টেলিযোগাযোগ

টেলিযোগাযোগ  টেলিগ্রাফের মাধ্যমে খবর আদান-প্রদানের পদ্ধতি। পরে এর ওপর ভিত্তি করে টেলিফোন আবিস্কৃত হয়। সরকারি অফিস-আদালত, বড় বড় নগরী ও মাঝারি শহরগুলির ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং অল্পসংখ্যক বিত্তবান ও সুবিধাভোগী নাগরিকের মধ্যে বিশ শতকের সত্তর দশকের শেষার্ধো পর্যন্তও টেলিফোনের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল। আশির দশকে সেলুলার বা মোবাইল টেলিফোনের বিকাশের সূত্র ধরে বদলে যেতে শুরু করে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও। এখন বাংলাদেশে টেলিযোগাযোগ সুবিধা ব্যবহার করছেন প্রায় সর্বস্তরের মানুষ।

এই উপমহাদেশে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, ১৮৫৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর ওই প্রতিষ্ঠানটিরই উত্তরাধিকারী হিসেবে গঠিত হয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগ। ১৯৭৬ সালে এ বিভাগটিকে একটি কর্পোরেট সংস্থায় রূপান্তর করা হয় এবং ১৯৭৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশবলে বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বিভাগকে পুনর্গঠন করে প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)। এ অধ্যাদেশে দেশব্যাপী বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদানের পাশাপাশি বিটিটিবিকে টেলিযোগাযোগ ও বেতার সার্ভিসের লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে একচ্ছত্র ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯৫ সালে সরকার ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশটি সংশোধন করে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বিটিটিবির পরিবর্তে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে দেয়। পরে ২০০১ সালে টেলিযোগাযোগাযোগ আইন-এর মাধ্যমে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন নামে আলাদা একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে টেলিযোগাযোগ খাতের নীতি নির্ধারণ ও তদারকির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে বিটিটিবিকে আনুষ্ঠানিকভাবে লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত করে এর নতুন নাম দেওয়া হয় বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড বা বিটিসিএল। তবে এর শতভাগ শেয়ারের মালিকানা এখনো সরকারের হাতেই রয়েছে।

বর্তমানে বিটিসিএলের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মূলত বাণিজ্যিক ভিত্তিতে টেলিফোন সেবা প্রদান। এছাড়াও তারা পাবলিক টেলিফোন সার্ভিস, টেলেক্স, টেলিগ্রাফ, দেশব্যাপী ডায়ালিং সুবিধা, ট্রান্সমিশন লিঙ্ক, ট্রাঙ্ক অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ, বৈদেশিক যোগাযোগ সার্ভিস, আন্তর্জাতিক ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ, ডাটা কম্যুনিকেশন সার্ভিস, ইন্টারনেট সার্ভিস, ডিজিটাল সাবসক্রাইবারস লাইন এবং আন্তর্জাতিক প্রাইভেট লিজড লাইন ইত্যাদি টেলিযোগাযোগ সংশ্লিষ্ট সেবা দিয়ে থাকে। ১৯৯৮-৯৯ সালের শেষদিকে দেশে বিটিটিবির সর্বমোট ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৩২২ লাইনবিশিষ্ট ৬৩১টি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ছিল। ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে ঢাকা টেলিযোগাযোগ অঞ্চলে ছয়টি এক্সচেঞ্জ স্থাপনের মধ্য দিয়ে বিটিটিবি স্থানীয় ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ চালু করে। প্রাথমিকভাবে এ এক্সচেঞ্জগুলি মোট ২৬ হাজার লাইনের ছিল। ২০১১ সাল নাগাদ সারা দেশে বিটিসিএলের অধীনে মোট ৫৮৫টি ডিজিটাল এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়। এর বাইরে ১০৮টি অ্যানালগ এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেও সেবা পরিচালনা করছে সংস্থাটি, তবে এগুলিকে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল এক্সচেঞ্জে রূপান্তরিত করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত এ সব এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে প্রায় ৮ লাখ ৭২ হাজার গ্রাহককে টেলিফোন সুবিধা দিতে সক্ষম হয় বিটিসিএল।

