নবায়নযোগ্য শক্তি

নবায়নযোগ্য শক্তি (Renewable Energy) যে কোন উৎস থেকে প্রাপ্ত শক্তি নিজেই পুনরায় শক্তির উৎস। সর্বাপো নবায়নযোগ্য পদ্ধতি সরাসরিভাবে সৌরশক্তি অথবা আবহাওয়া চক্রের মাধ্যম, যেমন তরঙ্গশক্তি, জলবিদ্যুৎশক্তি বা বাতাসের শক্তির উপর নির্ভরশীল। এ ছাড়াও জোয়ার-ভাটার শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে চাঁদের মহাকর্ষ বলকে কাজে লাগানো যেতে পারে, এবং পৃথিবীর কেন্দ্রাঞ্চলের উষ্ণ ভূ-তাপীয় শক্তি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নবায়নযোগ্য শক্তির ক্রয়মূল্য শূন্য। নিঃশেষিত হয় না এমন উৎসসমূহ এবং এর রূপান্তরিত শক্তি (emission) এবং তেজস্ক্রিয়া মুক্ত, যা এক্ষেত্রে গতানুগতিক জীবাশ্ম জ্বালানি (তেল, গ্যাস, এবং কয়লা) ও পারমাণবিক বিভাজন উপকরণাদি থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী।

এখানে উল্লেখ্য, গতানুগতিক শক্তি পদ্ধতির সাথে তুলনায় নবায়নযোগ্য শক্তি পদ্ধতির নির্দিষ্ট কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ (১) অত্যন্ত নিম্ন রূপান্তর ক্ষমতা (২) অত্যন্ত উচ্চ পুঁজি ব্যয়, (৩) একটিমাত্র বৃহদাকার রূপান্তর স্থাপনার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন যোগ্যতা না থাকা, (৪) উৎসের সহজলভ্যতার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা। সবিরাম প্রকৃতির কারণে কিছু প্রথাগত শক্তি উৎস, যদি অব্যাহত সরবরাহ জরুরি হয় সেেেত্র কার্যকর সহায়তা প্রদান করে। তৎসত্ত্বেও বর্ধিত সংখ্যক উন্নয়নশীল এবং উন্নত দেশসমূহের বৈদ্যুতিক শক্তির ক্ষেত্রে, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রক্রিয়া বিঘ্নের সৃষ্টি করছে যদিও তা ঘটছে ধীর গতিতে। উন্নত দেশগুলির শক্তি ক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য উৎসসমূহের প্রবেশ ঘটেছে মূলত জীবাশ্ম জ্বালানি ও পারমাণবিক শক্তি স্থাপনা সম্পর্কে এবং বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রক্রিয়া প্রতিরোধে পরিবেশগত প্রতিবিধানে কঠোর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে। বাংলাদেশে গতানুগতিক সম্পদ ৫০ বৎসরের মতো দীর্ঘ সময়ের জন্য তাৎপর্যময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহে অপর্যাপ্ত বলেই প্রতীয়মান হবে। অতএব, দেশে সহজলভ্য নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং এসব থেকে শক্তি ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন খুবই জরুরি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপনাসমূহ প্রধানত দূরবর্তী স্থানসমূহের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়, কেননা গ্রিড থেকে শক্তি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য।

নবায়নযোগ্য উৎসসমূহের অভ্যন্তরস্থ শক্তিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন ধরনের শক্তিতে রূপান্তর করা যেতে পারে যেমন যান্ত্রিক, তাপসংক্রান্ত এবং বৈদ্যুতিক। যেহেতু বিদ্যুৎ হলো সর্বাপো উপযোগী ধরনের শক্তি, তাই নিুের আলোচনায় নবায়নযোগ্য উৎসসমূহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপর মূলত আলোকপাত করা হয়েছে।

