দেব, গোবিন্দচন্দ্র: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
সম্পাদনা সারাংশ নেই
 
১ নং লাইন: ১ নং লাইন:
[[Category:Banglapedia]]
[[Category:Banglapedia]]
'''দেব'''''', ''''''গোবিন্দচন্দ্র '''(১৯০৭-১৯৭১)'''  '''দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ্র দেবপুরকায়স্থ। ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের লাউতা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা এবং কুলীন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উত্থানপতনের কারণে তাঁর জনৈক পূর্বপুরুষ পঞ্চম শতকে গুজরাটের আদিনিবাস ত্যাগ করে সিলেটে চলে আসেন এবং এখানেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসারে তাঁরা এখানে নব উদ্যোগে বেদ, বেদান্ত, উপরিষদচর্চা শুরু করেন। দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন।
[[Image:DevGovindaChandra.jpg|thumb|400px|right|গোবিন্দচন্দ্র দেব]]
'''দেব, গোবিন্দচন্দ্র''' (১৯০৭-১৯৭১) দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ্র দেবপুরকায়স্থ। ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের লাউতা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা এবং কুলীন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উত্থানপতনের কারণে তাঁর জনৈক পূর্বপুরুষ পঞ্চম শতকে গুজরাটের আদিনিবাস ত্যাগ করে সিলেটে চলে আসেন এবং এখানেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসারে তাঁরা এখানে নব উদ্যোগে বেদ, বেদান্ত, উপরিষদচর্চা শুরু করেন। দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বি.এ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন।


অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘রিজন, ইনটুইশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ নামক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।
অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘রিজন, ইনটুইশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ নামক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।
৬ নং লাইন: ৭ নং লাইন:
চিন্তাচেতনায় দেব ছিলেন সক্রেটিসের ভাবশিষ্য। তাঁর চিন্তাধারার বিষয় ছিল বহু বিস্তৃত, সুদূরপ্রসারী ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর চিন্তায় একদিকে যেমন স্থান পেয়েছে গভীর ও সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্বালোচনা, অন্যদিকে সমাজ, জীবন, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক ভাবনা। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক দেব সব ধর্মকে দেখেছেন উদার ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে।
চিন্তাচেতনায় দেব ছিলেন সক্রেটিসের ভাবশিষ্য। তাঁর চিন্তাধারার বিষয় ছিল বহু বিস্তৃত, সুদূরপ্রসারী ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর চিন্তায় একদিকে যেমন স্থান পেয়েছে গভীর ও সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্বালোচনা, অন্যদিকে সমাজ, জীবন, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক ভাবনা। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক দেব সব ধর্মকে দেখেছেন উদার ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে।


তাঁর চিন্তাধারার মূলে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এক সমন্বয়ী ভাবধারা এক বিশ্বজনীন মানবপ্রেম, সাম্য ও মৈত্রীভাবনা। তাই তাঁর দর্শন সমন্বয়ী ভাববাদ বা সিনথেটিক আইডিয়ালিজম নামে সমধিক পরিচিত।''' '''
তাঁর চিন্তাধারার মূলে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এক সমন্বয়ী ভাবধারা এক বিশ্বজনীন মানবপ্রেম, সাম্য ও মৈত্রীভাবনা। তাই তাঁর দর্শন সমন্বয়ী ভাববাদ বা সিনথেটিক আইডিয়ালিজম নামে সমধিক পরিচিত।


