নওয়াব

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ০৮:৪৯, ২৬ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

নওয়াব  মুগল প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পদমর্যাদা ও ক্ষমতা নির্দেশক একটি পদবি। ব্রিটিশ যুগে কোনো দপ্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট না হয়েও এটি রাষ্ট্র কর্তৃক সম্মানসূচক উপাধি হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। নওয়াব শব্দটি আরবি নায়েব (প্রতিনিধি) শব্দের বহুবচন; কিন্তু তা একবচন হিসেবে ব্যবহূত। হিন্দি ভাষায় পূর্বের মতো এখনও নওয়াব শব্দটির উচ্চারণ করা হয় নবাব। সেকালে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা যেহেতু হিন্দি ভাষা দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন, সেহেতু তারা সাধারণত হিন্দি রীতিতেই উচ্চারণ করতেন। উনিশ শতকের বাঙালি লেখকগণ তাঁদের লেখায় ‘নওয়াব’ ও ‘নবাব’ দুভাবেই এর ব্যবহার করেছেন। বর্তমানেও শব্দদুটি বাঙালিদের কাছে অভিন্ন অর্থ বহন করে।

কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসেবে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে নওয়াব নিয়োগ করা হতো। কিন্তু পূর্ব ভারতের তিনটি প্রদেশে (বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা) নওয়াব নামে কোনো দাপ্তরিক পদ ছিল না। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এটি খেতাব হিসেবে ব্যবহূত হতো। মুগলদের অতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় একই পদমর্যাদা সম্পন্ন পরস্পর স্বাধীন দুজন কর্মকর্তা  সুবাহর (প্রদেশ বা কয়েকটি প্রদেশের সমষ্টি) শাসন পরিচালনা করতেন। এঁদের একজন ছিলেন সুবাহদার যিনি প্রশাসন এবং সেই সংঙ্গে বিচার ও প্রতিরক্ষা (এ দুটিকে একত্রে নিজামত বলা হতো এবং সুবাহদার নাজিম হিসেবে পরিচিত হতেন) ব্যবস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন এবং অন্যজন ছিলেন দীউয়ান যিনি রাজস্ব প্রশাসনের (দীউয়ানি) দায়িত্বে নিয়োজিত থাকতেন। এ দুজনই সম্রাট কর্তৃক সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত এবং সম্রাটের কাছেই দায়বদ্ধ ছিলেন।

একসময় এখতিয়ারের প্রশ্নে নাজিম বা সুবাহদার শাহজাদা আজিম-উস-শান (সম্রাট আওরঙ্গজেবের পৌত্র) এবং দীউয়ান মুর্শিদকুলী খানের (বিভিন্ন সময় তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন) মধ্যে ঘোরতর দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক এতটাই শত্রুভাবাপন্ন হয়ে পড়ে যে, মুর্শিদকুলী খান এ সমস্যার সমাধানের জন্য ১৭০২ সালে তাঁর দফতর রাজধানী ঢাকা থেকে মকসুদাবাদে স্থানান্তর করেন। পরে তাঁরই নামানুসারে স্থানটির মুর্শিদাবাদ নামকরণ হয়। সম্রাটের নির্দেশে সুবাহদার আজিম-উস-শান পরের বছর তাঁর নিজ নিজামত দফতর পাটনায় স্থানান্তর করেন এবং তখন থেকে বাংলার সুবাহদারি (সুবাহদারের অনুপস্থিতিতে) পাটনা থেকেই পরিচালিত হতে থাকে।

