ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, ক্ষতিগ্রস্ত বন্দর ইত্যাদি প্রেক্ষাপটে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল জরুরি ভিত্তিতে জোগান দেওয়া ও ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের কাছে সরবরাহ নিশ্চিতকরণের তীব্র প্রয়োজন দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির ৬৮নং আদেশের মাধ্যমে টিসিবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইতঃপূর্বে ১৯৬৭ সালে গঠিত ট্রেডিং কর্পোরেশন অব পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের সম্পদ, দায়দেনা ও জনবল নবগঠিত টিসিবি-এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। তখন টিসিবির প্রধান কার্যাবলির মধ্যে ছিল: ১. সরকারের নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করা; ২. আমদানিকৃত পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রয় ও বিতরণ করা, পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, ও বাফার মজুত গড়ে তোলা; ৩. বাংলাদেশের প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্যের বিশ্ববাজার সৃষ্টি ও রপ্তানি করা; ৪. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বাজার তথ্য ও মূল্য পর্যবেক্ষণ করা, এবং ৫. সরকারের নির্দেশ মোতাবেক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করা। তবে রপ্তানির দায়িত্বটি পরবর্তীতে পরিত্যাগ করা হয়।

সংস্থার প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান এবং তিনজন পরিচালক সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিচালনা পর্ষদ সংস্থার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকারী। এই পর্ষদ সংগঠন, দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকারি নীতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ১৯৯৬ সালে সরকার ৭১৪ জনের জনবলসহ নতুন সাংগঠনিক কাঠামো অনুমোদন করে। এর আগে অনুমোদিত জনবল ছিল ১,৩৩৬ জন। ২০১৮-১৯ সালে ২৭৫ জন কর্মচারী/কর্মকর্তার জনবল সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ছিল। সংস্থায় প্রশাসন, অর্থ, বাণিজ্য (আমদানি ও রপ্তানি), এবং বিক্রয়, বিতরণ, মাল চলাচল, খালাস ও সংরক্ষণ বিষয়ক চারটি বিভাগ রয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থাকে সচিবের অধীনে। আর বাকি তিনটি বিভাগের দায়িত্ব তিনজন পরিচালকের ওপর ন্যস্ত। সংস্থার প্রধান কার্যালয় ঢাকার কাওরান বাজারে অবস্থিত। বর্তমানে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও রংপুরে এর সাতটি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। বিগত শতকের নববইয়ের দশকে দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি চালুর প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যের পরিধি সংকুচিত হওয়ায় সংস্থার আমদানি ও রপ্তানি কার্যক্রম বিপুলাংশে হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে হ্রাস পেয়েছে জনবল।

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি, শিল্প ও বাণিজ্যের পুনর্গঠনে টিসিবি প্রতিষ্ঠালগ্নেই গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। ১৯৭২-৭৩ সালে সংস্থাকে বিভিন্ন ধরনের ৬৩টি পণ্য আমদানি করতে হয়েছিল। আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে ছিল: সিমেন্ট, দুগ্ধজাত খাদ্য, বস্ত্র, সুতা, চিনি, ঢেউটিন, যানবাহন, ব্লেড, পিগ আয়রন, তেলবীজ, ঔষধপত্র, নারকেল তেল, টায়ার, টিউব, সাইকেল, ইত্যাদি। সেই সময় দেশের সর্বমোট আমদানির মধ্যে টিসিবির হিস্যা ছিল ২৪.৮৪% শতাংশ। পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বেসরকারীকরণ নীতি চালু হলে আমদানি বাণিজ্য হ্রাস পায় এবং দেশের মোট আমদানিতে টিসিবি'র হিস্যা দাঁড়ায় মাত্র ০.৩০% শতাংশে। বর্তমানে আমদানিকৃত পণ্যের মধ্যে রয়েছে লবণ, গোলাবারুদ, কাঠ, খেজুর, চিনি, পেঁয়াজ, মসুরের ডাল, সয়াবিন তেল ও ছোলা।

সংকটকালে আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে টিসিবিকে অনেক সময় সরকারের শেষ অবলম্বন হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। জরুরি সংকট মোকাবেলার জন্য টিসিবি পেঁয়াজ, ডাল, লবণ, শুকনা মরিচ, খেজুর, আদা, ঔষধ আমদানি করে আসছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত টিসিবি সর্বমোট ১৯,৯২৩.৭০ মিলিয়ন টাকার পণ্য আমদানি করেছে। ২০১৫-১৯ মেয়াদে টিসিবি আমদানি করেছে ১৭০১.৮২ মিলিয়ন টাকার পণ্যসামগ্রী। সাম্প্রতিক সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কষ্ট লাঘবের জন্য টিসিবি চিনি, সয়াবিন তেল, মসুর ডাল এবং ছোলা - এই চারটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করছে এবং সারা দেশে ২৮৪৯ ডিলারের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে। আমদানিকৃত সব পণ্যই নিয়োজিত ডিলার, এজেন্ট, নিজস্ব বিক্রয় কেন্দ্র, লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রয় বা বিতরণ করা হয়।

আমদানি বাণিজ্যের পাশাপাশি টিসিবি অতীতে রপ্তানিও করেছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত টিসিবি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি বাবদ ১,৫৩.০৯৮ মিলিয়ন টাকা আয় করেছে। রপ্তানিকৃত পণ্যাদির মধ্যে ছিল পাট, পাটজাত দ্রব্য, ঝোলাগুড়, চা, চামড়া, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত দ্রব্য, ইউরিয়া সার, হিমায়িত মাছ, হস্তশিল্প, সরু চাল ইত্যাদি। ১৯৭৫-৭৬ সালে টিসিবির মাধ্যমেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ হতে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। টিসিবি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক রপ্তানি মেলা ও প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে পুরস্কার, পদক এবং প্রশংসা পেয়েছে। [অনুপম হায়াৎ]