বায়ু

বায়ু  পৃথিবীর চারদিক বেষ্টনকারী গ্যাসীয় আবরণ যা পৃথিবীর অভিকর্ষের টানে পৃথিবী-সংশ্লিষ্ট হয়ে রয়েছে। বায়ুমন্ডল পৃথিবীর জীবজগৎকে ক্ষতিকর বিকিরণ এবং মহাজাগতিক ধ্বংসাবশেষ থেকে রক্ষা করে। নানাবিধ গ্যাসের মিশ্রণে বায়ু গঠিত, যার মধ্যে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরিমাণ সর্বাধিক। ফুসফুস মারফত বায়ুর অক্রি্জেন গ্রহন করেই আমরা বেঁচে আছি। তবে বায়ুর গঠন স্থির নয়। এর প্রধান পরিবর্তনশীল দুটি উপাদান হলো জলীয়বাষ্প ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড। বায়ুর গ্যাসীয় সাংগঠনিক উপাদানগুলো হচ্ছে: নাইট্রোজেন ৭৮.০৯%, অক্সিজেন ২০.৯৫%, আর্গন ০.৯৩%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ০.০৩% এবং সামান্য পরিমাণে নিয়ন, হিলিয়াম, মিথেন, ক্রিপটন, হাইড্রোজেন, জেনন এবং ওজোন। ওজোন গ্যাসের ঘনত্ব উচ্চমাত্রায় পরিবর্তনশীল। এর সৃষ্টি ও ধ্বংস উভয়ই হয়ে থাকে অতি বেগুনী রশ্মি এবং অবলোহিত বিকিরণের (infrared radiation) শোষণের দ্বারা। এই গ্যাসের অধিকাংশই অধিক উচ্চতায় পাওয়া যায়। আবহবিদ্যায় এই গ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি ও অবলোহিত বিকিরণ শোষণ করে। বায়ুর কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস অবলোহিত বিকিরণের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে তাপক্ষয়ের প্রক্রিয়াকে বাধা প্রদান করে। বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমন, কয়লা ও খনিজ তৈল)-র ব্যাপক দহন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্মাইড গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১২% বৃদ্ধি করেছে। এর ফলে উল্লিখিত সময়ে পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ১.১°সে বৃদ্ধি পেয়েছে।

হিন্দু পুরাণ মতে বায়ু হচ্ছে বাতাসের দেবতা, যাঁকে প্রায়শই ইন্দ্রের সঙ্গী অথবা কখনো কখনো ইন্দ্রের সমকক্ষ হিসেবে মনে করা হয়। তিনি সহস্র অশ্বচালিত একটি রথে আসীন। পরবর্তীতে চারটি তোতা পাখী টানা একটি রথে বায়ুকে আসীন হিসেবে চিত্রিত করা হয়। বেদে যদিও বায়ুর মর্যাদা ইন্দ্র অথবা সূর্যের সমকক্ষ নয়, তথাপি তাঁকে জলদেবতা বরুণের মিত্র হিসেবে সম্মানিত করা হয়েছে। বেদের পুরুষসূক্তে তাঁকে পুরুষের পুত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রামায়ণে বায়ু পবন নামেও পরিচিত এবং রামের অন্যতম মিত্র হনুমানের পিতা হিসেবে উপস্থাপিত। বায়ুর সহধর্মিণীর নাম অঞ্জনা। মহাভারতে বায়ুর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে ইন্দ্রের সহযোগী হিসেবে এবং মেনকার সাহায্যকারী হিসেবে বায়ু চিহ্নিত। কুন্তি বায়ুর নিকট সন্তান যাচ্ঞা করলে বায়ু তাঁকে একটি পুত্র সন্তান দান করে, যাঁর নাম ভীমসেন। কুরুক্ষেত্রে বায়ু শক্তিশালী বায়ুবাস্ত্র পরিচালনা করার কলাকৌশল প্রদর্শন করে অর্জুনকে সাহায্য করেন, স্কন্দকে দুজন সহচর প্রদান করে সাহায্য করেন এবং শরশয্যায় ভীষ্মের মৃত্যুকালে দর্শন দান করেন। বায়ুকে অনিল (শ্বাস-প্রশ্বাস), স্পর্শন (স্পর্শকারী), গন্ধবহ (ঘ্রাণ বহনকারী), সদাগত (বর্ষব্যাপী প্রবহমান) প্রভৃতি নামেও অভিহিত করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বায়ুর মৌলিক গুণাগুণসমূহ ফুটে উঠেছে। ভাস্কর্য এবং প্রতিমা নির্মাণে বায়ুকে নীল বর্ণধারী দুই বা চার হস্তবিশিষ্ট আকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। চার হস্তবিশিষ্ট আকৃতির বেলায় বায়ু তার সম্মুখের হাতদুটিতে ভর করে আশীর্বাদ ও অভয় প্রদর্শনের মুদ্রায় দাঁড়িয়ে থাকে, আর পশ্চাৎদেশের হাতদুটিতে থাকে একটি কেতন ও একটি পাখা। তাঁর হাতের পাখাটি বায়ুপ্রবাহের প্রতিকী নিদর্শন।

বৌদ্ধ ধর্ম-দর্শনানুসারে বায়ু আট দিকপালের একজন এবং উত্তর-পশ্চিম বায়ুকোণের দায়িত্বপ্রাপ্ত। বৌদ্ধদের মতো জৈনরাও বিশ্বাস করে যে, বায়ু একাধিক দিকপালের অন্যতম। [মোঃ মাহবুব মোর্শেদ]