এ সময় হতে একজন নায়েব বা প্রতিনিধি অনুপস্থিত সুবাহদারের পক্ষে নিজামত বা সুবাহ বাংলার বেসামরিক প্রশাসন পরিচালনা করতেন। কিন্তু ১৭১৩ সালে মুর্শিদকুলী খান অপ্রাপ্তবয়স্ক সুবাহদারের (সম্রাট  ফররুখ সিয়ারের পুত্র ফরখুন্দ সিয়ার) নায়েব নিযুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের নাম ও পরম্পরা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। এ নাবালক সুবাহদারের মৃত্যুর পর সম্রাট মুর্শিদকুলী খানকে ১৭১৫ সালে (মতান্তরে ১৭১৭) বাংলার নিয়মিত সুবাহদার হিসেবে নিয়োগদান করেন। এ সময় থেকেই প্রথমবারের মতো সুবাহদার ও দীউয়ানের দায়িত্ব একই ব্যক্তির উপর ন্যস্ত করা হয়। বস্ত্তত মুর্শিদকুলী খান তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা এবং প্রদেশের অভিজাত শ্রেণি ও নেতৃস্থানীয় বণিকদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সাফল্যজনকভাবে সুবাহর উপর তার দোর্দন্ড কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। দ্রুত পতনোন্মুখ কেন্দ্রীয় সরকার এ অবস্থাকে মেনে নেয়। প্রকৃত ক্ষমতাবঞ্চিত সম্রাট মুর্শিদকুলী খান কর্তৃক নিয়মিত প্রেরিত উপহার ও রাজস্ব পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন।

মুর্শিদকুলী খানের সময় থেকে সুবাহদারি প্রকৃত অর্থে আর কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। এটি ক্রমে মসনদ বা সিংহাসনে পরিণত হয় যাতে পর পর অধিষ্ঠিত হন সুজাউদ্দীন খান (১৭২৯-১৭৩৯), সরফরাজ খান (১৭৩৯-১৭৪০), আলীবর্দী খান (১৭৪০-১৭৫৬) ও সিরাজউদ্দৌলা (১৭৫৬-১৭৫৭)। এঁদের সকলেই নিজেদের স্বাধীন শাসক মনে করলেও আইনগত ভিত্তির প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে সম্রাটের কাছ থেকে সনদ সংগ্রহের চেষ্টা করতেন।

মুর্শিদকুলী খান থেকে শুরু করে সিরাজউদ্দৌলার সময় নওয়াবি যুগ নামে পরিচিত, যদিও এঁদের কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে নওয়াব খেতাব গ্রহণ করেন নি। দরবারে অভ্যাগতরা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ব্যক্তিকে নওয়াব হিসেবে নয়, নাজিম হিসেবেই সম্মান জানাতেন। যেহেতু ফরমান জারি করা শুধু সম্রাটের এখতিয়ারভুক্ত ছিল তাই নাজিমগণ পরওয়ানা জারি করতেন, ফরমান নয়। এদের প্রত্যেকেই প্রথাগতভাবে কেন্দ্র থেকে সুবাহদারি সনদ সংগ্রহ করতেন, যদিও সর্বতোভাবে তারা ছিলেন স্বাধীন। সমকালীন লেখক ও প্রত্যক্ষদর্শীরাও বরাবর তাঁদের নাজিম বা সুবাহদার বলে উল্লেখ করেছেন।

একথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, প্রতিনিধি অর্থে ‘নওয়াব’ উপাধির প্রচলন ইউরোপীয়গণ বিশেষত ইংরেজ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই হয়েছে। এঁরা বরাবরই নাজিমকে বোঝাতে ‘নওয়াব’ বা ‘নবাব’ শব্দ ব্যবহার করতেন। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিয়োজিত সকল ইউরোপীয় কোম্পানি সম্রাটের কাছ থেকে অনেক বাণিজ্যিক অধিকার ও সুবিধা লাভ করে। কিন্তু বাংলার শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই সবসময় তা প্রয়োগ করতে দিতেন না। কোম্পানিগুলি প্রায়শ আইনগত যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করত যে, নায়েব বা সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে সম্রাটের সনদ ও ফরমান মেনে চলা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

পলাশী বিপর্যয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ  মীরজাফর আলী খানকে ‘নওয়াব’ উপাধি দিয়ে (পূর্বের ন্যায় নায়েব নাজিম বা সুবাহদার নয়) বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার মসনদে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর উত্তরাধিকারীদেরও নওয়াব বলা হতো। ১৭৯৩ সালে নিজামতের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি এবং মুর্শিদাবাদের নবাব নতুন উপাধি দিয়ে নওয়াবকে রাষ্ট্রের একজন পেনশনভোগীতে পরিণত করা হয়।

