জিনোম এডিটিং

জিনোম এডিটিং (Genome Editing) জিন (Gene) জীবন্ত প্রাণের বংশগতির আণবিক একক। ডেনিশ উদ্ভিদবিদ উইলহেলম লুডভগি জোহানসেন বংশগতির মেন্ডেলিয়ান এককগুলিকে বর্ণনা করতে ১৯০৯ সালে প্রথম ‘জিন’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ইংরেজি ‘এবহব’ শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘জেনেসিস’ বা ‘জিনোস’ থেকে। ‘জেনেসিস’ অর্থ ‘জন্ম’। ‘জিনোস’ অর্থ ‘অঙ্গ’। কোনো প্রজাতির প্রতিটি স্বতন্ত্র জীব যেসব বংশগতিমূলক তথ্য বা ‘জিন’ বহন করে, তাদের সমষ্টিকে সামগ্রিকভাবে জিনোম বা বংশাণুসমগ্র বলে। কোনো জীবের বংশাণুসমগ্র বা জিনোমে ঐ জীবের বংশগতিমূলক সমস্ত তথ্য একসাথে জমা থাকে। একটি জীবের জিনোম হলো কোষে উপস্থিত সমস্ত ডিএনএ (DNA, ribonucleic acid) অণুর সমষ্টি। আরএনএ (DNA, deoxyribonucleic acid) ভাইরাসের জন্য, জিনোম হলো সেই ভাইরাস কণার আরএনএ অণুর সমষ্টি। ডিএনএ বা আরএনএ তৈরি হয় যে গঠন একক দিয়ে, তাদেরকে বলা হয় নিউক্লিওটাইড। অনেকগুলো নিউক্লিওটাইড একের পর এক সজ্জিত হয়ে ডিএনএ বা আরএনএ-এর সূত্রক তৈরি হয়।

জিনকে পরিবর্তন করে যেকোনো জীবের বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন করা সম্ভব। কোনো নির্দিষ্ট জীবের জিনোম সিকোয়েন্সের যেকোনো অংশে সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন আনার মাধ্যমে ঐ জীবের মাঝে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য সংযোজন-বিয়োজন বা পরিমার্জন করা যায়। ডিএনএ সূত্রকের কোনো নিউক্লিওটাইড বাদ দেওয়া, নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করা বা নিউক্লিওটাইড-এর ক্রমপরিবর্তন করার মাধ্যমে জীবে কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য পরিমার্জন করার প্রযুক্তিই হলো জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি।

জিনোম এডিটিং অনেকটা কম্পিউটারের ওয়ার্ড প্রসেসরে লেখা এডিট বা সম্পাদনা করার মতো। আমরা যেমন লেখার ভেতর কোনো শব্দ বা অক্ষরকে ইচ্ছে মতো পরিবর্তন করতে পারি, তেমনি বিজ্ঞানীরা এমন কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা দিয়ে তারা জিনোমের ভেতরে ইচ্ছেমতো জিনের পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। একেই আমরা বলছি জিনোম এডিটিং। জীবন্ত প্রাণকে কম্পিউটার সফটওয়্যার-এর মতো সহজে বদলানোর প্রযুক্তিই হলো জিনোম এডিটিং। জিনোম এডিটিং এখন জীবপ্রযুক্তির জগতে এক বাস্তবতা।

