দীন মহম্মদ, শেখ

দীন মহম্মদ, শেখ (১৭৫৯-১৮৫১)  দুঃসাহসী অভিযাত্রিক, লেখক ও উদ্যমী পুরুষ। সংস্কৃতিগত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও সমন্বয়ের ফল ব্যক্তি জীবনে যে বিস্ময়কর নাটকীয় পরিবর্তন আনতে পারে, তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ তিনি। আয়ারল্যান্ডের কর্কে অভিবাসনের পূর্বে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈনিক ছিলেন। কর্কে গিয়ে তিনি ‘Travels’ নামে একটি পুস্তক রচনা করেন। এটিই কোন ভারতীয়ের লেখা প্রথম ইংরেজি পুস্তক। কালক্রমে তিনি আইরিশ প্রটেস্টান্ট অভিজাত সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তাঁর পরিবারটি সম্ভবত আয়াল্যান্ডে প্রথমদিককার ইন্দো-ব্রিটিশ পরিবারগুলোর মধ্যে অন্যতম, যাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। পরিবারটি প্রথমে লন্ডন, পরে ব্রাইটনে বসবাস করে সেখানে রান্নার পদ্ধতির বাজারজাতকরণে মৌলিক অবদান রাখে এবং ভারতীয় ভেষজ চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকে।

১৭৫৯ সালে পাটনার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে দীন মহম্মদের জন্ম। তাঁদের পরিবারের সঙ্গে বাংলার নওয়াবের আত্মীয়তা ছিল বলে তাঁরা গর্ব করতেন। এই পরিবারের লোকজন ঐতিহ্যগতভাবে উত্তর ভারতের মুসলিম শাসকদের অধীনে চাকরি করে আসছিলেন। কিন্তু তখন মুসলিম শক্তির ক্রমাবনতি ঘটে এবং  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্রুত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার করতে থাকে। এই ক্ষমতা বদলের পটভূমিতে কোম্পানি ইচ্ছুক ভারতীয়দের জন্য চাকরির সুযোগ করে দেয়। দীন মহম্মদ তাঁর পিতা (যুদ্ধে নিহত) ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কোম্পানির চাকরিতে যোগদান করেন এবং মাত্র বারো বছর বয়সে কর্কের এক আইরিশম্যান ও বেঙ্গল আর্মির ইউরোপিয়ান রেজিমেন্টের কোয়ার্টার মাস্টার গডফ্রে ইভান বেকারের অধীনে ক্যাম্পবয় নিয়োজিত হন। ১৭৮১ সালে বেকার ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হয়ে এক সিপাহি ব্যাটেলিয়ানের দায়িত্ব লাভ করলে তিনি দীন মহম্মদকে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী সৈন্যদলের দায়িত্ব দিয়ে জমাদার নিযুক্ত করেন। সিপাহি বাহিনীকে সম্ভ্রান্ত  ইউরোপীয় সেনাবাহিনী অপেক্ষা অনেক বেশি যুদ্ধে লিপ্ত থাকতে হতো। বারো বছর ইউরোপীয় বাহিনীতে কাজ করে মারাঠা ও বেনারসের বিদ্রোহী রাজা চৈত সিংহের সঙ্গে যতো না যুদ্ধ করতে হয়েছিল, বাকের ও দীন মহম্মদকে তার চেয়ে অনেক বেশি যুদ্ধ করতে হয়েছিল মাত্র এক বছরে। বেনারসে বিদ্রোহীদের দমনে যুদ্ধ চলাকালে দীন মহম্মদ সুবাহদার পদে উন্নীত হন। কোম্পানির বাহিনীতে এটিই ছিল ভারতীয়দের জন্য সর্বোচ্চ পদ। কিন্তু এর অল্প কিছুদিন পরেই তাঁর সৈনিক পেশার পরিসমাপ্তি ঘটে। বেকারকে কোন এক অভিযান হতে অপমানজনকভাবে তলব করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে গ্রামবাসী অভিযোগ করেছিল যে, তিনি তাদের কাছ থেকে জোর করে অর্থ আদায় করেছেন। দীন মহম্মদ তখন চাকরি ছেড়ে তাঁর পৃষ্ঠপোষক বেকারের সহগামী হন।

বেকার ও দীন মহম্মদ কিছুকাল পূর্ববাংলা সফর করেন। তাঁরা ঢাকা শহরেও এসেছিলেন। তখন ঢাকা মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত। ঢাকায় তখন নওয়াব কর্তৃক প্রতিবছর যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও গণউৎসবের আয়োজন হতো, তাঁরা সেই উৎসব প্রত্যক্ষ করেন। তারপর বাঘ ও ডাকাত পরিবৃত গভীর জঙ্গল সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌকাযোগে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করেন। বেকার কোম্পানির চাকরি হতে অব্যাহতি গ্রহণ করে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মনস্থ করলে দীন মহম্মদ তাঁর সঙ্গী হন। তাঁরা ১৭৮৪ সালে কর্ক শহরে পৌঁছেন। দীন মহম্মদকে স্কুলে ভর্তি করা হয়। সেখানে তিনি অত্যন্ত ভালভাবে শিক্ষা লাভ করেন। ১৭৮৬ সালে (যে বছর বেকার মারা যান) দীন মহম্মদ তাঁর এক সহপাঠী জেন ডালিকে বিয়ে করেন। পরে তাঁরা কর্কে ফিরে আসেন এবং পরবর্তী দুই দশক তিনি বেকারের বাড়ির ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন। ১৭৯৯ সালে ভারতীয় পর্যটক মির্জা আবু তালেব খানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। আবু তালেব তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে এ সাক্ষাতের বিবরণ দিয়েছেন। ১৭৯৪ সালে তাঁর রচিত Travels  গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে কর্ক শহরে তাঁর সামাজিক মর্যাদা বেড়ে যায়। বিভিন্ন জনের থেকে চাঁদা তুলে গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

বইটির পূর্ণ নাম ‘The Travels of Dean Mahomet, A Native of Patna in Bengal, Through Several Parts of India, While in the Service of The Honourable The East India Company Written by Himself, In a Series of Letters to a Friend’। বইটির পত্রসাহিত্য রচনারীতি সে যুগের জনপ্রিয় ইংরেজি রচনারীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। মাইকেল এইচ ফিশার ‘The Travels of Dean Mahomet’ শিরোনামে বইটি সম্পাদনা করে (বার্কলি : ইউনিভারসিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া প্রেস, ১৯৯৭) প্রথমবারের মতো বৃহত্তর পাঠক সমাজের নিকট উপস্থাপন করেন। তিনি এই গ্রন্থে দীন মহম্মদের সময় ও তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা সংযোজন করেছেন। ফিশার কতকগুলি মজাদার তথ্যের উল্লেখ করেছেন। একক ধরনের কোন পাঠকের পরিবর্তে দু’ধরনের পাঠকের উদ্দেশ্যে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল। ‘প্রথমে তাঁর লক্ষ্য ছিল ভারতবর্ষকে এবং তাঁর নিজেকে পারিপার্শ্বিক এলিট সমাজের সামনে উপস্থাপন করা। রচনার ধরন থেকেই বোঝা যায় যে, লেখক একজন শিক্ষিত ব্যক্তি। দ্বিতীয়ত আংশিকভাবে হলেও তিনি চেয়েছিলেন যে ট্রাভেলস বইটি যেন ইউরোপীয় পর্যটকদের জন্য ভারত ভ্রমণের নির্দেশিকা বা গাইড হিসেবে কাজ করে। এই লক্ষ্য সামনে রেখে দীন মহম্মদ ভারতীয় নগর, শিল্প, ভৌগোলিক অবস্থা, উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি ফারসি ও ভারতীয় শব্দের একটি তালিকা এবং যে সকল ভারতীয় নগর তিনি নিজেও দেখেন নি তার বাস্তব বিবরণ দিয়েছেন।’

ফিশার এমন প্রমাণও দাঁড় করিয়েছেন যে, দীন মহম্মদ জেমিনা কিনডারেলি রচিত ‘Letters from the Island of Teneriffe ... and the East Indies (১৭৭৭) এবং আরো ব্যাপকভাবে জন হেনরি গ্রোজ রচিত ‘Voyage to the East Indies’ (১৭৬৬) গ্রন্থদ্বয় থেকে তথ্য নকল করেছেন। কিন্তু দীন মহম্মদ তাঁর ‘ট্রাভেলস’ গ্রন্থে গ্রোজের গ্রন্থ হতে মাত্র শতকরা সাত ভাগ তথ্যাবলি গ্রহণ করে থাকলেও তিনি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে নিজের মতো করে সেগুলি নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দুজন লেখকই পান চর্বনের অনুরূপ বর্ণনা দিয়েছেন; কিন্তু গ্রোজ পান খাওয়ার অভ্যাসকে একটি অস্বাস্থ্যকর বদ অভ্যাস বলে মনে করলেও মহম্মদের নিকট এটি ছিল অত্যন্ত উপাদেয় এবং মার্জিত সামাজিকতার প্রকাশ।

১৮০৭ সালে মহম্মদ সপরিবারে লন্ডনে চলে যান। সেখানে তিনি অনারেবল বেসিল কোশরেন নামে এক স্কটিশ অভিজাতের নিকট চাকরি গ্রহণ করেন। কোশরেন এক সময় ভারতবর্ষে অবস্থানকালে প্রচুর ধনসম্পদ অর্জন করেছিলেন। পরে তিনি লন্ডনে একটি উষ্ণ বাষ্প থেরাপী চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেন। মাইকেল ফিশার লিখেছেন, ‘দীন মহম্মদ কোশরেনের চিকিৎসাকেন্দ্রে ভেষজ মালিশ চিকিৎসা সংযোজন করেন। দীন মহম্মদই ‘শ্যাম্পুয়িং’ নামে এই মালিশ চিকিৎসা ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় করে তোলেন।’ ‘শ্যাম্পু’ শব্দটি মুলত হিন্দি ‘সাংপো’ (চাপ দেওয়া) শব্দ থেকে উৎপন্ন। পরবর্তী সময়ে এই মালিশ চিকিৎসা খ্যাতিলাভ করে। ১৮০৯ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত মহম্মদ ছিলেন এক রেস্তোরাঁর মালিক। পোর্টম্যান স্কয়ারে অবস্থিত এই রেস্তোরাঁর নাম ছিল হিন্দুস্তানি কফি হাউস। সেখানে বেতের আসবাবপত্র, হুক্কা ও প্রাচ্যদেশীয় চিত্রকলা দ্বারা সুসজ্জিত ভারতীয় আবহমন্ডল সৃষ্টি করে ভারতীয় খাদ্য পরিবেশন করা হতো। প্রথম দিকে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয় এবং দীন মহম্মদ মূলধন হারিয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়েন।

অতঃপর মহম্মদ ব্রাইটনে চলে যান এবং সেখানে একটি ভেষজ মালিশ চিকিৎসাকেন্দ্র খোলেন। তিনি এর নাম দেন ‘The Indian Medicated Vapour Bath and 'Shampooing with Indian Oils' (এখানে গরম বাষ্পে ভারতীয় ঔষধি মিশিয়ে মালিশ এবং ভারতীয় তৈল মর্দন করা হতো)। ব্যবসা প্রসার লাভ করতে থাকলে প্রশস্ততর জায়গার প্রয়োজন দেখা দেয়। একজন পৃষ্ঠপোষকের সহায়তায় দীন মহম্মদ একটি মনোরম জমকালো বাষ্পস্নানকেন্দ্র নির্মাণ করেন এবং এর নাম দেন ‘ Mahomed's Baths'। প্রচারের জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেয়া ছাড়াও তিনি দুটি বই প্রকাশ করেন। প্রথমটি Cases cured by Sake Deen Mahomed, Shampooing Surgeon, এবং Inventor of the Indian Medicated Vapour And Sea-Water Baths, Written by the Patients Themselves (1820) এবং দ্বিতীয়টি পরবর্তী সময়ে তিনটি সংস্করণে প্রকাশিত Shampooing, or, Benefits Resulting from the use of The Indian Medicated Vapour Bath, As Introduced into this country by S.D. Mahomed। এ বইতে তিনি দাবি করেছেন যে, তিনি সৈনিক হবার পূর্বেই উক্ত চিকিৎসা বিদ্যায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন এবং শল্য চিকিৎসক হিসেবে কাজও করেছেন। এই মিথ্যাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য নিজের বয়স দশ বছর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর পেশা সফলতার শীর্ষে পৌঁছেছিল যখন তিনি রাজা চতুর্থ জর্জ ও রাজা চতুর্থ উইলিয়মের চিকিৎসা করেন এবং তাঁকে তাদের ‘শাম্পুয়িং সার্জন’ হিসেবে নিয়োগপত্র প্রদান করা হয়। উনিশ শতকের ত্রিশের দশকের কোন এক সময় মহম্মদ লন্ডনে একটি শাখা খোলেন। প্রথমে তাঁর পুত্র কনিষ্ঠ দীন এবং পরে অপর পুত্র হোরেশিও এটি পরিচালনা করতেন। প্রচারের জন্য এঁরা দুটি বইও প্রকাশ করেছিলেন।

পৃষ্ঠপোষকের মৃত্যুর পর ১৮৪১ সালে মহম্মদকে প্রতিষ্ঠানটি অন্যত্র ক্ষুদ্রতর পরিসরে স্থানান্তর করতে বাধ্য করা হয়েছিল। এ সময়ে তাঁর জনপ্রিয়তাও কমে গিয়েছিল। ১৮৫১ সালে মহম্মদ যখন মারা যান তখন তিনি প্রায় বিস্মৃত ব্যক্তিত্ব। তাঁর মৃত্যুসংবাদ ও স্মৃতিচারণ থেকে অনুমিত হয় যে, তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন না। কিন্তু এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি ছিলেন এক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব এবং তাঁকে স্মরণ করতে হয় দুটি কারণে; প্রথমত, তিনিই সর্বপ্রথম ইঙ্গ-ভারতীয় রচনার ঐতিহ্যের ধারা প্রবর্তন করেছিলেন এবং দ্বিতীয়ত তিনিই বিদেশে ভারতীয় কর্তৃক ভারতীয় চমকপ্রদ বস্ত্তর বিপণনের সূত্রপাত করেছিলেন।  [কায়সার হক]