তিনি উগ্র ভাববাদ এবং উগ্র জড়বাদ উভয়কেই তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এ দুটি মতবাদই একদেশদর্শী; এদের দ্বারা মানবজীবনের কল্যাণসাধন ও প্রগতি সম্ভব নয়। একমাত্র ভাববাদ ও জড়বাদের মধ্যে সমন্বয় দ্বারাই মানুষের মুক্তি সম্ভব। তিনি তাঁর সমন্বয়ী দর্শনে বস্ত্তবাদকে অধ্যাত্মবাদে এবং অধ্যাত্মবাদকে বস্ত্তবাদে রূপান্তরিত করে এরই ভিত্তিতে একটি সার্থক জীবনদর্শন গড়ে তুলেছেন। তাঁর মতে, সার্থক দর্শন মাত্রই জীবনদর্শন। তিনি তাঁর প্রায় সব গ্রন্থেই এই দার্শনিক তত্ত্বই প্রকাশ করেছেন।#[[Image:দেব, গোবিন্দচন্দ্র_html_88407781.png]]
তিনি উগ্র ভাববাদ এবং উগ্র জড়বাদ উভয়কেই তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এ দুটি মতবাদই একদেশদর্শী; এদের দ্বারা মানবজীবনের কল্যাণসাধন ও প্রগতি সম্ভব নয়। একমাত্র ভাববাদ ও জড়বাদের মধ্যে সমন্বয় দ্বারাই মানুষের মুক্তি সম্ভব। তিনি তাঁর সমন্বয়ী দর্শনে বস্ত্তবাদকে অধ্যাত্মবাদে এবং অধ্যাত্মবাদকে বস্ত্তবাদে রূপান্তরিত করে এরই ভিত্তিতে একটি সার্থক জীবনদর্শন গড়ে তুলেছেন। তাঁর মতে, সার্থক দর্শন মাত্রই জীবনদর্শন। তিনি তাঁর প্রায় সব গ্রন্থেই এই দার্শনিক তত্ত্বই প্রকাশ করেছেন।
 
[[Image:DevGovindaChandra.jpg]]
 
#গোবিন্দচন্দ্র দেব


দেবের এই সমন্বয়ী দার্শনিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট ও ইসলামি ভাবধারা থেকে। তিনি একদিকে যেমন বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদদ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, প্রভাবিত হয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সমন্বয়ী দর্শন দ্বারা ও স্বামী বিবেকানন্দের আধুনিক হিন্দু ভাবধারা দ্বারা, তেমনি সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তথাগত ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা, ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর বাণী দ্বারা, খ্রিস্টধর্মের অমৃতময় বাণী দ্বারা। তিনি তাঁর দর্শনের প্রেরণা পেয়েছেন দেশ-কাল-জাতি ও ধর্ম বর্ণনির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে।  
দেবের এই সমন্বয়ী দার্শনিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট ও ইসলামি ভাবধারা থেকে। তিনি একদিকে যেমন বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদদ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, প্রভাবিত হয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সমন্বয়ী দর্শন দ্বারা ও স্বামী বিবেকানন্দের আধুনিক হিন্দু ভাবধারা দ্বারা, তেমনি সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তথাগত ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা, ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর বাণী দ্বারা, খ্রিস্টধর্মের অমৃতময় বাণী দ্বারা। তিনি তাঁর দর্শনের প্রেরণা পেয়েছেন দেশ-কাল-জাতি ও ধর্ম বর্ণনির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে।  
১৮ নং লাইন: ১৫ নং লাইন:
দেব এই উপমহাদেশে সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার সার্থক প্রবর্তক। তাঁর দর্শনের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভাববাদকে সমন্বয়ী ভাববাদ হিসেবে উল্লেখ করে একে চিরায়ত ভাববাদ থেকে পৃথক করেছেন এবং একে প্রগতির ধারক ও বাহক বলে মনে করেছেন। তিনি শুধু তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনা করেননি, তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সঠিক হলেও তা যদি ব্যবহারিক দিক দিয়ে শুভ না হয়, তাহলে তা মানবজীবনের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় সাধন করেছেন।
দেব এই উপমহাদেশে সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার সার্থক প্রবর্তক। তাঁর দর্শনের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভাববাদকে সমন্বয়ী ভাববাদ হিসেবে উল্লেখ করে একে চিরায়ত ভাববাদ থেকে পৃথক করেছেন এবং একে প্রগতির ধারক ও বাহক বলে মনে করেছেন। তিনি শুধু তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনা করেননি, তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সঠিক হলেও তা যদি ব্যবহারিক দিক দিয়ে শুভ না হয়, তাহলে তা মানবজীবনের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় সাধন করেছেন।


দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস (১৯৫২), আইডিয়ালিজম'': ''এ নিউ ডিফেন্স অ্যান্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন (১৯৫৮), আমার জীবনদর্শন (১৩৬৭), এ্যাসপিরেশন অব দি কমন ম্যান (১৯৬৩), দি ফিলোসফি অব বিবেকানন্দ অ্যান্ড দি ফিউচার অব ম্যান (১৯৬৩), তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬), বুদ্ধ'': ''দি হিউম্যানিস্ট (১৯৬৯)। গ্রন্থগুলো তাঁর জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। দি প্যারাবুলস অব দি ইস্ট (১৯৮৪) এবং মাই আমেরিকান এক্সপিরিয়েন্স (১৯৯৩) নামক গ্রন্থদুটি তাঁর মরণোত্তর প্রকাশনা। এছাড়া দেশিবিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ''আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস'' (১৯৫২), ''আইডিয়ালিজম: এ নিউ ডিফেন্স অ্যান্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন'' (১৯৫৮), ''আমার জীবনদর্শন'' (১৩৬৭), ''এ্যাসপিরেশন অব দি কমন ম্যান'' (১৯৬৩), ''দি ফিলোসফি অব বিবেকানন্দ অ্যান্ড দি ফিউচার অব ম্যান'' (১৯৬৩), ''তত্ত্ববিদ্যাসার'' (১৯৬৬), ''বুদ্ধ: দি হিউম্যানিস্ট'' (১৯৬৯)। গ্রন্থগুলো তাঁর জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। দি প্যারাবুলস অব দি ইস্ট (১৯৮৪) এবং মাই আমেরিকান এক্সপিরিয়েন্স (১৯৯৩) নামক গ্রন্থদুটি তাঁর মরণোত্তর প্রকাশনা। এছাড়া দেশিবিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।


দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে দেবকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছর তাঁর মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য আমেরিকায় ‘দি গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।
দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে দেবকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছর তাঁর মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য আমেরিকায় ‘দি গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।


মানবকল্যাণ সাধনায়, সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য চিরকুমার দেব তাঁর সব সম্পত্তি ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তানে নিজ জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি দেশত্যাগ করেননি; এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গণকবরে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়।  [প্রদীপ কুমার রায়]
মানবকল্যাণ সাধনায়, সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য চিরকুমার দেব তাঁর সব সম্পত্তি ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তানে নিজ জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি দেশত্যাগ করেননি; এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গণকবরে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়।  [প্রদীপ কুমার রায়]
<!-- imported from file: দেব, গোবিন্দচন্দ্র.html-->
[[en:Dev, Govinda Chandra]]


[[en:Dev, Govinda Chandra]]
[[en:Dev, Govinda Chandra]]

০৬:৩৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

গোবিন্দচন্দ্র দেব

দেব, গোবিন্দচন্দ্র (১৯০৭-১৯৭১) দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ। প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ্র দেবপুরকায়স্থ। ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের লাউতা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দেবের পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের গুজরাটের বাসিন্দা এবং কুলীন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উত্থানপতনের কারণে তাঁর জনৈক পূর্বপুরুষ পঞ্চম শতকে গুজরাটের আদিনিবাস ত্যাগ করে সিলেটে চলে আসেন এবং এখানেই স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করেন। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য অনুসারে তাঁরা এখানে নব উদ্যোগে বেদ, বেদান্ত, উপরিষদচর্চা শুরু করেন। দেব ১৯২৯ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে দর্শন বিষয়ে বি.এ (সম্মান) এবং ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম.এ ডিগ্রি লাভ করে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন।

অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘রিজন, ইনটুইশন অ্যান্ড রিয়ালিটি’ নামক অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুকাল দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে অধ্যাপনা করে তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।

চিন্তাচেতনায় দেব ছিলেন সক্রেটিসের ভাবশিষ্য। তাঁর চিন্তাধারার বিষয় ছিল বহু বিস্তৃত, সুদূরপ্রসারী ও গভীর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর চিন্তায় একদিকে যেমন স্থান পেয়েছে গভীর ও সূক্ষ্ম দার্শনিক তত্ত্বালোচনা, অন্যদিকে সমাজ, জীবন, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক ভাবনা। অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দার্শনিক দেব সব ধর্মকে দেখেছেন উদার ও সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ থেকে।

তাঁর চিন্তাধারার মূলে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছে এক সমন্বয়ী ভাবধারা এক বিশ্বজনীন মানবপ্রেম, সাম্য ও মৈত্রীভাবনা। তাই তাঁর দর্শন সমন্বয়ী ভাববাদ বা সিনথেটিক আইডিয়ালিজম নামে সমধিক পরিচিত।

