প্রাগজ্যোতিষ

প্রাগজ্যোতিষ  প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে উল্লিখিত আসামের একটি প্রাচীন নাম। নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে মতানৈক্য রয়েছে। চীন দেশ থেকে আসামে আগত চাও-থিয়াস জনগোষ্ঠী থেকে নামটির উৎপত্তির ধারণা গ্রহণযোগ্য নয়। অস্ট্রিক শব্দ-সমষ্টি ‘পাগার জুহ্’ (Pagar-Juh, বিস্তৃত পার্বত্য অঞ্চল) থেকে এর উৎপত্তির ধারণাটি অধিক যুক্তিসঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়। ‘কালিকাপুরাণে’ অবশ্য দেশটির জ্যোতির্শাস্ত্রীয় গুরুত্ব নির্দেশ করে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মা সর্বপ্রথম প্রাগজ্যোতিষের নক্ষত্রসমূহকে গণনা করেছিলেন। ই.এ গেইট উল্লেখ করেন যে, ‘প্রাগে’র অর্থ প্রাক্তন বা পূর্বদেশীয় এবং ‘জ্যোতিষ’ মানে নক্ষত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, দ্যুতিময়। সুতরাং প্রাগজ্যোতিষপুর শব্দের মর্মার্থ ‘পূর্বদেশীয় জ্যোতির্বিদ্যার নগর’ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। দেশটির জ্যোতির্শাস্ত্রীয় তাৎপর্য অবশ্য প্রতিপন্ন হয় বৈদিক সাহিত্যে বেশ কয়েক বার এর উল্লেখের কারণে। এ সাহিত্য গ্রহ এবং সূর্য সম্পর্কিত পূজার সঙ্গে এর সম্পৃক্তির কথা বলে। জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে আলোচিত মধ্যযুগীয় কয়েকটি গ্রন্থে এ তথ্যের জোরালো সমর্থন পাওয়া যায়। জাদুবিদ্যার কেন্দ্র হিসেবে অঞ্চলটির খ্যাতি রয়েছে।

আসাম ব্যতীত অন্যত্র প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য ও কামরূপ অঞ্চল নির্দিষ্ট করার বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিতর্ক রয়েছে। ‘মহাভারত’-এ প্রাপ্ত প্রমাণাদির উপর ভিত্তি করে তাঁদের যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছে যেখানে প্রাগজ্যোতিষ-এর অবস্থান ভারতের পশ্চিম বা উত্তরে বলা হয়েছে। সভাপর্বের বর্ণনা অনুযায়ী ভীম-এর অভিযান এবং প্রাগজ্যোতিষ এর ভগদত্তের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ উত্তরে অনুষ্ঠিত হয়েছে। আবার একই ‘পর্ব’ ও ‘অশ্বমেধ পর্ব’-এর বর্ণনানুয়ায়ী ভীম-এর অভিযান পূর্বদিকে লৌহিত্যে পরিচালিত হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে। লৌহিত্যের (ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে অভিন্ন) প্রাগজ্যোতিষের সান্নিধ্য প্রাগজ্যোতিষের অবস্থান নির্ধারণের জন্য বিশেষ গুরুত্ববহ।

প্রাচীন আসামের বহুসংখ্যক শিলালিপি রয়েছে যেগুলিতে প্রাগজ্যোতিষ এবং প্রাগজ্যোতিষাধিপতি (রাজ্যের শাসক) অভিধাসমূহ অধিকতর শ্রেয় হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। প্রাগজ্যোতিষ রাজ্যের রাজধানী শহর ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর যা আসামের বর্তমান রাজধানী দিসপুরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যদিও প্রাগজ্যোতিষ অভিধাটি প্রায়শ দেশ ও রাজধানী উভয়ের জন্য ব্যবহূত হতো। এ ধরনের উপসংহারের যথার্থতা সম্পর্কে বহু অভিলেখ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রাগজ্যোতিষ সম্পর্কিত স্পষ্ট অভিলিখনটির সূত্র আমরা উল্লেখ করতে পারি যেখানে রত্নপালের (১১ শতক) বারগ্রাম দানপত্রে প্রাগজ্যোতিষের অভ্যন্তরে দুর্জয়-এর অবস্থান বর্ণিত হয়েছে।

আধুনিক আসাম প্রাচীন কালের বিস্তৃত প্রাগজ্যোতিষ অথবা কামরূপ রাজ্যের একটি অংশ বলে মনে হয়। রাজ্যের সীমানা সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হওয়া সত্ত্বেও এটা নিশ্চিত যে, রাজ্যটির উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা আধুনিক আসাম রাজ্যের সীমানার অনেক বাইরে ছিল। ‘রামায়ণ’(কিষ্কিন্ধ্যাকান্ড) এবং ‘মহাভারত’ এ (স্ত্রী-পর্ব) বর্ণিত প্রমাণাদি বিশ্বাস করলে প্রাগজ্যোতিষ নগরীর অবস্থান পাহাড়ি এলাকায় ছিল বলে মানতে হবে। মহাভারতের দ্রোণপর্বে প্রাগজ্যোতিষের রাজা ভগদত্তকে ‘শৈলালয়’,‘পর্বতপতি’ এবং উদ্যোগ পর্বে ‘পূর্বসাগরবাসী’ বলা হয়েছে। একই গ্রন্থ ভগদত্তকে চীনা, কিরাত, ম্লেচ্ছ ও সাগরানুপবাসীদের নেতা হিসেবে অভিহিত করেছে। অনেক গবেষক এদেরকে মঙ্গোলীয় এবং ইন্দো-মঙ্গোলীয়দের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেছেন যারা বর্তমানে আসাম ও সন্নিহিত রাজ্যসমূহের জনসংখ্যার একটি প্রধান অংশ। উপরন্তু ‘রামায়ণ’এ বর্ণিত বরাহ্ পর্বত যদি আসাম পর্বত শ্রেণীর সঙ্গে অভিন্ন মনে করা হয় এবং পাহাড়সমূহের দক্ষিণে সাগরের অবস্থান ধরা হয় তাহলে এটা প্রায় নিশ্চিত যে, সিলেট, ময়মনসিংহ ও সন্নিহিত ভূখন্ডের কিছু অংশ অন্তত মহাকাব্যিক যুগে পানির নিচে ছিল এবং ব্রহ্মপুত্র এখনকার মতো গারো পাহাড় বেষ্টন করে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে লৌহিত্য সাগরে পড়ত। তবে কে.এল বড়ুয়ার মতানুযায়ী রাজ্যটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা কোশী নদী পর্যন্ত (বিহার) বিস্তৃত ছিল কিনা সে সম্পর্কে এখনও সন্দেহ রয়েছে।  [ইছামুদ্দীন সরকার]