ট্যানারি

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:৪৯, ২১ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (fix: image tag)

ট্যানারি  চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার প্রক্রিয়া বা প্রতিষ্ঠান। ট্যানারি বলতে চামড়া পাকা করার কার্যক্রম পরিচালিত হয় এমন কোন স্থান বা ইমারতকেও বোঝায়। ট্যানারিতে পশুর কাঁচা চামড়াকে পাকা করার পর জুতার উপরিভাগ, ব্যাগ, স্যুটকেস, বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট প্রভৃতি উৎপাদনের উপযোগী চামড়া তৈরি করা হয়। অতীতে কতিপয় দেশীয় রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে খালি হাতে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হতো। এ অঞ্চলে ১৯৪০ সালে নারায়ণগঞ্জে প্রথম ট্যানারি স্থাপন করেন রণদাপ্রসাদ সাহা। পরবর্তীকালে ট্যানারিটি ঢাকার হাজারিবাগে স্থানান্তর করা হয়। এই ট্যানারিকে কেন্দ্র করেই হাজারিবাগ এলাকায় অনেকগুলি ট্যানারি গড়ে উঠে। দেশ বিভাগের পূর্বপর্যন্ত পূর্ববঙ্গে উৎপাদিত সকল কাঁচা চামড়া পশ্চিম বাংলায় বিশেষত, কলকাতায় রপ্তানি হতো। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের কতিপয় কোম্পানির অনুষঙ্গী প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে ট্যানারি শিল্পের উন্নয়ন ধারা শুরু হয়। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারি শিল্প এবং চামড়া রপ্তানির কার্যক্রম মূলত অবাঙালি ব্যক্তিদের হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সে সময় যে গুটিকয়েক ট্যানারি ইউনিট বাঙালি উদ্যোক্তাদের মালিকানায় ছিল সেগুলি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের। চামড়া প্রক্রিয়াকরণ কার্যক্রম প্রধানত সীমাবদ্ধ ছিল দেশীয় বাজারের জন্য। ট্যানারির মালিকদের অধিকাংশ এদেশে চামড়াকে ওয়েট ব্লু-তে রূপান্তর করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিত। সেখানে পুনঃ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে তা থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে পাকা চামড়া তৈরি করা হতো। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ট্যানারিগুলি কাঁচা চামড়ার গায়ে লবণ মাখিয়ে তারপর তা রোদে শুকিয়ে প্রক্রিয়াকরণ সম্পন্ন করত। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি আধা পাকা চামড়াকে বলা হতো শাল্টু।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অবাঙালি মালিকগণ প্রায় ৩০টি ট্যানারি ইউনিট পরিত্যক্ত হিসেবে ফেলে রেখে যায়। যুদ্ধের অব্যবহিত পর, স্বাধীন দেশের নতুন সরকার পরিত্যক্ত ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সদ্যগঠিত ট্যানারি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত করে। আশা করা হয়েছিল যে, এ ধরনের ব্যবস্থাপনায় ট্যানারিগুলি পাকা চামড়া উৎপাদন করতে সক্ষম হবে। অভিজ্ঞতার অভাব এবং দুর্নীতিসহ অন্যান্য কারণে কর্পোরেশন কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীকালে সরকার অধিকাংশ ট্যানারির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করে এবং ট্যানারি কর্পোরেশন বিলুপ্ত করে। তবে তিনটি ট্যানারির দায়িত্ব মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে দেওয়া হয়। # #চিত্র:ট্যানারি html 88407781.png

