টোটেম

টোটেম কুলচিহ্ন। নৃতত্ত্ববিদদের মতে বিশ্বের সব নরগোষ্ঠীকেই ক্রমবিবর্তনের ধারায় অনেকগুলি স্তর অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। টোটেম হচ্ছে সকল মানবগোষ্ঠীর স্বস্ব প্রাথমিক পর্যায়। উনিশ শতকে উত্তর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মধ্যে টোটেম স্তরের সন্ধান পাওয়া যায়। আমেরিকার ওজিবওয়া ও অ্যালগনকিনদের ভাষায় একে বলা হয় ‘ওটোটেমান’, অর্থ ‘ভ্রাতা-ভগ্নী সম্পর্ক’। টোটেম এ শব্দ থেকেই এসেছে। এ সমাজে সমস্তরের ভাই-বোনদের মধ্যে বিবাহ এবং যৌন-সম্পর্ক নিষিদ্ধ।

উইলিয়ম ক্রুক হিন্দু মানবেতর অবতারদের টোটেম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, বরাহ, কূর্ম, মৎস্য, নৃসিংহ এবং কল্কি বা শ্বেতাশ্ব  অবতার মূলত টোটেমই। তিনি হিন্দু দেবতাদের বাহনকেও টোটেম বলেছেন। তিনি মনে করেন, ব্রহ্মার বাহন হংস, শিবের বৃষ, কার্তিকেয়র ময়ূর, অগ্নির মেষ, বরুণের মীন ইত্যাদি টোটেমবাদকেই সমর্থন করে।

বৈদিক ঋষিদের অনেকের নাম মানবেতর প্রাণীর নামে নামাঙ্কিত, যা টোটেমের স্বাক্ষর বহন করে। পরবর্তীকালে রচিত মতবাদের দরুন গোত্রগুলির টোটেমিক উৎস ঢাকা পড়ে যায়। তিনি যে দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন তা হলো: ভরদ্বাজ (ভরত পাখি থেকে), গৌতম (গরু থেকে), কাশ্যপ (কচ্ছপ থেকে), শুনক (কুকুর থেকে), মৌদ্গল্য (মাগুর মাছ থেকে), কৌশিক (পেঁচা থেকে) ইত্যাদি গোত্রের উদ্ভবের পেছনে টোটেমবাদের প্রভাব আছে।

ভারত ও বাংলাদেশের আদিবাসীদের মধ্যে টোটেম সংস্কার এখনও টিকে আছে। বাংলাদেশের সাঁওতালরা টোটেমবাদী। তাদের গোত্রগুলি গাছ-গাছড়া, জীব-জন্তু ইত্যাদি নামে পরিচিত, যেমন: হাঁসদা গোত্রের উদ্ভব হাঁস থেকে, হেমবোরোম সুপারি থেকে, মুরমু নীল গাই থেকে, মারন্নদী ঘাস থেকে এবং সোরেন গোত্র যোদ্ধা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। কেবল প্রাণী নয়, বিভিন্ন উদ্ভিদ ও ফলমূল পর্যন্ত টোটেম নামে চিহ্নিত হয়ে থাকে।  [মোমেন চৌধুরী]