বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ': 'দলিলপত্র  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর পনেরো খন্ডে রচিত একটি দালিলিক প্রকাশনা। এ দলিলপত্রাদি ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবীর ও সাংবাদিক হাসান হাফিজুর রহমানের যৌথ নেতৃত্বে একটি প্রামাণ্যকরণ কমিটি কর্তৃক প্রণীত। প্রায় সাড়ে তিন লাখ পৃষ্ঠাব্যাপী বিপুলায়তন ও সংগৃহীত উপাত্ত থেকে নির্বাচন করে প্রামাণ্যকরণ কমিটি কর্তৃক অনুমোদনের পর কালপঞ্জি অনুসারে বিভিন্ন খন্ডে প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের উদ্যোগে ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমীর মাধ্যমে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহের প্রকল্প শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বাধীনতার ইতিহাস সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৮ সালের জানুয়ারি থেকে। তবে প্রকল্পটি সরকারি অনুমোদন লাভ করে ১৮ জুলাই ১৯৭৮-এ বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী (নং ৫১/২/৭৮/ডেব/২৬১)। এই প্রকল্পের সদস্য সচিব হাসান হাফিজুর রহমান বাংলা একাডেমী কর্তৃক ইতোপূর্বে সংগৃহীত দলিলপত্রসমূহ স্ব-উদ্যোগে গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারের শাসনামলে ১৯৮২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে খন্ডগুলির প্রকাশ শুরু হয়।

দলিল এবং তথ্য প্রামাণ্যকরণের জন্য সরকার নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। এর গঠনকাঠামো ছিল নিম্নরূপ: চেয়ারম্যান প্রফেসর মফিজুল্লাহ কবীর, সদস্য সচিব হাসান হাফিজুর রহমান, সদস্যবৃন্দ: প্রফেসর সালাহউদ্দীন আহমদ, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, ড. সফর আলী আকন্দ, ড. এনামুল হক, ড. কে.এম করিম, ড. কে.এম মোহসীন ও ড. শামসুল হুদা হারুন। ইতিহাস রচনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হলে এই কমিটি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত দলিল ও তথ্য প্রকাশকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু দলিলপত্র সংগ্রহের সীমা স্বাধীনতা যুদ্ধকেন্দ্রিক হওয়া সত্ত্বেও, মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাতে বিশাল পটভূমিরও রয়েছে সমান গুরুত্ব। মুক্তিযুদ্ধকে এই পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এই পটভূমির ঘটনাবলী যাকে মুক্তি সংগ্রাম বলা যায় তার অনিবার্য পরিণতি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। অর্থাৎ মুক্তিসংগ্রামের স্বরূপ জানা ছাড়া ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এই কারণে দুখন্ডে পটভূমি সংক্রান্ত দলিলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। প্রধানত বিশেষ ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ এবং বিষয়ভিত্তিক (themetic) ভাবে খন্ডগুলি পৃথক করা হয়েছে। যেমন, প্রথমখন্ড: পটভূমি (১৯০৫-১৯৫৮); দ্বিতীয় খন্ড: পটভূমি (১৯৫৮-১৯৭১); তৃতীয় খন্ড: মুজিবনগর: প্রশাসন; চতুর্থ খন্ড: মুজিবনগর: প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা; পঞ্চম খন্ড: মুজিবনগর: বেতার মাধ্যম; ষষ্ঠ খন্ড: মুজিবনগর: গণমাধ্যম; সপ্তম খন্ড: পাকিস্তানি দলিলপত্র (সরকারি ও বেসরকারি); অষ্টম খন্ড: গণহত্যা, শরণার্থী শিবির ও প্রাথমিক ঘটনা; নবম খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (১); দশম খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (২); একাদশ খন্ড: সশস্ত্র সংগ্রাম (৩); দ্বাদশ খন্ড: বিদেশি প্রতিক্রিয়া, ভারত; ত্রয়োদশ খন্ড: বিদেশি প্রতিক্রিয়া: জাতিসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্র; চতুর্দশ খন্ড: বিশ্ব জনমত; পঞ্চদশ খন্ড: সাক্ষাৎকার; এবং ষোড়শ খন্ড: কালপঞ্জী, গ্রন্থপঞ্জী ও নির্ঘণ্ট। তবে পরিকল্পনায় থাকলেও ষোড়শ খন্ডটি প্রকাশিত হয় নি এবং সর্বশেষে পঞ্চদশ খন্ডটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে।

তবে কিছু ক্ষেত্রে খন্ড পরিকল্পনায় পৃষ্ঠা সংখ্যার সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, পটভূমি সংক্রান্ত দুটো খন্ডের বিভাজনের ক্ষেত্রে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করেছিলেন, প্রবাসেও বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়েছিলেন ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাঙালি এবং বিখ্যাত বিদেশি নাগরিকগণ। প্রকল্পের আওতায় মার্কিন কংগ্রেস, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, সোভিয়েত ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, কমলওয়েলথ, বিশ্বব্যাংক, বিভিন্ন বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থার বহু সংখ্যক দলিল প্রামাণ্য কমিটি কর্তৃক প্রাসঙ্গিকতা ও মূল্য বিচারের পর প্রকাশিত হয়েছে। মুজিবনগর সরকার ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মূল্যবান দলিলসমূহ মোট চারটি খন্ডে প্রকাশ করা হয়েছে।