জলবিদ্যুৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি সস্তা এবং সুগঠিত পদ্ধতি। পানির অন্তর্নিহিত এবং/বা গতিসঞ্জাত শক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে; যেমন প্রথাগত জল, তরঙ্গ এবং স্রোত বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মকাণ্ড। প্রথাগত জলবিদ্যুৎ স্থাপনায় নদীর উপর প্রতিবন্ধক বা বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জলাধার সৃষ্টি করা হয়ে থাকে যাতে টারবাইনকে (ঘূর্ণি চাকা) পানির প্রবল প্রবাহের চাপে পরিচালিত করা যায়। জলাধারের ধারণ ক্ষমতা এবং পানির শীর্ষের উপর নির্ভর করে জলবিদ্যুৎ স্থাপনাসমূহকে বিন্যস্ত করা হয় তিনটি শ্রেণীতে– বৃহৎ (পানি শীর্ষ ৩০ মিটারের উপরে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তি ৫ মেগাওয়াটের উপরে),ক্ষুদ্র (পানি শীর্ষ ২৫ থেকে ৩০ মিটার, উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তি ৫০০ কিলোওয়াট থেকে ৫ মেগাওয়াট) এবং অতিুদ্রায়তন (পানি শীর্ষ ৩ থেকে ১৫ মিটার, উৎপাদিত বিদ্যুৎ শক্তির পরিমাণ ১০ থেকে ৫০০ কিলোওয়াট)।

বাংলাদেশের মতো দেশে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ অত্যন্ত সীমিত, কারণ দেশটি উত্তরপূর্ব ও দণিপূর্বের কিছু পাহাড়ি এলাকা এবং উত্তর ও উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের কিছু উচ্চভূমি ছাড়া মূলত নিম্ন ও সমতলভূমির। দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি হলো কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, যার ৭টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট (৫০ মেগাওয়াটের ৩টি এবং অপর ৪টির প্রত্যেকটির ক্ষমতা ২০ মেগাওয়াট)। কর্ণফুলি নদীর উপর নির্মিত এ প্রকল্পটির অবস্থানস্থল কাপ্তাই।

এছাড়া, ১৯৮০-র দশকে পরিচালিত কিছুসংখ্যক প্রকল্পের সম্পাদনযোগ্যতা সমীায় দেখা গেছে ১০ থেকে ১০০ কিলোওয়াট মতাসম্পন্ন ুদ্রায়তন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্যতা রয়েছে ১৫টি নদী/ছড়ার। এগুলো হলো: সাঙ্গু নদী (তারাসা ছড়া এবং দোহাজারি), মাতামুহুরী নদী (চাম্পাতলী, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা), তিস্তা নদী, ফয়ে’জ লেক (পাহাড়তলী থানা, চট্টগ্রাম), ছোট কুমিরা (সীতাকুণ্ড উপজেলা, চট্টগ্রাম), হিঙ্গুলি ছড়া (মিরসরাই উপজেলা, চট্টগ্রাম), সুয়ালাক নদী (বান্দরবান), নিখারি ছড়া (বড়লেখা উপজেলা, মৌলভীবাজার), মাধবছড়া (বড়লেখা, মৌলভী বাজার), রাঙ্গাপানি গাঙ (জৈন্তাপুর উপজেলা, সিলেট), ভুগাই-কাঙ্গসা (নালিতা বাড়ি উপজেলা, শেরপুর), মারিসি নদী (ঝিনাইগাতি, শেরপুর), পুনর্ভবা (সিঙ্গরাবন, ঠাকুরগাঁও), তালমা (পঞ্চগড়), এবং পথরাজ (ফুলবাড়ি উপজেলা, দিনাজপুর)। হিসাব করে দেখা গেছে সর্বমোট বাৎসরিক, চট্টগ্রাম-বান্দরবান এলাকায় ১,১৫৬,৩২০ কিলোওয়াট; সিলেট- মৌলভীবাজার এলাকায় ৬,৩০৫,০৪১ কিলোওয়াট; ময়মনসিংহ-শেরপুর এলাকায় ৮৫৮,৩৩৬ কিলোওয়াট এবং দিনাজপুর-রংপুর এলাকায় ১,৮৭০,৭৫২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হতে পারে।

জোয়ারভাটা ও তরঙ্গ বিদ্যুৎ জোয়ারের সময় উপকূলীয় অববাহিকায় পানিকে আটকে রাখা যেতে পারে, ভাটার সময় এ পানি শীর্ষগত তারতম্য সৃষ্টি করবে এবং এই পানি শীর্ষকে টারবাইন বা জলচক্র ঘূর্ণন বা পরিচালনায় ব্যবহার করা যেতে পারে। ফ্রান্সের রেনস নদীর মোহনায় ২৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন জোয়ার-ভাটা বিদ্যুৎ স্থাপনা রয়েছে। কানাডা, রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এ সংক্রান্ত জরিপ সম্পন্ন করেছে এবংএক্ষেত্রে প্রস্তাবনাসমূহ স্ব স্ব সরকার কর্তৃক মূল্যায়িত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেশটির দেিণর উপকূলীয় অঞ্চলে এর চমৎকার সম্ভাবনা রয়েছে।