১৭১৫-১৬ সালে মুর্শিদকুলী খান বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সুবাহদার হন এবং একই সময়ে ঢাকা থেকে পূর্ববাংলার প্রশাসন পরিচালনার জন্য নায়েব (নবাব) নাজিমের একটি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ঢাকার প্রথম নায়েব নাজিম ছিলেন খান মুহম্মদ আলী খান। ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত নায়েব কর্তৃক নায়েব নাজিমগণ নিয়োগ লাভ করতেন, কিন্তু এরপর থেকে ফোর্ট উইলিয়ম কাউন্সিলের অনুগ্রহভাজন ব্যক্তিরাই এ পদে অধিষ্ঠিত হতেন। ১৭৬৫ সাল থেকে নায়েব নাজিম পদটি জসরত খানের পরিবারের জন্য বংশানুক্রমিক পদে পরিণত হয়। জসরত খান ১৭৫৫-৬২ সালে একবার এবং ১৭৬২-৬৩ সালে দ্বিতীয়বার নায়েব নাজিম পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৭৬৩ সাল থেকে নায়েব নাজিমের পদটি উত্তরাধিকারভিত্তিক হয়ে পড়ে। ১৭৯৩ সালে ঢাকার নায়েব নাজিম উপাধিসহ এ পরিবার পেনশনভোগীতে পরিণত হয়। ১৮৪৩ সালে ঢাকার নায়েব নাজিমের খেতাবসার পদটি আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। নিয়াবতের শেষ উত্তরাধিকারী ছিলেন গাজীউদ্দীন হায়দার (১৮৩৪-৪৩)।

উনিশ শতকে ‘নবাব’ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। বাংলার শাসক শ্রেণিকে জনহিতকর কাজে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে অকল্যান্ড প্রশাসন (১৮৩৬-৪২) জনকল্যাণ ও সামাজিক কর্মকান্ডে নিয়োজিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে সম্মানসূচক খেতাব দেওয়ার পদ্ধতি চালু করে। মুসলিম অভিজাতদের জন্য নির্ধারিত ভিন্ন ভিন্ন পদমর্যাদার খেতাবগুলি ছিল নওয়াব, খান সাহেব, খান বাহাদুর প্রভৃতি। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত নওয়াব খেতাবধারী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ছিলেন নওয়াব  খাজা আব্দুল গণি (১৮১৩-১৮৯৬), নওয়াব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩), নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী (১৮৩৪-১৯০৪),  নওয়াব আলী চৌধুরী (১৮৬৩-১৯২৯), নওয়াব শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২২), নওয়াব সিরাজুল ইসলাম (১৮৪৮-১৯২৩) প্রমুখ। সাধারণত নওয়াব উপাধিটি ভূমি মালিকানা সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীরাই পেতেন এবং উপাধিটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জমিদারি বা গ্রামের নামও যুক্ত করা হতো, যেমন ঢাকার নওয়াব, ধনবাড়ীর (টাঙ্গাইল) নওয়াব, রতনপুরের (কুমিল্লা) নওয়াব ইত্যাদি।

আঠারো শতকের শেষ ও ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশ সমাজে এক শ্রেণির অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নবব (nabob) (নওয়াব>নবাব>নবব) নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ভারত থেকে অপরিমেয় সম্পদ নিয়ে যেসব অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ব্রিটেনে ফিরে তাদের সম্পদকে শক্তি ও সম্পত্তিতে পরিণত করেন, ব্রিটেনের সমসাময়িক লোকেরা তাদেরকে ব্যঙ্গ করে ‘নবব’ বলতেন। সাধারণ লোক ‘নবব’ বলে বিদ্রূপ করলেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে তারা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। এর প্রমাণ সমকালীন ইংরেজি সাহিত্যে রয়েছে। এ নববগণ তাদের অর্থসম্পদ ও অভিজ্ঞতার কারণে পার্লামেন্ট, চেম্বার অব কমার্স, নৌ-পরিবহণ, ব্যাঙ্ক কার্যক্রম, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কোর্ট অব ডাইরেক্টর্সএর সদস্যপদ এবং অর্থ দিয়ে কেনা যায় এমন পদে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করতে সক্ষম হন।  [সিরাজুল ইসলাম]