কেন দলিলপত্র ১৯০৫ সাল থেকে শুরু করা হয়েছে তার একটি ব্যাখ্যা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান ভূমির বৈশিষ্ট্য এবং এখানে বসবাসকারী জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত যেসব ঘটনা, আন্দোলন ও কার্যকারণ এদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে উদ্বুদ্ধ ও পরিচালিত করেছে, প্রধানত সেরকম প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র ও তথ্যই পটভূমি বিষয়ক দুটি খন্ডে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের অতীত ঘাটতে গিয়ে সুদূর অতীতে প্রত্যাবর্তন করা হয় নি, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ থেকেই পটভূমি সংক্রান্ত দলিল তথ্যাদির সন্নিবেশন করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সম্পাদকমন্ডলীর দাবি হলো যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যাখ্যায় এই শুরুর সীমাটি বাহুল্য বর্জিত, প্রত্যক্ষ ও যুক্তিযুক্ত।

দলিলপত্র ও তথ্যাদির বেলায় সংগ্রহের ধরন বিস্তৃততর হয়েছে। কারণ এই যুদ্ধের সাথে বাংলাদেশের মানুষ ও সমগ্র বিশ্ব জড়িত হয়ে পড়েছিল। ফলে কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বের বিষয়াদির প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্র সংগ্রহ করে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠিপত্র, সাক্ষাৎকার, স্মৃতিকথা, সরকারি নথিপত্র, রণকৌশল ও যুদ্ধসংক্রান্ত লিখিত তথ্যাদি, মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর এবং মুজিবনগর সরকারের তৎপরতা, জনসাধারণের অংশগ্রহণ, কমিটি গঠন, বিবৃতি, বিশ্বজনমত, বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টের কার্যবিবরণী, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দলিলপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। যেহেতু চরিত্রগত দিক থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, যেহেতু সম্পাদকমন্ডলীর উদ্দেশ্য ছিল সর্বসাধারণের মনোভাবের প্রতিফলন করানো এবং এ জন্যে গণসহযোগিতার প্রতি স্তরের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিটি খন্ডে প্রধানত মূল দলিল সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে যেসব দলিল ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করেছে এবং যেগুলি বাদ দিলে ঘটনার ধারাবাহিকতা থাকে না, সেগুলি প্রকাশিত সূত্র থেকেও গ্রহণ করা হয়েছে।

দলিলপত্রাদিতে প্রকল্পের সম্পাদকমন্ডলী নিজস্ব কোনো মন্তব্য এবং ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন নি বরং বস্ত্তনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে দলিল ও তথ্যাদি বাছাই, সম্পাদনা এবং বিন্যাস করেছেন। যাতে কারো প্রতিনিধিত্ব ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছেন। যার যা ভূমিকা ও গুরুত্ব তা যথাযথভাবে তুলে ধরার সযত্ন প্রয়াস তাদের মধ্যে ছিল। মোট পনেরটি খন্ডে প্রকাশিত দলিলপত্র ও তথ্যাদির একটি সাধারণ বিশ্লেষণ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৭১ সালে জনগণের মধ্যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক পরিণত ও অপ্রতিরোধ্য এবং একই কারণে জনগণের মধ্য থেকে সফল ও যোগ্যতম নেতৃত্বের অভ্যুদয় ঘটেছিল। যেকোন মূল্যে স্বাধীনতার চিন্তা একটা সার্বভৌম দেশ ও জাতির পূর্বাপর জনস্রোতকেই সামনে তুলে ধরেছিল। এই প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ পৃষ্ঠার দলিল সংগ্রহ করা হলেও প্রকাশ করা হয়েছে মাত্র পনের হাজারের বেশি নির্বাচিত দলিল। তারপরও সম্পাদকমন্ডলী স্বীকার করেছেন যে, বহু দলিল ও তথ্য তাদের সংগ্রহের বাইরে থেকে গেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। গ্রামে গ্রামে, শহরে বন্দরে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বহু ঘটনার উদ্ভব হয়েছে, বহু বীরত্বগাঁথা, সীমাহীন ত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা, অত্যাচার, নিপীড়ণের কাহিনী স্তরে স্তরে গড়ে উঠেছে। এর পরিমাণ অনুধাবন করা কঠিন। সারা বিশ্বজুড়েও ছিল এ সম্পর্কে সমর্থন ও প্রতিক্রিয়া এবং প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতা। মফিজুল্লাহ কবীর ও হাসান হাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে এই বিশাল ঘটনাপ্রবাহের সমগ্রতা ধারণ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক চর্চার ক্ষেত্রে এগুলি হলো আকর গ্রন্থ।  [আশফাক হোসেন]