বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৬:৪৭, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের শাখা সংগঠন। এটি ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রথম নেতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে নির্বাচিত কাউন্সিলে যোগদানের ক্ষেত্রে গান্ধীর ‘বর্জন নীতির’ বিরোধিতা করে তিনি ১৯২৩ সালে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। ১৯২৬ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর তাঁর দুই সহযোগী যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস এক মারাত্মক ভাঙনে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতেন, আর সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর রাজনীতিতে বঙ্গীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং কলকাতা পৌর কর্পোরেশনের মতো স্থানীয় স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিত্তরঞ্জন দাশের হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ধারাকেই অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন। যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত গান্ধীর পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতার সুবাদে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। অন্যদিকে বাংলায় যুগান্তরঅনুশীলন সমিতি নামে দুটি জাতীয় বিপ্লবী দল গঠিত হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে এ দল দুটির প্রভাব ছিল এবং ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তারা সুভাষ বসুকে সমর্থন দিয়েছে। তারপর যুগান্তর সুভাষ বসুকে সমর্থন করে গেলেও অনুশীলন সমিতি সেনগুপ্তকে সমর্থন করত। এ দুটি দল ছাড়াও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে মুসলিম ও কমিউনিস্ট সহ আরও কয়েকটি উপদল ছিল।

ত্রিশের দশকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ভিন্ন নামে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই কার্যক্রম চালাত। তৎকালে বঙ্কিম মুখার্জী, বিজয় মোদক, বিনয় চৌধুরী ও অন্যান্য কমিউনিস্ট নেতা কংগ্রেসের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বসু বঙ্গীয় কংগ্রেসের মধ্যে একটি গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠন করলে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি উপদলের মধ্যে বিরোধ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ত্রিশের দশকে যুগান্তর দল বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কার্যনির্বাহী কমিটি নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু এ সময় বসু কারাবন্দি হলে দলের নিয়ন্ত্রণ বাংলার রাজনীতির ‘পঞ্চপ্রধান’ নির্মলচন্দ্র চন্দর, নলিনীরঞ্জন সরকার, তুলসী চরণ গোস্বামী, ডা. বিধানচন্দ্র রায় ও শরৎচন্দ্র বসুর (সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ) হাতে চলে যায়। চিত্তরঞ্জন দাশের সৃষ্ট এই ‘পঞ্চপ্রধান’ রাজনীতিতে সুভাষ বসুর বামঘেঁষা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি ততটা আস্থাশীল ছিলেন না। বসুর অনুপস্থিতেতে ‘পঞ্চপ্রধান’, বিশেষত বিধানচন্দ্র রায় ও নলিনীরঞ্জন সরকার বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন; ফলত যুগান্তর গ্রুপ নেপথ্যে অপসারিত হয়। তাছাড়া ‘পঞ্চপ্রধান’ সেনগুপ্তর অনুশীলন উপদলেরও বিরোধিতা করেন। কলকাতা পৌর কর্পোরেশনে মুসলিম প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নে অন্তর্দলীয় কোন্দলে লিপ্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নেতারা জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বিরাগভাজন হন।

বঙ্গীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ তীব্র দলাদলি যুগান্তর দলের নেতৃবর্গ ও পঞ্চপ্রধানের সুদৃঢ় বন্ধনে ফাটল ধরায় এবং ফলত দুটি দলই ইতিবাচক রাজনৈতিক ধারা অনুসরণে ব্যর্থ হয়। দলের মধ্যে গান্ধীর অনুসারীর সংখ্যা নগণ্য থাকায় বাংলার রাজনীতিতে গান্ধীর অবস্থান ছিল খুবই দুর্বল। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে এর পূর্ব পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস যে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্লাটফর্ম ছিল তার বিলুপ্তি ঘটে।

সেনগুপ্ত-অনুশীলন উপদল বঙ্গীয় আইন অমান্য পরিষদ নামে একটি নিজস্ব ফোরাম গঠন করে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে জাতীয় স্বার্থের পরিবর্তে ততদিনে অঞ্চলপ্রীতি ও উপদলীয় স্বার্থের অনুপ্রবেশ ঘটে এবং ফলে তা মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সমর্থন হারায়। ১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনের আওতায় ১৯৩৭ সালের প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনের পর বাংলার কৃষককুলের জনপ্রিয় নেতা ফজলুল হক তাঁর কৃষক-প্রজা পার্টি ও কংগ্রেসের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা দলের সঙ্গে কোয়ালিশন গঠনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনুমোদন আদায়ে ব্যর্থ হন।

১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী অধিবেশনের পর গান্ধী ও তাঁর ডানপন্থী সহযোগীদের অসহযোগিতা ও অবিরাম বিরোধিতার কারণে সুভাষচন্দ্র পদত্যাগে বাধ্য হন এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে আবার দলাদলি দানা বাঁধতে থাকে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগের পর বসু বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে পুনরায় কাজ শুরু করেন এবং অচিরেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের নতুন কার্যনির্বাহী কমিটির সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। অতঃপর তিনি তিন বছরের জন্য বরখাস্ত হন এবং এ সময়কালে কংগ্রেসের যেকোন পদে নির্বাচিত হওয়ারও যোগ্যতা হারান। বসুর সভাপতিত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস অবশ্য ‘স্থগিত বঙ্গীয়  প্রাদেশিক কংগ্রেস’ হিসেবে সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের সভাপতিত্বে ‘নিয়মিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের’ সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ চালাত। সুভাষচন্দ্র বসু অবশেষে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস পরিত্যাগ করে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তখন সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ প্রমুখ গান্ধীভক্ত নেতাদের করায়ত্ত হয়। খগেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষ, রাজেন্দ্রনাথ দেব, আফসারউদ্দিন আহমদ চৌধুরী প্রমুখের নেতৃত্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস ১৯৪২ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। ১৯৪২-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের কোন অস্তিত্ব ছিল না, কেননা নিয়মিত ও স্থগিত উভয় কমিটিই ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি বাংলার রাজনীতিতে মুসলিম লীগের ক্রমবর্ধমান শক্তি মোকাবিলায় বঙ্গীয় কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল একান্তই অকার্যকর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে সকল কংগ্রেসনেতা জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের শেষ ও ১৯৪৬ সালের শুরুতে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় আইনসভা নির্বাচনে প্রতিযোগিতার জন্য একক ঐক্যবদ্ধ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নতুন কমিটির অন্তর্ভুক্ত ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, হেমন্তকুমার বসু, আফসারউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, ডা. পি.সি ঘোষ ও সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ।

১৯৪৭ সালের মে মাসে ভারত বিভাগ যখন কার্যত সুনিশ্চিত, তখন বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের শরৎচন্দ্র বসু এবং মুসলিম লীগের বাংলা শাখার এইচ.এস সোহরাওয়ার্দী ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা একটি অবিভক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলারাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরিকল্পনাটি অগ্রাহ্য করে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রাক্কালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের নিয়ন্ত্রণ সুরেন্দ্রমোহন ঘোষ, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ ও ধীরেন্দ্র নাথ মুখার্জীর নেতৃত্বাধীন বিকাশমান ‘হুগলী গ্রুপ’-এর করায়ত্ত হয়। বাংলার কার্যনির্বাহী কমিটির একমাত্র সদস্য ডা. প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ তখন কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা এবং ১৯৪৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন। [অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়]