বর্গা ব্যবস্থা

বর্গা ব্যবস্থা প্রকৃত চাষি ও ভূমির মালিকের সঙ্গে শর্ত্তযুক্ত লিখিত বা প্রথাভিত্তিক মৌখিক চুক্তি। সে চুক্তি অনুযায়ী চাষি ও মালিকের মধ্যে উৎপাদিত ফসল ভাগাভাগি হয়। সাধারণত প্রথা অনুযায়ী মালিক ও চাষির মধ্যে ফসল আধাআধি ভাগ হয়ে থাকে, যে জন্য কোনো কোনো অঞ্চলে বর্গাদারকে বলা হয় আধিয়ার। তবে বর্গা বা আধি ব্যবস্থাধীনে ভাগাভাগি ব্যাপারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রথা বিদ্যমান ছিল এবং এখনও বিদ্যমান। বর্তমানে শর্তগুলি সাধারণত নির্ভর করে জমির উৎপাদন ক্ষমতা ও বাজার মূল্যের ওপর।

বর্গা ব্যবস্থা মূলত প্রাগমুদ্রা যুগের ঐতিহ্য। ওই সময় রাজা প্রকৃত উৎপাদকের কাছ থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতেন শস্যে। কৃষক তার উৎপাদিত অংশের এক অংশ আর বাকি অংশ রাজা সার্বভৌম অধিকারবলে রাজস্ব হিসেবে আদায় করে নিতেন। মুগল আমলের আদিপর্ব পর্যন্ত রাজা ও কৃষকের মধ্যে এই পদ্ধতি চালু ছিল। ষোল শতকের মধ্যভাগ থেকে মুগল অর্থনীতিতে মুদ্রাব্যবস্থা কৃষক পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। ঊনিশ শতকের প্রারম্ভে মুদ্রা বাজার সার্বজনীনরূপ লাভ করে। তবে মুদ্রাপূর্ব যুগের আধি বা বর্গা ব্যবস্থা আংশিকভাবে এখনো বলবৎ আছে।  আঠার শতকের শেষে ভূমির খাজনা নির্ধারিত হতো ভূস্বামী ও কৃষকের মধ্যে উৎপাদিত শস্যের ভাগাভাগির ভিত্তিতে। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ও বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ কোলব্রুক ১৮০৪ সালে লিপিবদ্ধ করেছেন যে, নবাবি আমলে ভূস্বামীরা রায়তের কাছ থেকে খাজনা আদায় করত উৎপাদিত শস্যের পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে। প্রথার ভিত্তিতে ফসল বাটোয়ারা হতো। তিনি ভূস্বামী ও কৃষকের মধ্যে ফসল বাটোয়ারার প্রধান তিনটি নিয়মের কথা বলেছেন। যেমন: উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ভূস্বামীর আর অর্ধেক কৃষকের; এক-তৃতীয়াংশ ভূস্বামীর আর দুই-তৃতীয়াংশ কৃষকের এবং দুই-পঞ্চমাংশ ভূস্বামীর আর এক-পঞ্চমাংশ কৃষকের। তাঁর মতে এইসব নিয়ম ছিল প্রথাভিত্তিক। ফসলের পরিবর্তে খাজনা যখন টাকার মূল্যে দেওয়া হতো, তখন ভূস্বামী উৎপাদিত ফসলের সমপরিমাণ টাকার ওপর তার নিজের অংশ খাজনা হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিতেন। টাকা অথবা শস্য কোনটির বিনিময়ে খাজনা পরিশোধ করা হবে, তা ভূস্বামী নিজের বিবেচনায় ধার্য করে দিতেন। নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে ভূস্বামী পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়ে গেলে শস্যের বিনিময়ে এবং দাম কমে গেলে টাকার বিনিময়ে খাজনা সংগ্রহ করার চেষ্টা করতেন। উনিশ শতকের শেষ দশকে জরিপ ও বন্দোবস্তের ব্যবস্থা থেকে দেখা যায় যে, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রায়ত উৎপাদিত শস্যের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করে ধানকরারি (শস্যে দেওয়া নির্ধারিত খাজনা) এবং বর্গা বা আধি দু-উপায়েই।।

