দুর্নীতি দমন কমিশন

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)  দুর্নীতি দমনে অধুনালুপ্ত দুর্নীতিদমন ব্যুরোর ব্যর্থতার ফলে সৃষ্ট ব্যাপক জন অসন্তুষ্টিই স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে সহায়ক উৎস হিসাবে চিহ্নিত। মিডিয়াসহ নাগরিক সমাজ এবং বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগিতা এই জন-অসন্তোষকে জোরালো সর্মথন দেয় এবং জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে তা জোরালোভাবে ব্যক্ত করে।

২০০১ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দেশের দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনে অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। এর মধ্যে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কাউন্সিল গঠন করার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়। তবে ২০০৪ সালের পূর্বে জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। ২০০৪ সালে সংসদ এ সংক্রা্ন্ত আইন (২০০৪ সালের ৫ নং আইন) অনুমোদন করে এবং ফলে ঐ সময়ে বিদ্যমান দুর্নীতি দমন ব্যুরো বিলুপ্ত হয়। অনুমোদিত আইনের ভূমিকায় স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনসহ এ সংক্রা্ন্ত প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠনের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

২০০৪ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশ গেজেটে (অসাধারণ) প্রকাশিত এ আইনে সর্বমোট সাইত্রিশটি বিধানসহ একটি তফসিল রয়েছে। এ আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রধান কার্যালয় স্থাপনসহ কমিশন গঠন, চেয়ারম্যানসহ কমিশনের সদস্যদের চাকzুরর শর্তাবলি নির্ধারণ, সyুপ্রম কোর্টের আপীল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচন কমিটির পদ্ধতি, কমিশনে নিযুক্তির জন্য সদস্যদের যোগ্যতা বা অযোগ্যতার শর্তাবলি, সদস্যদের পদত্যাগ এবং নিয়োগ, কমিশনের কার্যাবলি, অপরাধ তদন্তের সাধারণ ও বিশেষ ক্ষমতা, আর্থিক স্বাধীনতাসহ পৃথক বিচারকার্য পরিচালনার ইউনিট ইত্যাদি।

কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কার্যপরিচালনা করবে মর্মে আইনটিতে স্পষ্ট বিধান রয়েছে। চার বছর মেয়াদান্তে কমিশনের সদস্য বা চেয়ারম্যান প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিযুক্তি লাভের যোগ্য হবেন না। সদস্যদের চাকুরি থেকে অপসারণের জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। রাষ্ট্রপতির পুর্বানুমোদন সাপেক্ষে কমিশনের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা রয়েছে। এ ধারণা বিদ্যমান বিধান থেকে কিছুটা ভিন্নতর। বিদ্যমান প্রায় সকল আইনে এ ক্ষমতা সরকারের। এর লক্ষ্য হলো অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ সংস্থার তুলনায় কমিশনকে অধিকতর ক্ষমতাবান করা। কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতার বিষয়টিও আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে। সরকারের অনুমোদিত বাজেটের নির্ধারিত খাত হতে অর্থ ব্যয়ের জন্য পুনরায় সরকারের কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া, সচিব নিয়োগের ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে।

তদন্তের সহায়তাকল্পে কমিশন সরকারসহ সরকারি যেকোন কর্তৃপক্ষ থেকে যেকোন তথ্য সংগ্রহে ক্ষমতাবান। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম না হলে কমিশন নিজেই তদন্ত শুরু করতে পারবে। কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে সরকার বা যেকোন সরকারি কর্তৃপক্ষ কমিশনকে তথ্য প্রদান করতে বাধ্য। কমিশন দ্বারা নির্ধারিত যেকোন ব্যক্তির জন্য সম্পদের বিবরণী দাখিল করা বাধ্যতামূলক। কোনো ব্যক্তি মিথ্যা বা ভিত্তিহীন সম্পদ বিবরণী দাখিল করলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে জরিমানাসহ বা ব্যতিরেকে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তির মাত্রা দশ বছরের কারাদন্ডসহ সম্পদ বাজেয়াপ্তের বিধান রয়েছে।

জন্মলগ্নের কিছুদিন পর পর্যন্ত কমিশনের কার্যাবলি সম্পর্কে ব্যাপক জনসমালোচনা শুরু হয়। এর প্রধান দুটি কারণ ছিল। এক, কমিশনের সদস্যদের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তীব্র মতপার্থক্য। দুই, আইনগত, প্রশাসনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা প্রদানে সরকারের ব্যর্থতা বা অনীহা। এ দুটি কারণকেই কমিশনের অসামর্থ্যের জন্য চিহ্নিত করা হয়।

দুর্নীতি দমন কমিশন কর্তৃক গৃহীত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হাইকোর্টে অনেক রিট মামলা দায়ের করেছেন। ভবিষ্যতে এ মামলাসমূহের ফলাফল কি হবে তা এখনও বলার সময় আসে নি। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, যে সকল সাজাপ্রাপ্ত বা অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা করেছেন তা মিমাংসার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হবে।  [এ.এম.এম শওকত আলী]