প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল  প্রজাতন্ত্রের কোন বিষয় অথবা কোন সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় উদ্ভূত বিষয় নিষ্পত্তি বা বিচারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সালিস-সভা। একদিকে রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রতিষ্ঠান ও আমলাদের এবং অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিকদের মধ্যকার সৃষ্ট বিরোধ প্রশাসনিকভাবে বিচার-নিষ্পত্তির অনুশীলনের ধারণা থেকেই প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের উদ্ভব। ১৯৪৭ সালের ক্রাউন প্রসিডিংস অ্যাক্ট-এর ভিত্তিতেই ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গড়ে উঠেছিল। এ সব ট্রাইব্যুনালের আওতায় ছিল সাধারণত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয়, যেমন সামাজিক নিরাপত্তা, শিশুসদনের নিবন্ধন, স্থানীয় করব্যবস্থা ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্রেও বিরোধ নিস্পত্তির জন্য বিশেষ কমিশন রয়েছে, যেমন ইন্টার-স্টেট কমার্স কমিশন, ফেডারেল ট্রেড কমিশন ইত্যাদি। ফ্রান্সেই রয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী ধরনের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল। একে বলা হয় কাউন্সিল অব স্টেট সিস্টেম। বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল বিদ্যমান।

বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৭ অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিধান রাখা হয়েছে। অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালস অ্যাক্ট ১৯৮০ (১৯৮১ সালের অ্যাক্ট-৭) বলে বাংলাদেশে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়। এ আইনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত ব্যক্তির চাকুরির শর্ত সম্পর্কিত বিষয়ে বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। এ আইনে বলা হয়েছে, সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ দানের দিন থেকে এই ট্রাইব্যুনাল কার্যকর হবে। এ চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সরকার বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঘোষণা দেয় যে, ১৯৮১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কিত আইন কার্যকর হবে। এ আইনে আরও বলা হয় যে, যখন সরকার এক বা একাধিক প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করবে, তখন প্রত্যেকটি ট্রাইব্যুনালের সুনির্দিষ্ট আওতা নির্ধারণ করে দিতে হবে। এক সদস্যবিশিষ্ট এই ট্রাইব্যুনালের সদস্য সরকার কর্তৃক জেলা জজদের মধ্য থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। ট্রাইব্যুনালের সদস্যের নিয়োগের শর্তাবলি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে।

প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত কোন ব্যক্তির চাকুরির শর্তাবলি পেনশনের অধিকার সংক্রান্ত আবেদন গ্রহণ ও তৎসম্পর্কে সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুস্পষ্ট এখতিয়ার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত কোনো ব্যাক্তি সম্পর্কে তার কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত যেকোন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তার আবেদনও ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করতে পারে। অবশ্য আইনি শর্ত হলো, আবেদনকারীকে তার সম্পর্কে গৃহীত যেকোন ব্যবস্থা বা আদেশে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি হতে হবে। সংক্ষুদ্ধ ব্যক্তির ঊর্ধ্বতন কোন প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থা বা আদেশ বাতিল, পরিবর্তন বা সংশোধনের সুযোগ থাকলে সেক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক এ ধরনের কোন আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে এ ধরনের অভিযোগের প্রতিকার চেয়ে আবেদন করার সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া আছে। যথার্থ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কোন ব্যবস্থা বা আদেশ প্রদানের তারিখ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত এ সময়সীমা নির্ধারিত। জানা যায়, ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি সংশোধনীর মাধ্যমে ছয় মাসের এ সময়সীমা নির্ধারণ করেন। এই সংশোধনী এখনো জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয় নি। এ আইনে প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত ব্যক্তিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, যিনি চাকুরিতে কর্মরত রয়েছেন বা অবসর নিয়েছেন অথবা অন্য কোনভাবে চাকুরি থেকে বরখাস্ত, অপসারিত বা পদচ্যুত হয়েছেন। প্রতিরক্ষা বিভাগের চাকুরিতে কর্মরত ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য নয়।

এডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনাল আক্টে একটি প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনালেরও বিধান রাখা হয়েছে। সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত একজন চেয়ারম্যান ও অপর দুজন সদস্য নিয়ে আপীল ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে। নিয়োগের জন্য চেয়ারম্যান ও সদস্যদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কেও এ আইনে বলা হয়েছে। চেয়ারম্যান হবেন এমন এক ব্যক্তি যিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা বিচারক হওয়ার যোগ্য অথবা প্রজাতন্ত্রে কর্মরত এমন একজন কর্মকর্তা যার পদমর্যাদা সরকারের অতিরিক্ত সচিবের নিচে নয়। অপর দুজন সদস্যের মধ্যে একজন হবেন এমন ব্যক্তি যিনি প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত এবং যার পদমর্যাদা যুগ্মসচিবের নিচে নয়। অপর সদস্য হবেন একজন জেলা জজ। নিয়োগের শর্তাবলি সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হবে। প্রশাসনিক আপীল ট্রাইব্যুনাল সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আপীল ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় ১৯৮৩ সালের ২২ আগস্ট।

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের কোন আদেশ বা সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আপীল শুনানী এবং সিদ্ধান্ত প্রদানের বিষয় আপীল ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভুক্ত। কোন ব্যক্তি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত যেকোন আদেশ বা সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হলে এ ধরনের আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার দিন থেকে পরবর্তী দ’ুমাসের মধ্যে আপীল দাখিল করার সুযোগ পাবেন। আপীল ট্রাইব্যুনাল প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের যেকোন আদেশ বা সিদ্ধান্ত বহাল রাখা, বাতিল, দ্বিমত পোষণ অথবা পরিবর্তন করতে পারেন। আপীল ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক প্রদত্ত আদেশই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। ট্রাইব্যুনালের ক্ষমতা ও কার্যপ্রণালীও এ আইনে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের সকল কার্যবিবরণী বিচার বিভাগীয় কার্যপ্রণালী হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের এক্তিয়ার এবং হাইকোর্টের রীটের এক্তিয়ারের মধ্যকার পার্থক্য সুস্পষ্ট নয়। প্রজাতন্ত্রের চাকুরিতে নিয়োজিত কর্মচারীদের চাকুরির শর্তাবলি সম্পর্কিত বহু মামলা হাইকোর্টে রুজু করা হচ্ছে। সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তিতে এসব অভিযোগ দায়ের করা হয়।

বর্তমানে দুটি প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে, একটি ঢাকায় এবং অপরটি বগুড়ায়। এছাড়া আরও কিছু ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষ কমিশন রয়েছে, যেমন ইনকাম ট্যাক্স ট্রাইব্যুনাল, সিকিউরিটিস একচেঞ্জ কমিশন এবং ট্যাক্সেস সেটেলমেন্ট কমিশন।   এছাড়াও করদাতাদের আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য রয়েছেন পৃথক ন্যায়পাল।  [এ.এম.এম শওকত আলী]