সাধারণ মানুষের কাছে টেলিফোন সুবিধা পৌঁছে দিতে ১৯৮৫ সালে নগর এলাকায় কয়েন বক্স টেলিফোন চালু করা হয়। একই সময়ে পল্লী অঞ্চলে টেলিকম সুবিধা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ল্যান্ডলাইনে বেতারভিত্তিক পাবলিক কল অফিস স্থাপন করা হয়। কয়েন বক্স ও পাবলিক কল অফিসের নিম্নমানের সেবাকে উন্নত করতে ১৯৯৫ সালে চালু করা হয় কার্ডফোন ব্যবস্থা। ২০০০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সমগ্র দেশে এক হাজার চারটি কার্ডফোন বুথ স্থাপন করা হয়। সকল কার্ডফোনে দেশব্যাপী সরাসরি ডায়ালিং সুবিধা এবং এগুলির মধ্যে ৭৫০টিতে সরাসরি আন্তর্জাতিক কল করার সুবিধা থাকায় কার্ডফোন ব্যবস্থা বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তবে মোবাইল টেলিফোন সেবার বিস্তৃতির পর ধীরে ধীরে এই সেবা তার কার্যকারিতা হারিয়ে বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

১৯৮৯ সাল পর্যন্ত দেশে বাণিজ্যিক টেলিফোন সেবা প্রদানের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল তৎকালীন বিটিটিবির হাতে। ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ রুরাল টেলিকম অথরিটি গঠন করে তাদেরকে দেশের ২০০টি উপজেলার টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। ওই বছরই ১৯৯টি উপজেলায় এক্সচেঞ্জ পরিচালনার দায়িত্ব পায় বেসরকারি খাতের সেবা টেলিকম। এছাড়া ১৯৮৯ সালেই বাংলাদেশ টেলিকম নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে পেজিং, রেডিও ট্রাঙ্কিং এবং নৌপথে টেলিকম সার্ভিস পরিচালনার লাইসেন্স দেওয়া হয়। ওই বছরেরই শেষ দিকে প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিফোন লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে সেলুলার মোবাইল ফোন সেবা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়। ওই বছরই কোম্পানিটি সিটিসেল নামে মোবাইল টেলিফোন সেবা দিতে শুরু করে। শুরুতে মোবাইল টেলিফোন সেবাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল। তবে ১৯৯৬ সালে গ্রামীণফোন এবং টেলিকম মালয়েশিয়া ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (একটেল ব্র্যান্ড নামে) সেলুলার মোবাইল ফোন পরিচালনার অনুমতি পেলে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে শুরু করে এ খাত। এরপর পর্যায়ক্রমে সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক (২০০৪), সেবা টেলিকম কিনে নিয়ে মিসরীয় কোম্পানি ওরাসকমের ব্যবস্থাপনায় বাংলা লিংক (২০০৫) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধাবি গ্রুপের মালিকানাধীন ওয়ারিদ (২০০৭) মোবাইল ফোন সেবা দিতে শুরু করে। মালিকানা বদলের সূত্র ধরে পরবর্তীকালে একটেল তাদের ব্র্যান্ড নাম বদলে ‘রবি’ এবং ওয়ারিদ ‘এয়ারটেল’-এ রূপান্তরিত হয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এ ছয়টি মোবাইল ফোন কোম্পানির সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা ৭ কোটি ১৫ লাখ।

মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলি ছাড়াও ২০১০ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মোট সাতটি বেসরকারি কোম্পানি পাবলিক সুইচড টেলিফোন নেটওয়ার্ক বা পিএসটিএন-এর মাধ্যমে আরো ১ লাখ ৫৫ হাজার গ্রাহককে ফিক্সড ফোন সেবা দিত।