তিনি উগ্র ভাববাদ এবং উগ্র জড়বাদ উভয়কেই তীব্র সমালোচনা করে বলেছেন, এ দুটি মতবাদই একদেশদর্শী; এদের দ্বারা মানবজীবনের কল্যাণসাধন ও প্রগতি সম্ভব নয়। একমাত্র ভাববাদ ও জড়বাদের মধ্যে সমন্বয় দ্বারাই মানুষের মুক্তি সম্ভব। তিনি তাঁর সমন্বয়ী দর্শনে বস্ত্তবাদকে অধ্যাত্মবাদে এবং অধ্যাত্মবাদকে বস্ত্তবাদে রূপান্তরিত করে এরই ভিত্তিতে একটি সার্থক জীবনদর্শন গড়ে তুলেছেন। তাঁর মতে, সার্থক দর্শন মাত্রই জীবনদর্শন। তিনি তাঁর প্রায় সব গ্রন্থেই এই দার্শনিক তত্ত্বই প্রকাশ করেছেন।

দেবের এই সমন্বয়ী দার্শনিক তত্ত্ব গড়ে উঠেছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্ট ও ইসলামি ভাবধারা থেকে। তিনি একদিকে যেমন বেদ, বেদান্ত ও উপনিষদদ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, প্রভাবিত হয়েছেন রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সমন্বয়ী দর্শন দ্বারা ও স্বামী বিবেকানন্দের আধুনিক হিন্দু ভাবধারা দ্বারা, তেমনি সমভাবে প্রভাবিত হয়েছেন তথাগত ভগবান বুদ্ধের মৈত্রী ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা, ইসলামের সাম্য-মৈত্রীর বাণী দ্বারা, খ্রিস্টধর্মের অমৃতময় বাণী দ্বারা। তিনি তাঁর দর্শনের প্রেরণা পেয়েছেন দেশ-কাল-জাতি ও ধর্ম বর্ণনির্বিশেষে সকলের কাছ থেকে।

দেব এই উপমহাদেশে সমন্বয়ী দার্শনিক ধারার সার্থক প্রবর্তক। তাঁর দর্শনের স্বাতন্ত্র্য এখানেই যে, তিনি ভাববাদকে সমন্বয়ী ভাববাদ হিসেবে উল্লেখ করে একে চিরায়ত ভাববাদ থেকে পৃথক করেছেন এবং একে প্রগতির ধারক ও বাহক বলে মনে করেছেন। তিনি শুধু তত্ত্বসর্বস্ব দর্শন আলোচনা করেননি, তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগের ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ তিনি মনে করতেন, তাত্ত্বিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ সঠিক হলেও তা যদি ব্যবহারিক দিক দিয়ে শুভ না হয়, তাহলে তা মানবজীবনের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই তিনি তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় সাধন করেছেন।

দেবের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট নয়টি। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: আইডিয়ালিজম অ্যান্ড প্রগ্রেস (১৯৫২), আইডিয়ালিজম: এ নিউ ডিফেন্স অ্যান্ড এ নিউ এ্যাপলিকেশন (১৯৫৮), আমার জীবনদর্শন (১৩৬৭), এ্যাসপিরেশন অব দি কমন ম্যান (১৯৬৩), দি ফিলোসফি অব বিবেকানন্দ অ্যান্ড দি ফিউচার অব ম্যান (১৯৬৩), তত্ত্ববিদ্যাসার (১৯৬৬), বুদ্ধ: দি হিউম্যানিস্ট (১৯৬৯)। গ্রন্থগুলো তাঁর জীবিতকালেই প্রকাশিত হয়। দি প্যারাবুলস অব দি ইস্ট (১৯৮৪) এবং মাই আমেরিকান এক্সপিরিয়েন্স (১৯৯৩) নামক গ্রন্থদুটি তাঁর মরণোত্তর প্রকাশনা। এছাড়া দেশিবিদেশি পত্রিকায় ইংরেজি ও বাংলায় দেবের প্রায় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

দর্শনে বিশিষ্ট অবদানের জন্য ১৯৬৭ সালে দেবকে সম্মানসূচক ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছর তাঁর মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য আমেরিকায় ‘দি গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে গোবিন্দদেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ প্রদান করে।

মানবকল্যাণ সাধনায়, সত্য, সুন্দর ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায়, মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য চিরকুমার দেব তাঁর সব সম্পত্তি ও অর্থ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। ১৯৬৫ সালের পাকভারত যুদ্ধের সময় তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। পাকিস্তানে নিজ জীবন বিপন্ন হতে পারে জেনেও তিনি দেশত্যাগ করেননি; এমনকি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি একাত্মতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের গণকবরে তাঁর মরদেহ সমাহিত করা হয়।  [প্রদীপ কুমার রায়]