এ পর্যন্ত চারটি জিনোম এডিটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলি হলো, জিঙ্ক ফিঙ্গার নিউক্লিয়েজ (ZFN), ট্রান্সক্রিপশন-অ্যাক্টিভেটর লাইক ইফেক্টর নিউক্লিয়েজ (TALEN), মেগানিউক্লিয়েজ এবং ক্লাস্টারড রেগুলারলি ইন্টারস্পেসড শর্ট প্যালিনড্রোমিক রিপিটস (ক্রিসপার-কাস/CRISPR-Cas) সিস্টেম। এদের মধ্যে, ক্রিসপার-কাস হলো জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির সর্বশেষ সংযোজন এবং এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ পদ্ধতি। অন্যান্য পদ্ধতি জটিল এবং জিনোম এডিটিং-এর জন্য ব্যবহারকারী-বান্ধব নয়। কারণ, এই পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করার জন্য অসুবিধাজনক ও কষ্টসাধ্য প্রোটিন ডাইজেশন, সংশ্লেষণ এবং যথার্থতা (Validity) যাচাই আবশ্যক। অন্যদিকে, ক্রিসপার-কাস পদ্ধতি এসব বিবেচনায় অনেক বেশি সহজ ও সুবিধাজনক। যেমন (ক) এটি কম ব্যয় সাপেক্ষ এবং সহজেই প্রয়োগ করার মতো প্রযুক্তি। (খ) এই প্রযুক্তি অনেক বেশি সূচারুভাবে জিনোমের নির্দিষ্ট জায়গায় পরিমার্জন করার জন্য খুব সরল প্রকৃতির উপাদানের ওপর নির্ভর করে তৈরি। (গ) পছন্দের জিনোমের ওপর ভিত্তি করে এবং একাধিক জিনকে উদ্দেশ্য করে সহজেই ক্রিসপার-কাস সিস্টেম ডিজাইন করা যায়, যার মাধ্যমে একইসাথে ঐসব জিনকে এডিটিং করা যায়। (ঘ) এই প্রযুক্তিতে সম্পাদিত জিনের পরিবর্তনগুলো স্থিতিশীল এবং বংশানুক্রমে স্থানান্তরিত হয়। (ঙ) সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, এ প্রক্রিয়ায় মাত্র কয়েক প্রজন্মের মধ্যে ট্রান্সজিন-মুক্ত উদ্ভিদ উন্নয়ন সম্ভব। (চ) সম্পাদিত উদ্ভিদ/জাত উদ্ভিদ প্রচলিত প্রজননের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

২০১২ সালে বিজ্ঞানী এমানুয়েল শারপাঁতিয়ে এবং জেনিফার ডাউডানা ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং হলো একটি অত্যন্ত শক্তিশালী টুলবক্স, যা যেকোনো জীবের ডিএনএ/জিনোম সুনির্দিষ্ট এবং নির্ভুলভাবে এডিটিং করতে ব্যবহার করা হয়। ইতোমধ্যে ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি সফলভাবে উদ্ভিদসহ অনেক জীবের জিনোম এডিটিং-এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। জিনোম এডিটিং-এর ফলে কোনো জীবে নতুন এবং কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। মাল্টিপ্লেক্স জিনোম এডিটিং ডিজাইন করে একটি উদ্ভিদ বা প্রাণির একাধিক বৈশিষ্ট্য একই সময়ে পরিবর্তন (উন্নত) করা যায়। ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং সাইট নির্দেশিত নিউক্লিয়েজ (এসডিএন) ব্যবহার করে জিনোমের নির্দিষ্ট অবস্থানে (যেমন ডিএনএ সিকোয়েন্স) একটি পছন্দসই পরিবর্তন করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো নিউক্লিওটাইড বা বেস অপসারিত বা নক-আউট করা, প্রতিস্থাপন করা বা একাধিক নিউক্লিওটাইড বা বেস (ক্ষারক) যোগ করা হতে পারে।

ক্রিসপার-কাস জিনোম এডিটিং পরিবর্তনশীল জলবায়ুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া নতুন উচ্চ ফলনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য অত্যন্ত দ্রুত এবং সুনির্দিষ্ট প্রযুক্তি হিসাবে স্বীকৃত। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক উদ্ভিদের জিনোম এডিটিং করা হয়েছে। অন্তত, দুটি জিনোম এডিটেড ফসল ইতোমধ্যে বর্তমানে বাজারে রয়েছে। উভয় ফসলই ভোক্তার স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এডিটিং করা হয়েছে। এগুলি হলো কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট ধারণকারী সয়াবিন তেল (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে) এবং গামা অ্যামিনোবুটারিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ টমেটো (জাপানে), যা উচ্চ রক্তচাপ কমায় এবং মানব স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

শুধু কৃষিতেই নয়, জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি রোগ নির্ণয়, মানুষ ও প্রাণীর জেনেটিক ও বিপাকীয় রোগ নিরাময়ে বিপ্লব ঘটাবে। জ্বালানি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। ক্রিসপার-কাস সিস্টেম মৌলিক গবেষণার জন্যও একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। ২০১২ সালে আবিষ্কারের পর থেকে অত্যন্ত বিষ্ময়কর গতিতে এ প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নানা জীবের জিনোম এডিটিং-এর ব্যবহার এগিয়ে চলেছে। [মো. তোফাজ্জল ইসলাম]