বজ্রযান

বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের একটি মতবাদ। তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রযানের সঙ্গে মহাসুখবাদের সংযোগের ফলে উদ্ভূত এ মতবাদ বাংলার  সমতট অঞ্চলে বিশেষ প্রসার লাভ করেছিল। বজ্রযানমতে নির্বাণের পর শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ লাভ হয়। শূন্যতার পরম জ্ঞানই নির্বাণ। এই জ্ঞানকে বলে নৈরাত্মা। নৈরাত্মার মধ্যে আত্মা লয়প্রাপ্ত হয়। বোধিচিত্ত যখন নৈরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হয়ে নৈরাত্মাতেই লীন হয়, তখন উৎপন্ন হয় মহাসুখ। চিত্তের যে পরমানন্দ ভাব, যে এককেন্দ্রিক ধ্যান, তা-ই বোধিচিত্ত। বোধিচিত্তই বজ্র। কঠোর যোগের দ্বারা ইন্দ্রিয় দমিত হলে চিত্ত বজ্রের ন্যায় দৃঢ় হয়। এ অবস্থায় সাধক বোধিজ্ঞান লাভ করেন। বজ্রকে আশ্রয় করে যে যানে বা পথে নির্বাণ লাভ হয়, তা-ই বজ্রযান।

বজ্রযানে গুরু অপরিহার্য। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের গুরু জেতারি ছিলেন বজ্রযানের অন্যতম গুরু। তিনি এ বিষয়ে বহু গ্রন্থও রচনা করেন। সপ্তম শতাব্দীর বৌদ্ধপন্ডিত শান্তিদেবও বজ্রযান বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। বাঙালি তান্ত্রিক আচার্য শান্তরক্ষিতও বজ্রযান বিষয়ে তিনখানি তন্ত্রগ্রন্থ রচনা করেন।

বজ্রযানমতে এই ভৌতিক দেহ পঞ্চস্কন্ধ দ্বারা গঠিত। সাধকের দেহস্থ এই পঞ্চস্কন্ধের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশি সক্রিয়, সে অনুযায়ী তার কুল নির্ণীত হয়। এই কুল দ্বারা সাধকের প্রাথমিক পরিচয় ছাড়াও অন্তর্নিহিত যোগশক্তির প্রভাব সম্পর্কেও জানা যায়। কুলগুলি হচ্ছে ডোম্বী, নটী, রজকী, চন্ডালী ও ব্রাহ্মণী। এই পঞ্চকুল আবার পাঁচটি শক্তি বা প্রজ্ঞার রূপ বিশেষ। বৈষ্ণব পদকর্তা চন্ডীদাসের রজকী বজ্রযান মতে তাঁর কুলেরই সূচক। বজ্রযানে সাধনমার্গ নানা দেব-দেবী, মন্ত্র, পূজা ও আচার-অনুষ্ঠানে আকীর্ণ।

বর্তমান বাংলাদেশে বজ্রযানী বৌদ্ধ মতাদর্শের বিদ্যমানতা নেই। বাংলাদেশী বৌদ্ধদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকলেও এবং ভিক্ষুসংঘের মধ্যেও চিন্তার মতানৈক্যগত বিভিন্ন নিকায় থাকলেও প্রত্যেক নিকায় ও সংস্থা থেরবাদের অনুসারী। তাদের মধ্যে স্থান ও পাত্রভেদেও কোনোরূপ তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাচরণের সংস্কৃতি পরিলক্ষিত হয় না।  [সুমন কান্তি বড়ুয়া]