 # #চামড়া প্রক্রিয়াজতকরণ

অপ্রিয় হলেও সত্য যে, উভয় কর্তৃপক্ষই ট্যানারিগুলির ব্যবস্থাপনায় দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৮২ সালে সরকার বিলগ্নীকরণ নীতির আওতায় ট্যানারিগুলিকে ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর করে, যার ফলে কিছু উদ্যোগী বাঙালি যৎসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে শিল্প ইউনিটগুলিতে ‘ওয়েট ব্লু’ উৎপাদন শুরু করেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২০৬টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে। এগুলি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় কাঁচা চামড়ার ওপর নির্ভরশীল। এর মধ্যে ১১৪টি স্থানীয় মানদন্ড অনুযায়ী বৃহৎ ও মাঝারি আকারের, এগুলি শিল্প অধিদপ্তরে তালিকাভুক্ত। বাকি ইউনিটগুলি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প পর্যায়ের এবং এগুলি সরকারিভাবে নিবন্ধিত নয়। চামড়া শিল্পের সম্ভাব্যতার উপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যে ৩৫টি ট্যানারি আধুনিক যন্ত্রপাতির সন্নিবেশ করেছে। এ ট্যানারিগুলি উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের পাকা চামড়া উৎপাদনে সক্ষম এবং দেশের মোট কাঁচা-চামড়া উৎপাদনের ৬০% গুণগত মানসম্পন্ন ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের ক্ষমতা রাখে। ঢাকার হাজারিবাগে ৬০ একর জমির উপর ১৯০টি ট্যানারি ইউনিট রয়েছে; এলাকাটি এখন ট্যানারি এলাকা হিসাবে সুপরিচিত। বাংলাদেশ ট্যানারি মালিক সমিতির হিসাব অনুযায়ী এ শিল্পে প্রায় ৬০ হাজার শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। তাছাড়া বিদেশিসহ প্রায় ১০০ জন কারিগরি বিশেষজ্ঞও এসব ট্যানারিতে কর্মরত রয়েছেন। ট্যানারি শিল্পে মোট বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টাকা, যার মধ্যে সরকার/ব্যাংক অর্থায়নের পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন টাকা। ট্যানারি শিল্পে কাঁচা চামড়া যোগান দেওয়ার জন্য সমগ্র দেশে প্রায় দেড় হাজার ব্যক্তি কাঁচা চামড়া সংগ্রহ ও ব্যবসায়ের সাথে যুক্ত। তাছাড়া প্রায় ১০০টি প্রতিষ্ঠান ট্যানারি শিল্পে ব্যবহারের উদ্দেশে রাসায়নিক পদার্থ আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে।

বাংলাদেশে প্রতিবছর আনুমানিক ২০০-২২০ মিলিয়ন ঘনফুট চামড়া উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৮০% ভাগ ক্রাস্ট ও পাকা চামড়ায় রূপান্তরিত হয়ে রপ্তানি হয়। অবশিষ্ট চামড়া দ্বারা দেশীয় চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করা হয়। চামড়া বাংলাদেশের প্রচলিত রপ্তানি পণ্য হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু অতীতে এ খাতের আয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি। যেহেতু চামড়ার উৎপাদন ও সরবরাহ পশুসম্পদের লভ্যতা বা মাংসের চাহিদার উপর নির্ভরশীল সেহেতু স্বল্পকালীন সময়ে মোট চামড়ার সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। তবে আন্তর্জাতিক চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে বলে চামড়া খাতে আয় বৃদ্ধির একমাত্র উপায় হচ্ছে অধিক মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা খুবই উঠানামা করে বলে রপ্তানি আয়েও উত্থান-পতন ঘটে। ২০০১ সাল পর্যন্ত এ খাতের বাৎসরিক রপ্তানি আয় এক বিলিয়ন টাকা অতিক্রম করতে পারে নি। যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভব হলে এ খাতের আয়ের পরিমাণকে ৫ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা সম্ভব। বাংলাদেশে বর্তমানে যে কয়টি প্রতিষ্ঠিত ট্যানারি আছে সেগুলির মধ্যে ঢাকা লেদার, এপেক্স ট্যানারি, করিম লেদার, সমতা ট্যানারি, বে ট্যানারি, ল্যাক্সো ট্যানারি, রিলায়েন্স, কালাম ব্রাদার্স, আল মদিনা, মিল্লাত, প্রগতি, আনোয়ার, আমিন, ক্রিসেন্ট কিড লেদার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

ট্যানারি শিল্পকে সকল ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধার আওতায় আনা এবং পরিবেশ বান্ধব শিল্পে রূপান্তর করার লক্ষ্যে ঢাকার সাভারে গড়ে তোলা হয়েছে চামড়া শিল্প নগরী। যার ফলে ট্যানারি শিল্প জনবহুল হাজারীবাগ এলাকা থেকে সাভারে নিজস্ব শিল্প নগরীতে স্থানান্তর হতে যাচ্ছে।  [বেলায়েত হোসেন]