সমুদ্র তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে তরঙ্গের উচ্চতা এবং তরঙ্গ স্থায়িত্বের উপর। আন্দোলিত পানিস্তম্ভ পদ্ধতি প্রায়োগিক বিদ্যাগত ভাবে কার্যকর এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে আকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হয়। এ ধরনের তরঙ্গশক্তির ব্যবহার কৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে বিভিন্ন দেশ, যেমন: যুক্তরাজ্য (৫০০ কিলোওয়াট), আয়ারল্যান্ড (৩.৫ মেগাওয়াট), নরওয়ে (১০০ কিলোওয়াট), ভারত (১৫০ কিলোওয়াট) ইত্যাদি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বঙ্গোপসাগর থেকে তরঙ্গশক্তি কাজে লাগানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

'সৌরশক্তি সূর্যরশ্মি থেকে আহৃত শক্তি। আংশিক পরিবাহী উপকরণ (সাধারণত সিলিকন) নির্মিত সৌর কোষসমূহের (ফটোভোল্টিক বা পিভি কোষ) প্যানেল ব্যবহার করে সৌরশক্তি ধরে রাখা হয়। এটিকে সূর্যালোক দ্বারা আলোকিত করা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান (২০°৩৪'-২৬°৩৮' উত্তর আংশ) এক্ষেত্রে অনুকূলে, একমাত্র জুন থেকে আগস্ট– প্রচুর বৃষ্টিপাতের এই তিন মাস ব্যতীত বৎসরের অধিকাংশ সময় জুড়ে বিদ্যমান প্রচুর সূর্যালোককে কাজে লাগানো সম্ভব। বাংলাদেশে সৌরশক্তি প্রাপ্যতার পরিমাণ উচ্চ পর্যায়ের, প্রতি বর্গমিটারে ৫ KHW/দিন অথবা দেশের সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠ এলাকায় ২.৬ ১০১১ MWH/বৎসর। দেশের সমগ্র বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করার জন্য এ পরিমাণ যথেষ্ট। প্রাপ্ত সৌরশক্তির অতি সামান্য পরিমাণ অংশ ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষিজাত ফসল খোলা জায়গায় শুকানো, সমুদ্রের পানি থেকে লবণ উৎপাদন, কাপড় শুকানো প্রভৃতি। এই শক্তি ফলপ্রদ এবং cost effective-ভাবে এটিকে ব্যবহারের জন্য, আস্থাযোগ্য সৌরশক্তি কৌশলের সর্বাধিক অনুকূল নকশা এবং পদ্ধতিসমূহকে উন্নত করতে হবে। বহু বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), ঢাকা কলেজের সৌর পার্ক (সৌরশক্তি গবেষণা কেন্দ্র), এবং বিসিএসআইআর-এর গবেষণাগারসমূহ তাপ হিসেবে সৌরশক্তি ধরে রাখা সম্পর্কিত গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সৌর পানি চুল্লির ভিন্ন ভিন্ন ধরন উদ্ভাবিত এবং পরীতি হয়েছে। সিএইচওজিআরএম (কমনওয়েলথ সরকার প্রধানদের আঞ্চলিক সংঘ) কর্মসূচির আওতায় স্থানীয়ভাবে সর্বাপো সহজপ্রাপ্য উপকরণ ব্যবহার করে দুটি ‘সৌর শক্তি দ্বারা পানি উষ্ণ করণ’ প্রণালী উদ্ভাবন করা হয়েছিল, যার ক্ষমতা ছিল প্রতিদিন গড়ে ৫৫°-৬০° সে তাপমাত্রায় ৪০০ লিটার পানিকে উষ্ণ করা। উল্লিখিত উষ্ণ পানি প্রণালীর গবেষণা পর্যায়ের সাফল্য প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুদ্র পর্যায়ের শিল্প-কারখানায় প্রতি বৎসরে ৩৩০-৩৫০ দিন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। এই তাপমাত্রার পানি হোটেল, হাসপাতাল এবং ক্ষুদ্রশিল্প – কারখানার জন্য প্রয়োজনীয়। বিসিএসআইআরএ অধিবৃত্ত প্রতিফলক ধরনের সৌরচুল্লি উদ্ভাবিত এবং পরীতি হয়েছে। এ ধরনের সৌরচুল্লি ব্যবহার করে রান্না সম্ভব বৎসরের সেই কয়েক মাসে যখন সৌররশ্মি বিচ্ছুরণ উচ্চমাত্রায় হয়, কিন্তু বর্ষা মৌসুমে এসব চুল্লি সূর্যালোকের নিুমাত্রার তীব্রতার কারণে কাজ করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্র বাক্স ধরনের সৌরচুল্লি তৈরি করেছে। এ চুল্লিতে শক্তি উৎস হিসেবে বিদ্যুৎ ও সৌরশক্তি উভয়ই ব্যবহৃত হতে পারে। দিনের উজ্জ্বল সূর্যালোকের সময়ে চুল্লিতে সৌরশক্তি ব্যবহার করা হয় এবং যখন আলোর স্বল্পতা থাকে তখন এতে সামান্য বিদ্যুৎ সাহায্যকারী উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের চুল্লি যেসব স্থানে বিদ্যুৎ আছে সেখানে বাড়ি, চায়ের দোকান, কমিউনিটি সেন্টারে ব্যবহৃত হতে পারে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত বিদ্যুতের বেশিরভাগ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ডিজেল ব্যবহার করে। সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৮% মানুষ জাতীয় গ্রিড লাইনের সংযোগের আওতায় এসেছে। গ্রাম এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা অপ্রতুল, এমনকি যদি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দেশের প্রায় সব গ্রামে বিদ্যুৎ গ্রিড লাইন পৌঁছেও দেয়, যা সম্পাদন করার কাজটি হবে অতিমাত্রায় অসুবিধাজনক এবং ব্যয়বহুল, তারপরেও গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া সম্ভব হবে না মানুষের দারিদ্র্যের কারণে। এক্ষেত্রে ফটোভল্টাইক পদ্ধতি গ্রামে শক্তি সরবরাহ করতে পারে যেখানে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নেই।

