আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং বাহাদুর খানকে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে আসে। বাহাদুরকে ঢাকায় কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। দখলদার বাহিনীর সঙ্গে জয়েনউদ্দিন খানের গোপন অাঁতাত ছিল বলে প্রতীয়মান হয় এবং সম্ভবত তিনি হিজলির জমিদারিতে তাঁর সপক্ষে শাহী মঞ্জুরি লাভে সমর্থ হন। সিংহাসনের অধিকার নিয়ে সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যকার সংঘর্ষকালে অরাজক অবস্থার সুযোগে বাহাদুর খান কারাগার থেকে মুক্ত হন (১৬৫৯) এবং ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে স্বীয় জমিদারি পুনরুদ্ধার করেন।

জমিদারি পুনরুদ্ধারের এক বছর যেতে না যেতেই বাহাদুর খানের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। একদিকে মুগল সুবাহদারের কর্তৃত্ব অস্বীকার এবং অন্যদিকে তাঁর মাত্রাতিরিক্ত অহঙ্কার ও স্বাধীনতা স্পৃহার ফলে অচিরেই তিনি বাংলার সুবাহদার ও উড়িষ্যার শাসনকর্তার সঙ্গে নতুন করে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার শাসনকর্তা খান-ই-দওরান ও বাংলার সুবাহদার মীরজুমলা বাহাদুর খানকে দমনের জন্য যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। উড়িষ্যা ও বাংলার সম্মিলিত বাহিনী হিজলির উপর প্রচন্ড আক্রমণ পরিচালনা করে। যুদ্ধে বাহাদুর খান পরাজিত ও বন্দী হন। তাঁকে রনথম্বর দুর্গে আটক রাখা হয়। ছয় বছর বন্দী থাকার পর ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খান তাঁকে মুক্ত করে তাঁর জায়গিরে পুনর্বহাল করেন। [মুয়ায্‌যম হুসায়ন খান]