বাংলাদেশে প্রথম ডিজিটাল টেলেক্স একচেঞ্জ স্থাপিত হয় ১৯৮১ সালের মে মাসে। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সম্পূর্ণ ডিজিটাল স্টোরেজ প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রিত মাত্র তিনটি টেলেক্স এক্সচেঞ্জ চালু ছিল। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, যশোর ও বগুড়ায় টেলিপ্রিন্টার এক্সচেঞ্জ স্থাপন করার মাধ্যমে গেটওয়ে এক্সচেঞ্জের সুইচিং নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। ২০০০ সালের জানুয়ারিতে বিটিটিবি ব্রিটিশ টেলিকমের সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশকে গ্লোবাল টেলিকম সার্ভিস-এর সঙ্গে সংযুক্ত করে। এ ব্যবস্থায় টেলেক্স এক্সচেঞ্জটির অবস্থান ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে রেখে ঢাকায় ও অন্যান্য স্থানের সঙ্গে মালটিপ্লেকস সংযোগ দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৮৯ সালে এক ধরনের টেলিগ্রাফ সার্ভিস জেনটেকস চালু করা হয়। ২০০১ সালে সারাদেশে এ ধরনের টেলিগ্রাফ সার্ভিস সেন্টারের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩৫। দেশের সকল বড় নগরী, শহর এবং সমৃদ্ধ জনপদগুলি আটটি স্বয়ংক্রিয় ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ, বেশ কয়েকটি মাইক্রোওয়েভ, ইউএইচএফ (আলট্রা হাই ফ্রিকোয়েন্সি) এবং ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি (ভিএইচএফ) সংযোগের মাধ্যমে দেশব্যাপী একটি সুসমন্বিত টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে সংযুক্ত। বাংলাদেশে মোট ৬টি ভূ- উপগ্রহ কেন্দ্র রয়েছে। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বেতবুনিয়া ও ঢাকার মহাখালিতে স্থাপিত ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র দুটি স্ট্যান্ডার্ড ‘এ’ টাইপের। এছাড়া ঢাকার ৩৩ মাইল দূরে তালিবাবাদে চালু রয়েছে একটি স্ট্যান্ডার্ড ‘বি’ টাইপের ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র। তিনটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে এক্সচেঞ্জের সঙ্গে সংযুক্ত এ ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রগুলির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব হয়।

ঢাকায় ১৯৮৩ সালে একটি স্বয়ংক্রিয় ডিজিটাল আন্তর্জাতিক ট্রাঙ্ক এক্সচেঞ্জ (আইটিএক্স) স্থাপিত হয়। ২০১১ সালে এ ধরনের এক্সচেঞ্জের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ডিজিটাল এক্সচেঞ্জসমূহের মাধ্যমে সরাসরি আন্তর্জাতিক ডায়ালিং-এর সুবিধা রয়েছে। বৈদেশিক টেলিফোন কল নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল লং ডিসট্যান্স টেলিকমিউনিকেশন্স সার্ভিস পলিসির আওতায় ২০০৮ সালে বিটিআরসি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে দুটি ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ (আইটিএক্স), তিনটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লু) এবং একটি আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ছয়টি বেসরকারি কোম্পানিকে পরিচালনার লাইসেন্স দেয়। পাশাপাশি বিটিসিএলও এ সেবাগুলি দেওয়ার লাইসেন্স পায়।

টেলিযোগাযোগ খাতের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ইন্টারনেটের ব্যবহার বাংলাদেশে শুরু হয়েছে তুলনামূলক দেরিতে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বোর্ড ঢাকা এবং অন্য চারটি বড় শহরে (চট্টগ্রাম, বগুড়া, খুলনা ও সিলেট) ইন্টারনেট গ্রাহকদের লিজড লাইন ও ডায়াল আপ সুবিধা দেওয়া শুরু করে। মহাখালি ভূকেন্দ্রের মাধ্যমে কানাডার টেলিগ্লোবের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ইন্টারনেটে প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৯৬ সালে ভিস্যাটের মাধ্যমে এ সেবা প্রদানের অনুমতি পায় বিভিন্ন বেসরকারি ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি (আইএসপি)। ২০০৫ সালে দেশে আইএসপি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৮০। ২০০৪ সালে সাবমেরিন কেবলের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে সংযুক্ত হয় বাংলাদেশ। SEA-ME-WE 4 cable system হিসেবে পরিচিত এই নেটওয়ার্কের সদস্য বাংলাদেশসহ বিশ্বের মোট ১৫টি দেশ। ১৮,৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই কেবল নেটওয়ার্ক দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও আফ্রিকার দেশগুলির সংযোগ স্থাপন করেছে। বাংলাদেশে এ নেটওয়ার্কের ল্যান্ডিং স্টেশন স্থাপিত হয়েছে কক্সবাজারে, সেখান থেকেই বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ব্যাকবোনের সাহায্যে সারা দেশে এর সংযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক টেলিফোন কল এবং ইন্টারনেট ব্যবস্থা বর্তমানে মূলত এ নেটওয়ার্কের ওপরই নির্ভরশীল। ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল কোম্পানি লিমিটেড নামে বিটিসিএলের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এ নেটওয়ার্কের তদারকি করছে।  [মাহবুবুল আলম]