দ্বিজাতিতত্ত্ব: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

সম্পাদনা সারাংশ নেই
(Text replacement - "সোহ্রাওয়ার্দী" to "সোহ্‌রাওয়ার্দী")
 
১৮ নং লাইন: ১৮ নং লাইন:
দ্বিজাতিতত্ত্বের শূণ্যগর্ভ অবস্থা প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদগণ যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতাকে প্রমাণ করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থকগণের জবাব হল যে, বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসরণ করেছে বলেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়েছে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গৃহীত দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্দীপনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।  [সিরাজুল ইসলাম]
দ্বিজাতিতত্ত্বের শূণ্যগর্ভ অবস্থা প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদগণ যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতাকে প্রমাণ করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থকগণের জবাব হল যে, বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসরণ করেছে বলেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়েছে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গৃহীত দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্দীপনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।  [সিরাজুল ইসলাম]


''আরও দেখুন''  [[জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী|মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ]]; [[কেবিনেট কমিটি|কেবিনেট কমিটি]]; [[পাকিস্তান|পাকিস্তান]]; [[সোহ্রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|হেসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী]]; [[হাশিম, আবুল|আবুল হাশিম]]; [[সাম্প্রদায়িকতা|সাম্প্রদায়িকতা]]; [[সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক|সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক]]।
''আরও দেখুন''  [[জিন্নাহ, মোহাম্মদ আলী|মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ]]; [[কেবিনেট কমিটি|কেবিনেট কমিটি]]; [[পাকিস্তান|পাকিস্তান]]; [[সোহ্‌রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|হেসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী]]; [[হাশিম, আবুল|আবুল হাশিম]]; [[সাম্প্রদায়িকতা|সাম্প্রদায়িকতা]]; [[সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক|সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক]]।


[[en:Two-Nation Theory]]
[[en:Two-Nation Theory]]

১৫:৫৯, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

দ্বিজাতিতত্ত্ব  ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বাধীন জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে ভারতকে রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত করার নির্ণায়ক ও আদর্শাশ্রয়ী একটি রাজনৈতিক মতবাদ। ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন অবসানের প্রাক্কালে বিশ শতকের চল্লিশের দশকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্বের এ ধারণার উন্মেষ ঘটান। মতবাদটির একটি নির্বাচন-সংক্রান্ত প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের পর্যায়ক্রমিক সাংবিধানিক সংস্কার আইনের ভিত্তিতে হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থায় মুসলমানগণ প্রাদেশিক আইনসভা এবং আইন পরিষদের জন্য ভারতের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করার অধিকার রাখত। এর ফলে বাংলা ও উত্তর-পশ্চিম প্রদেশসমূহে মুসলিম মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পরেই মুসলিম নেতৃবৃন্দের ভাবোদয় হয় যে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার সুফল দ্বারা দুটি পৃথক জাতীয়তাবাদী চিন্তার উদ্রেক সম্ভব যাকে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অভিধায় আখ্যায়িত করা যায়। কারণ, ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠী ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিকভাবেই পৃথক একটি জাতি গঠন করতে সক্ষম।

মুসলমানদের একটি জাতি হিসেবে আত্মপরিচয়ের সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করতে স্যার সৈয়দ আহমদ খান (১৮১৭-১৯৮) প্রথম এ ধারণার উন্মেষ ঘটান। তিনি ভারতের মুসলমানদের কংগ্রেস দলের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের স্রোতে গা ভাসাতে নিরূৎসাহিত করতেন। তিনি প্রচার করেন যে, ভারতীয় মুসলিম তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় একটি জাতি গঠন করবে এবং স্বশাসনের জন্য কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত আন্দোলনের সঙ্গে মুসলমানদের জোটবদ্ধ হওয়া উচিৎ হবে না। তাঁর এ ধারণা উপনিবেশিক শাসকদের সমর্থন লাভ করে। কারণ ভারতে কংগ্রেস কর্তৃক যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তার নিয়ন্ত্রনের জন্য শাসক পক্ষের যেকোন একটি দলের সমর্থন লাভের প্রয়োজন ছিল।

প্রাদেশিক পর্যায়ে সাংবিধানিক কুশাসন প্রক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট কংগ্রেসের অসহযোগী মনোভাব কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী রাজনীতি থেকে বেশ সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিককে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং এর ফলে যে মুসলিম লীগ ১৯২৯ সাল পর্যন্ত মৃতপ্রায় অবস্থায় ছিল, তাই দিনে দিনে বাংলায় এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের রাজনীতির বাহকে পরিণত হয়। ১৯৩০ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে কবি ও দার্শনিক স্যার মুহাম্মদ ইকবাল দ্বিজাতিতত্ত্বের তাত্ত্বিক কাঠামো উপস্থাপন করেন। মুসলিম প্রতিনিধিত্ব দলের মনোভাবকে লন্ডনের গোলটেবিল বৈঠকে প্রতিক্রিয়াশীলবাদের উপর ভিত্তিশীল বলে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু যে মন্তব্য করেন তার প্রতিবাদে স্যার মুহাম্মদ ইকবাল বক্তব্য দিতে গিয়ে ‘মুসলিম জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গীর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেন। ইকবাল তাঁর বক্তব্যের উপসংহারে বলেন:

‘উপসংহারে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নিকট আমি সরাসরি একটি প্রশ্ন রাখতে চাই যে, সংখ্যা গরিষ্ঠদের দ্বারা আট কোটি সংখ্যালঘুদের ন্যুনতম নিরাপত্তা বিধান স্বীকার না করে, এমনকি তৃতীয় পক্ষের রোয়েদাদকেও (ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ম্যাকাডোনালের ঘোষিত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ) মেনে না নিয়ে কী করে ভারতের সমস্যার সমাধান সম্ভব; অথচ যার যার স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে এক ধরনের জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা চলছে? এহেন অবস্থায় মাত্র দু’টি বিকল্প পথ খোলা আছে। হয় ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় কর্তৃক পূর্বাঞ্চলে নিজেদের জন্য ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের স্থায়ী প্রতিনিধির পদকে স্বীকার করে নেওয়া, অথবা ধর্মীয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সাজুস্যের ভিত্তিতে দেশকে অবশ্যই পুনর্বণ্টন করে (পৃথক) নির্বাচনী ব্যবস্থা ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার বিদ্যমান অবস্থার সমাধান করা।’

১৯৪০ সালের ২২-২৩ মার্চ তারিখে লাহোরে বাংলাসহ ভারতের একাধিক প্রদেশে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সম্মেলনের সভাপতির ভাষণে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর দ্বিজাতিতত্ত্বের চূড়ান্ত ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তাঁর বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ:

‘এটা মেনে নিতে কষ্ট হয় যে, কেন আমাদের হিন্দু বন্ধুগণ ইসলাম ও হিন্দু মতবাদের মূল প্রকৃতি অনুধাবন করতে অপারগ হচ্ছেন। তাঁরা কঠোর অর্থে ধার্মিক নন, অথচ পৃথক ও সুনির্দিষ্ট সামাজিক বিন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁরা ধার্মিক হিসেবে প্রতীয়মান হন। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় একত্রে একটি সাধারণ জাতীয়তাবাদী ভিত্তি গড়ে তোলারে বিষয়টি আসলে একটা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই নয় এবং আমরা যদি সময় থাকতে আমাদের জাতিকে গড়ে তুলতে বিফল হই তবে ‘এক ভারতীয় জাতি’ নামক এই ভুল ধারণাটি পূর্বেও যেরূপ সমস্যার সৃষ্টি করেছে, ভবিষ্যতেও তা ভারতকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিবে। হিন্দু মুসলমান- উভয় সম্প্রদায়ই পৃথক ধর্মীয় দর্শন, সামাজিক রীতি, সাহিত্য প্রভৃতির ক্ষেত্রে দু’টি পৃথক প্রকৃত অবস্থার মধ্যে অবস্থান করে। তারা কখনো নিজেদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে না, বা একসঙ্গে কোনো অনুষ্ঠানও করে না, এবং প্রকৃত অর্থেই তারা পারস্পারিক দ্বন্দ্বপূর্ণ ধারণা ও পরিকল্পনার উপর নির্ভরশীল দু’টি পৃথক মেরুতে অবস্থানকারী পৃথক দুটি জাতি। জীবন ও জীবনধারন সম্পর্কে তাদের ধারণাও ভিন্ন। এটা সুস্পষ্ট যে, হিন্দু ও মুসলমানগণ ইতিহাসের পৃথক পৃথক উৎস থেকে প্রেরণা আহরণ করেছে। তাদের রয়েছে পৃথক মহাকাব্য, পৃথক জাতীয় বীর ও পৃথক উপাখ্যান। প্রায়ই দেখা গিয়েছে যে, এক জাতির নায়ক অন্য জাতির খলনায়ক এবং অনুরূপভাবে একের বিজয়গাথা অন্যের পরাজয়কে চিহ্নিত করে। এভাবে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে দু’টি জাতিকে এক আঙ্গিকে একটি একক রাষ্ট্রের অধীনে আনার যেকোন প্রয়াসের ক্ষেত্রে অসন্তোষ দেখা দিবে এবং এ ধরণের যে কোনো প্রয়াসই চূড়ান্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।’

অবশ্য ১৯৪৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের সম্মেলনে ‘সার্বভৌমত্ব ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের’ ধারণা সংশোধন করা হয় এবং দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে একটি ‘সার্বভৌম পাকিস্তান রাষ্ট্র’ গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

পাকিস্তানের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য এই পৃথক ‘জাতি’র ধারণাকে ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’ অভিধায় প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, ভারতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে এমন কোনো কাল আসেনি যখন দু’টি পৃথক সভ্যতা এক বা অভিন্ন একটি সাধারণ রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে। তারা বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো স্থানে হয়তো সাংস্কৃতিক সমতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু সার্বিকভাবে ইতিহাসে দু’টি সংস্কৃতি বরাবরই পৃথক দু’টি ধারা অনুসরণ করে চলেছে। হিন্দু-মুসলমানদের এই বিভক্তির চিত্র অংকনে তারা দূর অতীতের আল-বিরুনীর বিবরণে প্রাপ্ত ভারতের হিন্দু মুসলমানদের সম্প্রদায়গত পৃথক জীবনব্যবস্থার বর্ণনাকে উদাহরণ হিসেবে সামনে তুলে এনেছেন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পৃথক নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে ভারতীয়দের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সারিতে এনে দাঁড় করানোর পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ইতিহাসবিদগণ ভারতের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের মধ্যে সঙ্গতি লক্ষ্য করেছেন।

দ্বিজাতিতত্ত্বের শূণ্যগর্ভ অবস্থা প্রমাণ করার জন্য ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদগণ যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতাকে প্রমাণ করেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থকগণের জবাব হল যে, বাংলাদেশ দ্বিজাতিতত্ত্ব অনুসরণ করেছে বলেই ভারতের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়েছে এবং ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে গৃহীত দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্দীপনার ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।  [সিরাজুল ইসলাম]

আরও দেখুন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ; কেবিনেট কমিটি; পাকিস্তান; হেসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী; আবুল হাশিম; সাম্প্রদায়িকতা; সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক