বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতি

বাংলাদেশ ভোক্তা সমিতি (ক্যাব)  ১৯৭৮ সালে ঢাকায় বসবাসরত কয়েকজন ব্যক্তির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত একটি অমুনাফাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি ইউরোপ ও আমেরিকায় ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত সংগঠন বা সংস্থার আদলে নিজের গঠনকাঠামো ও কার্যাবলি নির্ধারণ করে নিয়েছে। তবে বাংলাদেশে সংস্থাটি মূলত মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাকে নিজের প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করে এবং সাধারণভাবে ভোক্তাদের অধিকার সম্পর্কে তাদের সচেতন করে। ক্যাব আনুষ্ঠানিকভাবে যেসব লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে সেগুলি হচ্ছে: ১. ভোক্তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি; ২. শোষণের নানা পদ্ধতি ও দিক সম্পর্কে ভোক্তাদেরকে সচেতন করা ও তাদের প্রকৃত প্রতিরক্ষার জ্ঞান ও সহায়তা দেওয়া; ৩. ভোক্তাদের বিভিন্ন সমস্যার ওপর আলোকপাত করা এবং জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন দল, সমিতি, প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংগঠন ও সরকারি সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ধারা বিকশিত করা; ৪. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ সংক্রান্ত সকল প্রকার কার্যাবলি ও তথ্য বিনিময় করা, ৫. দেশের সকল জেলা ও থানায় ক্যাব-এর ইউনিট এবং ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ গ্রুপ গঠন করা এবং ৬. ভোক্তাসংক্রান্ত নানাবিধ বিষয় ও ভোক্তাদের সমস্যা সম্পর্কে গবেষণা পরিচালনা করা।

ভোক্তাদের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি ক্যাব মূলত ভোক্তা কণ্ঠ নামে প্রকাশিত একটি মাসিক বুলেটিনের মাধ্যমে পরিচালনা করে। ক্যাব ইংরেজিতে একটি ত্রৈমাসিক বুলেটিনও প্রকাশ করে এবং তা দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থায় নিয়মিত পাঠায়। এছাড়া বিশেষ ইস্যু বা সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে পুস্তিকা, ফোল্ডার, লিফলেট ইত্যাদি প্রচার করে, গণমাধ্যমে প্রকাশের জন্য নিয়মিত বিভিন্ন ফিচার ও প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাপায়।

ক্যাব নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবাসামগ্রীর বাজারদর নিয়মিত পরিবীক্ষণ করে, ভোক্তা সাধারণকে বাজারের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে এবং বাজারদর যাতে ক্রয়ক্ষমতা সীমা ছাড়িয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখে। ক্যাবের একটি বাজার পরিবীক্ষণ শাখা আছে, যা নিয়মিত বাজার সমীক্ষা পরিচালনা করে এবং পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ভোক্তাদের জন্য তথ্য সরবরাহ করে। দেশে ব্যবহূত ১২টি ক্ষতিকর কীটনাশক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ক্যাব ‘নোংরা এক ডজন’ নামের প্রচারাভিযান চালায়। অতীতে দেশে কীটনাশক বিপণনের কোন সরকারি নীতি ছিল না। ক্যাব-এর উদ্যোগে ও চাপে সরকার এতদ্সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নে বাধ্য হয় এবং গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে তা সর্বসাধারণকে অবহিত করে। বাসাবাড়িতে ব্যবহূত পোকামাকড় ধ্বংসকারী ঔষধ ও সেসবের ছাপযুক্তকরণ বিষয়ে ক্যাব একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। ক্যাব জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়নের দাবিতে খুবই সোচ্চার ও সক্রিয় ছিল এবং ১৯৮২ সালে তা প্রণয়নে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখে। এরপর থেকে ক্যাব জাতীয় ঔষধনীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না সে বিষয়ে পরিবীক্ষণ করে এবং জনস্বাস্থ্য সেবা, বিশেষ করে দরিদ্রদের জন্য চিকিৎসা ও শুশ্রূষা-সেবার নিশ্চয়তা বিধানে সচেষ্ট থাকে। ক্যাব ১৯৮১ সালে ধূমপান বিরোধী আন্দোলন শুরু করে এবং এর অংশ হিসেবে সাধারণের ব্যবহূত অনেক স্থানে ‘ধূমপান নিষিদ্ধ’ ঘোষণা দেয়ার জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার করে। ক্যাব ১৯৮৪ সালে প্রণীত মাতৃদুগ্ধের বিকল্প সংক্রান্ত অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণেও খুবই সক্রিয়। ক্যাব সেমিনার, সম্মেলন, কর্মশালা, সভা-সমিতি ইত্যাদি আয়োজন করে এবং বইপত্র প্রকাশ ও সংবাদপত্রে লেখার মাধ্যমে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সপক্ষে জোর প্রচারণা চালিয়ে আসছে। একইরূপ মাধ্যম ব্যবহার করে ক্যাব পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ এবং নিরাপদ সড়ক ও পরিবহণ-এর জন্য সোচ্চার ভূমিকা রাখছে। ক্যাব-এর একটি রুটিন কাজ হচ্ছে ভোক্তাসমিতি গঠন বিস্তারের মাধ্যমে বিভাগ, জেলা, থানা ও গ্রাম পর্যায়ে ভোক্তা অধিকার আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া। সমিতির সকল স্থানীয় শাখা জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে ভোক্তাদের সচেতনকরণ ও উদ্বুদ্ধকরণের কাজ এগিয়ে নিয়ে যায় এবং ভোক্তাদের নানা ধরনের সমস্যা সমাধানের পথ সুগম করে।

ক্যাব-এর একটি অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র আছে যেখানে ভোক্তাগণ তাদের সব ধরনের অভিযোগ জানিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত ও আইনি সহায়তা পেতে পারে এবং যাদের কারণে তাদের স্বার্থহানি ঘটে তাদের বিরুদ্ধে করণীয় সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। প্রতিদিনের বাজার পরিস্থিতি ও ভোক্তাদের আগ্রহের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাদের অবহিত করার জন্য ক্যাব-এর গ্রন্থাগারসহ একটি ভোক্তাতথ্য কেন্দ্র আছে। ক্যাব হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহে অনুসৃতব্য প্রমিত বিধিবিধান অনুসরণ, তামাকদ্রব্য সেবন, সড়ক দুর্ঘটনা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে। এছাড়া ক্যাব দীর্ঘদিন ধরেই দেশে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।

বর্তমানে ক্যাব ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, বগুড়া, খুলনা ও বরিশাল জেলায় কর্মতৎপরতা পরিচালনা করছে। ক্যাব-এর কার্যক্রমের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলো: ক. দেশে একসময় মিল্কভিটা কোম্পানি গরুর দুধের সঙ্গে আমদানি করা গুঁড়া দুধ মিশিয়ে তা খাঁটি গরুর দুধ নামে বিক্রয় করত। ক্যাব কর্তৃক এই বেআইনি কর্ম উদঘাটনের পর মিল্কভিটা তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়; খ. জাতীয় ঔষধনীতি প্রণীত হবার অনেক আগে থেকেই ক্যাব ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় নানা ওষুধ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার অনেক প্রচারণা চালায় এবং ঔষধনীতি প্রণীত হলে তা জনগণকে জানানোর অভিযান পরিচালনা করে; গ. ১৯৮৪ সাল থেকে ক্যাব মাতৃদুদ্ধ পানের সুফল সম্পর্কে প্রচারাভিযান চালিয়ে আসছে এবং মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্য (বিপণন) অধ্যাদেশ ১৯৮৪-এর বাস্তবায়নের জন্য নিরলসভাবে কাজ করছে; ঘ. কীটনাশক বিপণন বিধিমালা ঘোষণার ক্ষেত্রে ক্যাব-এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল, ক্যাব বাজারদর পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য কমিটি গঠন, স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউট পুনর্গঠন এবং স্ট্যান্ডার্ডসমূহের তালিকা প্রণয়ন ও ভোজ্য তেলে ভেজালের মাত্রা পরিমাপের জন্য কমিটি গঠনে সাহায্য করে; ঙ. ক্যাব সরকারের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগকে পুনর্গঠনে সাহায্য করে; চ. ক্যাব-এর ধূমপানবিরোধী প্রচারাভিযানের ফলে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্কবাণী প্রচারের ব্যবস্থা চালু হয়; এবং ছ. ভোক্তাদের বিভিন্ন স্বার্থ ও বিষয় সম্পর্কে সরকারি ও বেসরকারি নানা প্রকার কমিটিতে ভোক্তাদের স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে ক্যাব-এর অংশগ্রহণ একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

ক্যাব অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে তার কর্মকান্ড পরিচালনা করে। যেমন তহবিল স্বল্পতা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর লোকদের নিকট থেকে তুলনামূলক ধীরগতিতে সাড়া পাওয়া, সাধারণভাবে ভোক্তাদের সীমিত ক্রয়ক্ষমতা বা দর কষাকষিতে তাদের দুর্বল অবস্থান ইত্যাদি। ক্যাব-এর কার্যক্রম প্রায়ই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, তাদের মনোপলিতুল্য সুবিধা খর্ব করে এবং তাদের অসদুদ্দেশ্যে জোট বাঁধতে বাধা দেয় বলে এসব গোষ্ঠীর প্রতিরোধের মুখে ক্যাব-এর সাফল্য এখনও সীমিত পর্যায়েই রয়ে গেছে।  [সৈয়দ রাশেদুল হাসান]