দাশ, সুধীন

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৫:৪৫, ১ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)
সুধীন দাশ

দাশ, সুধীন (১৯৩০-২০১৭) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা সংগীতব্যক্তিত্ব। তিনি একাধারে গায়ক, সংগীত গবেষক, সংগীত শিক্ষক এবং সংগঠক। বাংলাদেশে শুদ্ধ সংগীত-সাংস্কৃতিক চর্চায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। বাংলা গানের প্রায় প্রতিটি শাখায় সাফল্যের সাথে বিচরণ তাঁকে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। বাংলাদেশে শুদ্ধ সুরে নজরুল সংগীত চর্চায় তিনি পথিকৃৎ। সুধীন দাশ আদি গ্রামোফোনভিত্তিক সুরে নজরুল সংগীতের স্বরলিপি প্রণয়ণের উদ্যোক্তা এবং সর্বাধিক সংখ্যক স্বরলিপি গ্রন্থ প্রণেতা। প্রামাণিক সুরে লালনগীতির স্বরলিপি গ্রন্থও তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন।

সুধীন দাশ ১৯৩০ সালের ৩০শে এপ্রিল কুমিল্লা শহরের তালপুকুরপাড়ে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা নিশিকান্ত দাশ ও মা হেমপ্রভা দাশের দশ সন্তানের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন সুধীন দাশ। পারিবারিকভাবে সংগীত-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা সুধীন দাশের বড় ভাই আচার্য সুরেন্দ্র নারায়ণ দাশ ছিলেন তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লা শহরের একজন নামকরা সংগীতগুরু। স্থানীয় শিল্পী, সংগীত শিক্ষার্থী এবং সংগীত পিপাসুদের আনাগোনায় মুখরিত থাকত নিশিকান্ত দাশের বাড়ি। বড় ভাই সুরেন্দ্র নারায়ণ দাশের কাছেই সুধীন দাশের সংগীত শিক্ষার হাতে খড়ি। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁন এবং পণ্ডিত গিরিজা শংকর চক্রবর্তীর শিষ্য সুরেন্দ্রনারায়ণ দাশের কাছে অনেক ছেলেমেয়ে গান শিখতে আসত। কিশোর সুধীন দাশ তখন ক্লাসের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করতেন এবং লুকিয়ে লুকিয়ে গান শিখে নিতেন। সংগীতের প্রতি আগ্রহ এবং কন্ঠে গান তুলে নেয়ার দক্ষতা দেখে ক্রমে সুরেন দাশ তাঁকে সংগীত শিক্ষায় কাছে টেনে নেন। সংগীত স্বরলিপির প্রতি আগ্রহ এবং যথার্থভাবে স্বরলিপি অনুধাবনের আগ্রহও তাঁর কিশোর বয়সেই শুরু হয়। অগ্রজ সুরেন দাশের গানের খাতাপত্র, বিশেষ করে উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিভিন্ন স্বরলিপি দেখে সেই কিশোর বয়সেই তা কন্ঠে তোলার চেষ্টা করতেন সুধীন দাশ।

সুধীন দাশের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ঈশ্বর পাঠশালায় এবং সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সুরেন্দ্র নারায়ণ দাশ প্রতিষ্ঠিত সংগীত শিক্ষার্থী সম্মিলনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি যখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, তখন কুমিল্লা শহরে বোমা পড়ার আশংকায় শহরের অনেক অফিস, কাচারী অন্যত্র স্থানান্তরিত হয়। ঈশ্বর পাঠশালাও স্থানান্তরিত হয়ে যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সুধীন দাশ তখন কুমিল্লা জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে তিনি কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৮ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৫০ সালে বি.এ পরীক্ষা চলাকালে দুটো পরীক্ষা দিয়ে তিনি আর কোন পরীক্ষা দেননি। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন এখানেই সমাপ্ত হয়।

সুধীন দাস ১৯৪৮ সালে আধুনিক গানের নিয়মিত শিল্পী হিসেবে রেডিও পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হন । ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৬৫ সালে সুধীন দাস নিয়মিত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন পাকিস্তান টেলিভিশনে। সুধীন দাশ শুদ্ধ সুর ও বাণীতে নজরুল সংগীত প্রচারে কাজ করে গেছেন আমৃত্যু। বাংলাদেশ সরকার কতৃক সংগীত বিশেষজ্ঞগণের সমন্বয়ে গঠিত নজরুল সংগীত প্রামাণীকরণ পরিষদের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি নজরুল একাডেমী এবং নজরুল ইন্সটিটিউটের প্রশিক্ষক ছিলেন। ২০১৩ সালে গঠিত নজরুল সংগীত সংস্থার তিনি ছিলেন আমরণ উপদেষ্টা। বর্তমান সময়ের প্রথিতযশা নজরুল সংগীত শিল্পী এবং রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীর অনেকেই তাঁর শিষ্য, তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে সংগীতজীবনকে ঋদ্ধ করেছেন।

সুধীন দাশ যখন রেডিও ও টেলিভিশনে গান গাওয়া শুরু করেন, তখন নজরুল সংগীত বিভাগ হিসেবে আলাদা কোন বিভাগ ছিল না। নজরুল সংগীত বাংলা আধুনিক গান হিসেবেই গাওয়া হত, সুরকার ও গীতিকার হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করা হত। বাড়িতে পারিবারিক পরিবেশে নজরুল সংগীতের আদি গ্রামোফোন রেকর্ড (বিশেষ ভাবে যেগুলো ১৯৪২ সালের পূর্বে, নজরুলের সুস্থ অবস্থায় তাঁর তত্ত্বাবধানে রেকর্ডকৃত) শুনে অভ্যস্ত সুধীন দাশ লক্ষ্য করলেন যে নজরুল সংগীত বিভিন্ন শিল্পী সুর পরিবর্তন করে অনেকাংশে কথা পরিবর্তন করে নিজের মতো করে গাইছেন। নজরুল সংগীতের সুরের এই বিকৃতি সুধীন দাশকে তাড়িত করত। স্বাধীনতার পর সুধীন দাশ নজরুল একাডেমীর মাধ্যমে নজরুল সংগীত স্বরলিপি প্রণয়ণের কাজে হাত দেন। নজরুল একাডেমী থেকে প্রকাশিত দশ খণ্ড নজরুল স্বরলিপির পাঁচ খন্ডেরই স্বরলিপিকার সুধীন দাশ। ১৯৮৫ সালে নজরুল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা হলে এই কর্মধারা আরও বেগবান হয়। অদ্যাবধি নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত পঞ্চাশ খন্ড নজরুল সংগীত স্বরলিপির মধ্যে সুধীন দাশের হাতেই সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। এছাড়াও বাউল খোদা বক্স সাঁই-এর কন্ঠে রেকর্ডকৃত ৪৫টি লালনগীতি’র সুরে একটি লালনগীতি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যা ২০০৭ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়।

জাতীয় পর্যায়ে সংগীতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সুধীন দাশ ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি নজররুল স্বর্ণপদক, নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, জেবুন্নেছা-মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক, শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক, চুরুলিয়া নজরুল একাডেমী নজরুল পদক, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (আজীবন সম্মাননা), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড (আজীবন সম্মাননা) লাভ করেন।

সুধীন দাশ ২০১৭ সালের ২৭শে জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [আজিজুর রহমান]