জমিদার

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২০:৫৬, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

জমিদার  ফারসি যামিন (জমি) ও দাস্তান (ধারণ বা মালিকানা)-এর বাংলা অপভ্রংশের সঙ্গে ‘দার’ সংযোগে ‘জমিদার’ শব্দের উৎপত্তি। মধ্যযুগীয় বাংলার অভিজাত শ্রেণির ভূম্যধিকারীদের পরিচয়জ্ঞাপক নাম হিসেবে শব্দটি ঐতিহাসিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুগল আমলে জমিদার বলতে প্রকৃত চাষির ঊর্ধ্বে সকল খাজনা গ্রাহককে বোঝানো হতো। প্রকৃত চাষি জমিদার নয়, কারণ সে কখনও তার জমি খাজনা বা ভাড়ায় অন্য কাউকে প্রদান করে না। জমিদাররা শুধু খাজনা আদায়ের স্বত্বাধিকারী, জমির স্বত্বাধিকারী নয়। পক্ষান্তরে, জমির মালিকদের বলা হতো রায়ত বা চাষি যাদের নামে জমাবন্দি বা রেন্ট-রোল তৈরি হতো। এ ধারণায় জমিদারগণ রাজস্বের চাষি ছিল মাত্র। এরা ছিল সরকার এবং হুজুরি (স্বতন্ত্র) তালুকদার ব্যতীত নিম্নস্তরের রাজস্ব চাষিদের মধ্যস্থ পক্ষ। হুজুরি তালুকদারগণ খালসায় (খাজাঞ্চি খানায়) সরাসরি রাজস্ব প্রদান করত।

জমিদার এ পদবি বা শব্দটি ভূঁইয়া বা ভূপতি নামে যে দেশিয় পারিভাষিক শব্দটি প্রচলিত আছে তার সরাসরি প্রতিশব্দ বলা যায়। এ ভূঁইয়া বা ভূপতিরা ছিল ভারতের প্রাক্-মুগল আমলের বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারসূত্রে জমির মালিক। মুগলগণ তৎকালে প্রচলিত ভূমি ব্যবস্থাকে তাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের জন্য একটি নতুন ব্যবস্থায় রূপান্তর করে। অবশ্য চিরাচরিত ক্ষমতা ও উৎপাদনের উপায়গুলি তেমন বিশেষ পরিবর্তিত হয়নি। মুগলদের আমলে গড়ে ওঠা জমিদারি বৈশিষ্ট্যগতভাবে সব এলাকায় একই রকম ছিল না, এমনকি, বাংলা-বিহার ও উড়িষ্যার সুবাহগুলির ভেতরেও অঞ্চলভেদে পার্থক্য ছিল। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে রাজপক্ষ সরাসরি জমি নিয়ন্ত্রণ করত, কিন্তু বাংলায় সরকার কখনও তা করে নি। আকবরের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার (১৫৮২) লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি-চাষিকে সরাসরি বন্দোবস্ত দান, যা নানা কারণে সুদূর বাংলা প্রদেশে সম্ভব ছিল না। এর অন্যতম কারণ বাংলাদেশের বিশেষ ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত বৈশিষ্ট্য। প্রাক্-আধুনিক যুগে বাংলায় জমি কেবল উৎপাদনের অন্যতম প্রয়োজনীয় বিষয়ই ছিল না, জমি ছিল মর্যাদার প্রতীক এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির একটি উৎস। এ কারণে উচ্চাভিলাষী ব্যক্তিদের জন্য জমির ওপর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটি ছিল নানা ধরনের সম্ভাবনার ধারক ও বাহক।