বর্তমানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) এর দুইটি প্রধান সৌর ফটোভোল্টাইক স্থাপনা রয়েছে। এর একটি কাপ্তাইয়ে, বৃষ্টিপাত পরিমাপন কেন্দ্রের জন্য এবং অন্যটি আরিচায়, পূর্ব-পশ্চিম সংযোগকেন্দ্রের জন্য। কিছু প্রেরণ টাওয়ারেও (উদাহরণ স্বরূপ চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদী পারাপারে) আলোর জন্য সৌর ফটোভোল্টাইক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।

১৯৯৮ সালে সমস্ত দেশ জুড়ে পৃথকভাবে বাস্তবায়িত বিভিন্ন ফটোভোল্টাইক প্রকল্পের সর্বমোট উচ্চ ক্ষমতা ছিল ১৫০ KWpk এর মতো (উচ্চ সূর্যালোকের উচ্চমাত্রার সময়ে কিলোওয়াট)। এ-পদ্ধতি প্রধানত গ্রিড লাইন থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকাসমূহ এবং চা বাগানগুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এসব এলাকার ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র ও হাসপাতালসমূহে এবং কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বিভিন্ন কার্যক্রমে বিদ্যুৎ চাহিদা পরিপূরণে যেমন– বাড়িতে আলোর ব্যবস্থা, পানি উত্তোলন, সতর্ক সংকেত ও যোগাযোগে এবং জরুরি ঔষধ বা টিকা সংরক্ষণ ইত্যাদিতে উল্লিখিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এসব স্থাপনার স্বত্তাধিকারীরা হলো পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, কিছু বেসরকারি সংস্থা (এনজিও), বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশন (বিএইসি), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) এবং কিছু ব্যক্তিগত পর্যায়ের উদ্যোক্তা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকল্পের একটি হল নরসিংদীর দূরবর্তী গ্রামে আরইবি-র ৬২ KWpk স্থাপনা এবং আর একটি ২ KWpk স্থাপনা যা সিলেটের একটি চা বাগানে অবস্থিত।

