দেবী, মহাশ্বেতা

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৫:০৩, ১ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ ("right|thumbnail|200px|মহাশ্বেতা দেবী '''দেবী, মহাশ্বেতা''' (১৯২৬-২০১৬) বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী। ঢাকার আরমানিটোলার ১৫নং জিন্দাবাহার লেনের মামা বাড়িতে ১৯২৬ সালের ১..." দিয়ে পাতা তৈরি)
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
মহাশ্বেতা দেবী

দেবী, মহাশ্বেতা (১৯২৬-২০১৬) বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও মানবাধিকারকর্মী। ঢাকার আরমানিটোলার ১৫নং জিন্দাবাহার লেনের মামা বাড়িতে ১৯২৬ সালের ১৪ই জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মনীষ ঘটক এবং মাতা ধরিত্রী দেবী। বাবা ছিলেন একাধারে কবি ও সাহিত্যিক। মা-ও কবি ছিলেন। পিতা-মাতার নয় সন্তানের মধ্যে মহাশ্বেতা সবার বড়। মহাশ্বেতার মনন-মানসে তাঁর সমগ্র পিতৃ এবং মাতৃকুলের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্য-চর্চা নিবিড়ভাবে কার্যকর ছিল। তাঁর পিতা মনীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং তাঁর কাকা ছিলেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ঋত্বিক ঘটক।

১৯৪৬ সালে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি.এ পাস করে মহাশ্বেতা শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতা ফিরে আসেন এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ (ইংরেজি) ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘদিনের জন্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় সতেরো বছর পর ১৯৬৩ সালে তিনি এম.এ পাস করেন।

১৯৬৪ সালে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। লেখাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার পর ১৯৮৪ সালে তিনি সেখান থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। এ সময় থেকেই মহাশ্বেতা দেবী একজন নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিক এবং লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর লেখা শতাধিক গ্রন্থের মধ্যে ‘হাজার চুরাশির মা’ অন্যতম। এছাড়াও তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘অরণ্যের অধিকার’, ‘নৈঋতে মেঘ’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর’, ‘শালগিরির ডাকে’ ইত্যাদি।

কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় কমিউনিজমের প্রতি তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে দলীয় রাজনীতিতে তাঁর আস্থা ছিল না কখনো। তিনি মানবতাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রথম জীবনীগ্রন্থ ‘ঝাঁসীর রাণী’ ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত হয়। মহাশ্বেতা দেবী নাট্যব্যক্তিত্ব বিজন ভট্টাচার্যের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে তিনি অসিত গুপ্তের সাথে দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তার পুনরায় বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটলে, এরপর একাকী নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করেন।

ইতিহাস আশ্রিত জীবনীগ্রন্থ ‘ঝাঁসীর রাণী’ সাহিত্যিক হিসেবে মহাশ্বেতার অবস্থানকে শক্ত ভিত্তি দেয়। তিনি আরও একাধিক ইতিহাসশ্রয়ী উপন্যাস লিখেছেন, যেমন ‘আঁধার মানিক’ (১৯৬৬), ‘তিতুমীর’ (১৯৮৪), ‘কৈবর্ত খা’ (১৯৯৪) ইত্যাদি। তাঁর ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য রাজবৃত্ত নয়, লোকবৃত্তকে প্রাধান্য দিয়েই রচিত। উপন্যাসের মতো ছোটগল্পেও মহাশ্বেতা দেবী প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রামকে উপজীব্য করেছেন অনায়াস দক্ষতায়। ‘দ্রৌপদী, ‘জাতুধান’, ‘শিকার’, ‘শিশু’, ‘সগোয়ানা’, ‘লাইফার মাছ’, ‘বিছন’ প্রভৃতি গল্পে সমাজের নানা অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জনতার প্রতিবাদের শিল্পভাষ্য নির্মিত হয়েছে।

কেবল বাংলা সাহিত্য নয়, তাঁর সাহিত্যকর্ম বিভিন্ন প্রাদেশিক ও বিদেশি ভাষায় অনুদিত হয়ে তাঁকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দিয়েছে প্রভূত পরিচিতি। পেশাগত কারণে বেশ কিছু বাণিজ্যিক রচনা করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি কালজয়ী হয়েছেন ভারতবর্ষীয় ব্রাত্য মানুষ, বিশেষত আদিবাসী জীবনের ভাষ্যকার হিসেবে। তিনি অসংখ্য সংগঠনের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন এবং সক্রিয়ভাবে অন্ত্যজ মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে শামিল হয়েছেন; প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘আদিম জাতি ঐক্য পরিষদ’ ‘পশ্চিমবঙ্গের আটত্রিশ গোষ্ঠী’সহ সকল আদিবাসীর মিলনমঞ্চ।

সাহিত্যে স্বীকৃতিস্বরূপ মহাশ্বেতা নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (১৯৭৯), ভারত সরকারের ‘পদ্মশ্রী’ (১৯৮৬), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৯৬), ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৯৭); ফেলোশিপ: বোম্বে এশিয়াটিক সোসাইটি (১৯৯৮), ইতালির প্রিমিও নোনিও রিসিট ডি আউর’ (২০০৫) এবং ফরাসি সরকার কর্তৃক ‘অফিসার অব দি অর্ডার অব আর্টস অ্যান্ড লেটারস’ সম্মাননা ইত্যাদি। এছাড়া ২০০৬ সালে ‘পদ্মভুষণ’ পুরস্কার, ‘জ্ঞানপীঠ’ এবং ২০০৭ সালে সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। তবে তিনি বিখ্যাত হন প্রধানত পশ্চিম বাংলার আদিবাসী এবং নারীদের ওপর কাজের জন্য। পশ্চিমবঙ্গের জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনে বিদ্বজ্জনদের মধ্যে তিনি প্রথম সারিতে ছিলেন। নিপীড়িত মানুষের অলিখিত সংগ্রামী জীবন-ইতিহাসকে সাহিত্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করে তিনি বাংলা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

২০১৬ সালের ২৮শে জুলাই মহাশ্বেতা দেবী ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। [সাব্বীর আহমেদ]