ভূমির অধিকারহীন অধস্তন রায়তেরা জোতদার, মহাজন এবং অন্যদের জমি চাষ করতো সাধারণত ফসল বাটোয়ারা পদ্ধতিটির ওপর ভিত্তি করে। স্থানীয় প্রথানুসারে দীর্ঘকাল যাবৎ এ ধরনের বর্গাচাষ চলে  এসেছে। আগেই উল্লিখিত হয়েছে যে, বর্গাচাষ পদ্ধতিটির ধরণ ও নিবিড়তায় আঞ্চলিক পার্থক্য রয়েছে। উনিশ শতকে আবাদ বা জমি পুনরুদ্ধার আন্দোলন ব্যাপকতা অর্জন করে। এর প্রধান কারণ বর্গা ব্যবস্থা। জঙ্গলভূমির ইজারাদারেরা জঙ্গল আবাদকারদের আকর্ষণীয় শর্তে জঙ্গল ভূমি আবাদে প্রণোদিত  করতো। জঙ্গলভূমি সর্ম্পূণরূপে চাষের উপযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কোনো খাজনা (মূলত শস্যের ভাগ) দাবি করা হতো না। বিনা খাজনায় প্রজাদের জমি চাষে উদ্বুদ্ধ করা হতো। জমি পুরোপুরি আবাদ হবার পর খাজনা ধার্য করা হতো। তাও এক বারে তা ধার্য করা হতো না। ক্রমশ খাজনার হার বৃদ্ধি করা হতো যেন আবাদকারেরা খাজনার ভয়ে অন্যত্র পালিয়ে না যায়। পরগণা মূল্যে সর্বাধিক খাজনা নির্দিষ্ট হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খাজনা ক্রমশ বৃদ্ধি করা হতো। আবাদকার রায়তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যা ছিল বর্গাচাষি।

একের পর এক রায়তিস্বত্ব আইন, (খাজনা আইন ১৮৫৯, বাংলা প্রজাস্বত্ত্ব আইন ১৮৮৫ এবং প্রজাস্বত্ত্ব আইন ১৯২৮ প্রভৃতি) ঘন ঘন দুর্ভিক্ষ, কৃষিপণ্যের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি মূল্য বৃদ্ধি এবং বিশেষ করে উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাতিষ্ঠানিক বর্গাচাষ ব্যবস্থাকে ক্ষয়িষ্ণু করে তুলে। বর্গাচাষ বিলুপ্তির পক্ষে আরো অবদান রাখে উল্লিখিত একের পর এক প্রজাস্বত্ত্ব আইন। প্রজাস্বত্ত্ব আইনের বাধ্যবাধকতা এড়াতে ইজারাদারেরা বর্গাচাষিদের অধিকার কেড়ে নিতে থাকে এবং তাদেরকে অধিকারহীন ভূমি মজুরে পরিণত করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমির চাহিদা বেড়ে যায়, এবং এর অভিঘাতে হ্রাস পায় জামির ওপর বর্গাদারের অধিকার। মালিকের প্রবণতা দাঁড়ায় নানাভাবে চাষির অধিকার ক্ষুণ্ণ করে জমির ওপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করা এবং এভাবে এককালের বর্গাদারকে কৃষি মজুরে পরিণত করা।

বিশ শতকের বর্গাচাষের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক ছিল ভূমি ও জনসংখ্যার অনুপাত, চাষিদের প্রান্তিকীকরণ, চাষের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এবং গ্রামীণ শ্রেণিগুলির মধ্যে মেরুকরণ। ভূমি নিয়ন্ত্রণের নতুন দৃশ্যপটে দেখা যায়, গ্রামীণ বিভেদকরণ নীতি ১৯৩০ এর গোড়ায় এমন জায়গায় পৌঁছোয় যাতে গ্রামীণ জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ ভূমিহীন হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে প্রভাবশালী ধনী কৃষকেরা নিজেদের ব্যবস্থাপনা-সামর্থ্যের অতিরিক্ত জমি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। তাদের জমি বর্গাদার বা বর্গাচাষি নামের প্রান্তিক  বা ভূমিহীন চাষিরা চাষ করতো এবং জমির মালিকের কাছে ফসলের অর্ধেক সমর্পণ করতো। গ্রামীণ নিঃস্বতার প্রতিক্রিয়া চরমে ওঠে ১৯৩০ এর ভয়বহ মন্দায়। সেই মন্দায় বর্গাচাষিদের দুর্গতি হয় সবচেয়ে বেশি। ১৯৪৩ এর মহা দুর্ভিক্ষ গ্রামীণ ধনীদরিদ্র পার্থক্যকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ভূমিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রান্তিক চাষিরা ভূসম্পদশালীদের বর্গাদারে পরিণত হয়। জেলা জরিপ ও বন্দোবস্তের রিপোর্টে (১৯০০-১৯৪৫) দেখা গেছে বাংলার প্রতিটি জেলাতে কৃষক জনসংখ্যার ১০% থেকে ৩০% ছিল বর্গাচাষি।

