ফ্রেডারিক, সিজার

ফ্রেডারিক, সিজার  ভেনিশীয় পর্যটক। ১৫৬৩ থেকে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দ সময়ের মধ্যে তিনি প্রাচ্য ভ্রমণ করেন এবং ভারত ও বাংলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নগর, বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনা করেন। তাঁর বর্ণনায় এখানকার মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের চিত্র ফুটে উঠেছে।

সিজার ফ্রেডারিক কোচিন ভ্রমণের জন্য গোয়া গমন করেন। নায়ারদের জীবনযাত্রার ওপর তিনি চিত্তাকর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন। সেখান থেকে তিনি কুইলন যান এর পরে সিংহল (শ্রীলঙ্কা) গমন করেন। এরপর তিনি সম্ভবত নেগাপট্টম হয়ে উড়িষ্যা ও বাংলা ভ্রমণে আসেন। ফ্রেডারিক হলেন প্রথমদিকের ইউরোপীয় পরিব্রাজক যিনি সন্দ্বীপ ভ্রমণ করেন। সেখানে তিনি মানুষের বসতি লক্ষ্য করেন। দ্বীপটি ছিল অত্যন্ত উর্বর এবং একটি নদী দ্বারা দ্বিধাবিভক্ত। এখানকার অধিবাসিগণ সমুদ্র সৈকতে বাজার স্থাপন করে। বাজারে দ্রব্যের সস্তা মূল্য দেখে তিনি অবাক হন। এখানে মুসলমান জাতি-গোষ্ঠীর অধিবাসিগণ মুসলিম শাসক কর্তৃক শাসিত হতো। দ্বীপটি ছিল বাংলার রাজার অধীনে।

এরপর ফ্রেডারিক চট্টগ্রামে পৌঁছেন এবং সেখানে তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থানে রপ্তানি করার উদ্দেশ্যে জমাকৃত উন্নতমানের চাল, বস্ত্র ও চিনির আড়তের সন্ধান পান। গঙ্গা নদী দিয়ে ভ্রমণের সময় তিনি সপ্তগ্রামে প্রবেশ করেন। অবশ্য তখন এটি ইউরোপীয়দের কাছে সাতগাঁও নামে পরিচিত ছিল। তিনি আঠারো ঘণ্টা স্রোতের অনুকূলে ভ্রমণ করে গঙ্গার মুখে পৌঁছেন। তিনি সর্বপ্রথম হাওড়ার বিপরীতে বেতোর পৌঁছেন। অনুমান করা হয় যে, তিনি সরস্বতী নদী দিয়ে এ স্থানে আসেন এবং সম্ভবত সে সময় থেকেই উক্ত নদীটিতে পলি জমতে শুরু করেছিল। কারণ তিনি উল্লেখ করেছেন যে, নদীর উজানের দিকটি অত্যন্ত অগভীর। তিনি বেতোরকে একটি জনবহুল স্থান বলে উল্লেখ করেন ও এর বন্দরে অসংখ্য জাহাজের ভিড়ও লক্ষ্য করেন। ফ্রেডারিক সাতগাঁও-এ চাল, বস্ত্র, লাক্ষা, চিনি, বড় গোলমরিচ, তেল ও আরও অনেক ধরনের পণ্যবোঝাই ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশটি ছোট বড় জাহাজ দেখতে পান।

সবকিছু মিলিয়ে ফ্রেডারিকের কাছে এই সাতঁগাও শহরটি সব ধরনের পণ্য সমৃদ্ধ বণিকশ্রেণি অধ্যুষিত মানানসই শহর বলে মনে হয়েছে। তবে বন্দরে মাত্র ত্রিশ-পঁয়ত্রিশটি জাহাজের উপস্থিতি ধারণা দেয় যে, সম্ভবত  ওই সময় থেকেই সাতগাঁও-এর পতন শুরু হয়। বাংলায় তখন পর্যন্ত মুগল আক্রমণ শুরু হয় নি। ফ্রেডারিক অত্যন্ত অবাক হয়ে বর্ণনা করেছেন যে, প্রায় প্রতিদিনই গঙ্গা তীরের কোন না কোন অংশে অসংখ্য মেলা বসে এবং সেখানে অত্যন্ত কম দামে জিনিসপত্র কেনাবেচা হয়। তিনি আরও লক্ষ করেছেন যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী অসংখ্য মানুষ প্রতিদিন গঙ্গায় পূজা করে।

সিজার ফ্রেডারিক বাংলা থেকে পেগু ও আরও অন্যান্য অনেক স্থানে ভ্রমণ শেষে ১৫৮১ খ্রিস্টাব্দে হরমুজ হয়ে ভেনিস প্রত্যাবর্তন করেন।

ফ্রেডারিকের বর্ণনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সপ্তগ্রাম ও বেতোরের পতনের সময়কালীন বিবরণ। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিকগণ তাঁর প্রদত্ত তথ্য গ্রহণ করেছেন। কারণ তিনিই সম্ভবত শেষ ইউরোপীয় পরিব্রাজক যিনি সপ্তগ্রাম বন্দরে জাহাজের অবস্থানের কথা বলেছেন। তাঁর গ্রন্থ একটি আকর্ষণীয় তথ্য নির্দেশ করে যে, তিনি বেতোর থেকে সপ্তগ্রামে যে সরস্বতী নদী দিয়ে পৌঁছেছিলেন, তখন সেই নদীটিকে গঙ্গা নামে ডাকা হতো। অবশ্য হুগলি তখনও নাব্য হয়ে ওঠে নি। তাঁর বিবরণ অনুযায়ী মুগল আক্রমণের অব্যবহিত পূর্বে বাংলা সালতানাত ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী। তবে মনে হয়, সে সময়ে বাংলার রাজধানী গৌড় থেকে তান্ডায় স্থানান্তরের প্রস্ত্ততি চলছিল, আর সে কারণেই হয়তবা ফ্রেডারিক রাজধানী ভ্রমণে যান নি।  [অনিরুদ্ধ রায়]

গ্রন্থপঞ্জি  Purchas and His Pilgrimages, Hakluyt Society, Edinburg, 1911; EF Oaten, European Travellers in India, Lucknow, 1973, reprint of 1st ed 1909.