বাংলাদেশে বর্তমানে কিছুসংখ্যক দেশীয় সংস্থা ছোট ও মাঝারি সৌরশক্তি প্রণালীর জন্য ফটোভল্টাইক সৌর প্যানেল এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ তৈরি করছে। একটি সাধারণ পিভি গৃহ আলোক ব্যবস্থা, যার মধ্যে রয়েছে একটি ৪০ Wpk মডিউল, একটি ১০০ এ এইচ (অ্যাম্পস-ঘণ্টা) বিদ্যুৎ কোষ এবং এক জোড়া ডিসি ফোরেসেন্ট বাতি ২০০০, বাজারদর অনুযায়ী যার স্থানীয় মূল্য ২৫ টাকা।

হাইড্রোজেন শক্তি মহাবিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ এবং সরলতম উপাদান হলো হাইড্রোজেন। জ্ঞাত জ্বালানির মধ্যে হাইড্রোজেনে প্রতি এককে সর্বাপেক্ষা উচ্চ শক্তি সঞ্চিত রয়েছে প্রতি পাউন্ডে ৫২.০০০ বিটিইউ বা প্রতিগ্রামে ১২০.৭ কিলোজুল। অধিকন্তু, যখন হাইড্রোজেনকে শীতল করে তরল করা হয় তখন এই নিম্ন ওজনের জ্বালানির গ্যাসীয় অবস্থায় স্থান অধিকারের মাত্রাগত বিস্তৃতি ১/৭০০-এ দাঁড়ায়। রকেট এবং নভোযানকে প্রবলভাবে সম্মুখ দিকে চালনার জন্য জ্বালানি হিসেবে হাইড্রোজেন ব্যবহারের এটি একটি কারণ। উক্ত কাজে এ ধরনের নিম্ন ওজন, ঘন সন্নিবিষ্ট এবং উচ্চ শক্তিসম্পন্ন জ্বালানির প্রয়োজন। দেশের একমাত্র হাইড্রোজেন শক্তি স্থাপনাটি চট্টগ্রামে অবস্থিত যা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের একটি সহায়ক ইউনিট হিসেবে কাজ করছে। এই ইউনিট প্রাকৃতিক গ্যাসের বাষ্পীভবন থেকে ৯৯.৯% বিশুদ্ধ হাইড্রোজেন উৎপাদন করে। হাইড্রোজেন ইস্টার্ন রিফাইনারির মূল উৎপাদন কর্মকাণ্ডে একটি আনুষঙ্গিক উৎপাদিত দ্রব্য। হাইড্রোজেনের উৎপাদনের পরিমাণ স্বল্প এবং তা বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহৃত হয়।