কৃষিতে এ ধরনের বিভেদ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবেই  দ্বন্ধ সৃষ্টি করতে অবদান রাখে। বামপন্থী মুসলিম রাজনীতিকদের নেতৃত্বাধীন নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি এবং কমিউনিস্টদের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিষাণসভা জোতদার শ্রেণির বিরুদ্ধে বর্গাচাষিদের সংঘটিত করে। তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বর্গা ও আধিয়ার চাষিরা খাজনা হিসেবে অর্ধেক ফসল দেবার বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখী হয়ে উঠে। তারা উৎপাদিত ফসলের অর্ধেকের জায়গায় দুই-তৃতীয়াংশ দাবি করে। উত্তর ও উত্তর পূর্বের কিছু জেলার বর্গাচাষিরা ১৯৩০ এর গোড়ার দিক থেকে তেভাগা, নানকর, টং প্রভৃতি নামে সংগ্রাম করে এবং তাদের আন্দোলন ১৯৪৭ এর বঙ্গ বিভাগের পরও অব্যাহত থাকে।

১৯৫০ সালের পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন এ বর্গা ছাড়া বাকিসব মধ্যস্বত্বভোগীদের মেয়াদের অবসান ঘটানো হয়। যেখানে ১৯৫০ এর দশকে মোট কৃষিভুমির ২০% বর্গাদারদের দখলে ছিল, ১৯৮০র দশকে তা ১৬% ভাগে এবং  ১৯৯০ এর দশকে বর্গাচাষ ১০% নিচে নেমে আসে। কিন্তু ওই সময়ে নতুন প্রজারা বর্গাচাষির জায়গা নিতে শুরু করে। দ্রুত ফলনশীল ধানের ও অন্যান্য ফসলের দ্রুত সম্প্রসারণের কারণে ভূমির মালিকরা নগদ ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য জমি বন্দোবস্ত করতে থাকে। তাই এখন সনাতন বর্গাচাষ কেবল সেইসব সেচহীন সেকেলে জমিতে দেখা যায় যেখানে পুঁজিবাদী ভিত্তিতে জমির বন্দোবস্ত হয়নি।

১৯৮৪ সালের ভূমির পূনর্গঠন অধ্যাদেশ বর্গাভূমির এক-তৃতীয়াংশ ভুমি মালিককে এবং দুই-তৃতীয়াংশ বর্গাচাষিদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে আইনটির বাস্তবায়নে কখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে বাজারের শক্তির ভিত্তিতে বর্গাপদ্ধতি গ্রামে ক্রিয়াশীল রয়েছে। স্থানীয় পথা ও প্রতিযোগিতা অনুযায়ী বর্গার অংশ সবসময়ে নির্দিষ্ট হতো। ফলে বিভিন্ন এলাকায় নিয়মটির ভিন্নতা দেখা দেয়। বর্তমানে ভূমি মালিকেরা কৃষি ব্যবসায় খানিকটা বিনিয়োগ করে চাষবাসের বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। অনেক বর্গাচাষিই এখন বর্গার চেয়ে মজুরিকে অধিকতর লাভজনক মনে করে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে এ এক পরিবর্তন যা ভূমি সম্পর্কের পুঁজিবাদী বিকাশের সকল লক্ষণাক্রান্ত।  [সিরাজুল ইসলাম]