বায়ুপ্রবাহ শক্তি শক্তি ব্যবহারের প্রথমদিকে কয়েক শতাব্দী ব্যাপী বায়ুপ্রবাহকে ব্যবহার করা হতো জাহাজ চালনায়, বাতাস কল চালনায়, পানি উত্তোলনে, জমিতে সেচকার্যে এবং অন্যান্য অসংখ্য উদ্দেশ্যে। বায়ুপ্রবাহের গতিসঞ্জাত শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রয়োজনীয় বায়ুপ্রবাহের নিুতম গড় গতিবেগ ২১.৬কিমি/ঘণ্টা, যা ১১.৬৭ নটের সমপরিমাণ (১নট=১.৮৫ কিমি/ঘণ্টা)। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে প্রবাহিত বাতাসের বাৎসরিক গড় গতিবেগ মাত্র ২ থেকে ৩ নট, যা বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপযোগী নয়। অবশ্য, কিছু নির্দিষ্ট বিশেষ স্থান– যেমন পতেঙ্গা (চট্টগ্রাম), কক্সবাজার এবং অভ্যন্তর ভূমির যশোর যা সমুদ্র থেকে খুব দূরে নয়, এসব এলাকায় জুন ও আগস্ট মাসের কিছু নির্দিষ্ট দিনে মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টা সময়ের জন্য (একাধারে নয়) বায়ুপ্রবাহের গড় গতিবেগ প্রয়োজনীয় নিম্ন গতিবেগের কাছাকাছি থাকে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ এবং যুক্তরাজ্যের এনার্জি টেকনোলজি সাপোর্ট ইউনিটের সহযোগিতায় বায়ুপ্রবাহ সম্পদ পরিমাপের নিমিত্তে একটি প্রকল্প (যা ডব্লিউইএসটি নামে পরিচিত) গ্রহণ করেছে। এর আওতায় নির্বাচিত ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সাল জুড়ে অব্যাহত পরিমাপ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এবং এর ভিত্তিতে ১৯৯৮-এর জানুয়ারিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসব স্থানের ২৫ মিটার উচ্চতায়, পূর্বে টেকনাফ প্রান্তের উপকূলীয় রেখা থেকে আরম্ভ করে পরিমাপ কার্য সমাপ্ত হয় সুন্দরবন প্রান্তে। সাতটি কেন্দ্রে পরিমাপকৃত গড় বাৎসরিক গতিবেগের পরিসীমাটি হলো ২.৯৬ মিটার/সেকেন্ড (টেকনাফে এবং নোয়াখালীতে) থেকে ৪.৫৪ মিটার/সেকেন্ড (কুয়াকাটায়)। স্পষ্টতই, বিদ্যুৎ উৎপাদনে এই মাত্রা খুব অনুকূল বায়ুপ্রবাহ-গতিবেগ নয়, যদিও এক্ষেত্রে কুয়াকাটা, কুতুবদিয়া বা চরফ্যাশনের মতো সুনির্বাচিত স্থান রয়েছে। তবে ডব্লিউইএসটি প্রকল্পের হিসাব অনুযায়ী দেখা যায় এ অবস্থায়ও বাৎসরিক সর্বমোট একটি ১৫০ KW মতাসম্পন্ন টারবাইন সহ ১৫০ MWH বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদন সম্ভব।

উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক কিছুসংখ্যক ক্ষুদ্র ‘বায়ুশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থাপনা’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ‘গ্রামীণ শক্তি’ কর্তৃক এর চকোরিয়া চিংড়ি খামারে প্রতিষ্ঠিত স্থাপনা (১ কিলোওয়াট, ৩০০ ওয়াট এবং অপর আর একটি কার্যক্রম ব্র্যাক ও জিটি জেড (একটি জার্মান এনজিও) পরিচালিত। ব্র্যাক একাই বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় ১১টি বায়ু টারবাইন স্থাপন করেছে। প্রতিষ্ঠার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে এবং ২০০২ সালের মধ্যে এসব স্থাপনা উৎপাদনে যাবে। এর মধ্যে তিনটি ১.৫ কিলোওয়াট মতাসম্পন্ন ও চতুর্থটির ক্ষমতা ১০ কিলোওয়াট।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বায়ুপ্রবাহ, মিনি-মাইক্রো পানি, তরঙ্গ বা জোয়ার-ভাটা ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনায় ফটোভোল্টাইক উৎপাদন, অধিক সম্ভাবনাময় এবং টেকসই। সূর্যালোকের সহজ প্রাপ্যতার অনিশ্চয়তার মাত্রা এবং এর সংরক্ষণের অসুবিধা তুলনামূলকভাবে পরবর্তীগুলোর চেয়ে অনেক কম, যদিও পিভি মডিউলের পুঁজি ব্যয় বায়ু এবং পানি বিদ্যুতের চেয়ে বেশি। গতানুগতিক উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ব্যয়ের ক্ষেত্রে পিভি উৎপাদন থেকে প্রতিযোগিতা করতে পারে না, কিন্তু গ্রিড লাইন থেকে দূরবর্তী বাংলাদেশের ব্যাপক সংখ্যক স্থানের গ্রামীণ জনসমষ্টি ও উপকূলবর্তী বাসিন্দাদের মধ্যে এ সেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অধিকন্তু, আংশিক পরিবাহী উপকরণ এবং যান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার উপর অব্যাহত গবেষণার ফলে পিভি মডিউলের উৎপাদন ব্যয় দ্রুত গতিতে কমে আসছে এবং আশা করা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে তা গতানুগতিক উৎপাদন পদ্ধতির সাথে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে উপনীত হবে। [শাহনেওয়াজ আহমেদ ও রফিকুল ইসলাম]