বাংলার জমিদার  মুগলদের বাংলা জয়ের পর জমিদার একটি বিশেষ পদবি হয় এবং জমিদার বলতে বোঝায় বিভিন্ন ধরনের জমি ও অধিকারের মালিক। স্বায়ত্তশাসিত কিংবা আধা স্বাধীন সর্দার বা গোষ্ঠীপ্রধান থেকে শুরু করে স্বত্বাধিকারী  কৃষক যে কেউ জমিদার হয়ে উঠতে পারত। স্বাধীন বা আধা-স্বাধীন সর্দার বা প্রধানরা বশ্যতাক্রমে বা মিত্রতাক্রমে পেশকাশি (নজরানা প্রদানকারী) অধস্তন মিত্রে পরিণত হয়। কিন্তু তাদের প্রশাসনিক স্বশাসনের অধিকার কার্যত অক্ষুণ্ণ থাকে। আর বাকি সকলেই প্রায় মালজামিন (ভূমি রাজস্ব প্রদানকারী) ছিলেন। তারা মুগলদের জন্য রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। মুগলরা স্বশাসিত অথবা সীমান্ত অঞ্চলের সর্দার বা প্রধানদের ছাড়া জমিদার শ্রেণির বাকি সকল ব্যক্তির বংশানুক্রমিক পদমর্যাদা খর্ব করে। তাদের ওয়ারিশগণ জমিদারিতে বহাল থাকবে কিনা তা কিছুটা হলেও ছিল দেশের সার্বভৌম শাসকের ইচ্ছাধীন। বিদ্রোহ করলে কিংবা নির্ধারিত রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে তাদেরকে অপসারণ করা যেত। শাসককে পরিতুষ্ট করার বিনিময়ে এ জমিদাররা বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা যেমন, খিলাত (মর্যাদাসূচক পরিচ্ছদ) ও খেতাব লাভের অধিকারী ছিলেন। তাদের মর্যাদা, সম্পদ ও অন্যান্য বিষয়ের দ্বারা নির্ধারিত হতো ঐসব অধিকার।

প্রাক্-আধুনিক ভারতে বেসামরিক প্রশাসন প্রধানত রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ের ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো। সে কারণে জমি প্রদানের সঙ্গে বেশকিছু প্রশাসনিক দায়িত্বও অর্পণ করা হতো। এ দায়-দায়িত্বের আওতায় জমিদারগণকে রাজস্ব নির্ধারণের বিশদ বিবরণ প্রণয়ন, চাষিদের কাছ থেকে খাজনা আদায় এবং তা রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অর্পণ করতে হতো। এ ছাড়াও স্থানীয় এলাকায় শান্তি রক্ষার কাজে রাজকীয় কর্মকর্তাদেরকে সাহায্য-সহায়তা এবং প্রয়োজনে সেনা সরবরাহ করতে তারা বাধ্য ছিলেন। উচ্চতর শ্রেণির ভূম্যধিকারীদের শক্তি ও কর্তৃত্বের আংশিক উৎস ছিল জমিতে উৎপন্ন ফসল ও অন্যান্য সামগ্রীতে তাদের ভাগ এবং অংশত স্থানীয় জনপদে তাদের সনাতন আভিজাত্যপূর্ণ মর্যাদাগত অবস্থান। সম্রাটের সনদে এ শ্রেণির লোকদেরকে যে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য পালনের দায়িত্ব দেওয়া হতো সেগুলি পালনে তাদের এ অবস্থানগত মর্যাদা ও পরিস্থিতি বেশ অনুকূল ছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত (১৭৯৩) প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত জমিদারদের মৌলিক অধিকার ও দায়িত্ব-কর্তব্য অপরিবর্তিত থাকলেও শাসক অভিজাত মহলের চাহিদার উপযোগী করার জন্য ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কাঠামোতে মাঝে মাঝে কিছু রদবদল করা হয়। এভাবেই টোডরমলের বন্দোবস্ত (১৫৮২) যা দূরবর্তী বাংলা সুবাহ একদিন জমিদারি পদ্ধতির সূচনা করেছিল, তা ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত বজায় থাকে। এ সময়ে বাংলার সুবাহদার শাহ সুজার (১৬৫৭) রাজস্ব বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদারি ব্যবস্থায় কিছুটা বল সঞ্চার হয়। এরপর ১৭২২ সালে সুবাহদার মুর্শিদ কুলীর মালজমিনি (ভূমি রাজস্ব) পদ্ধতি প্রচলিত হয়। সরকারি রাজস্ব সর্বাধিক করা ও রাজস্বের নিয়মিত পরিশোধ নিশ্চিত করার জন্য মুর্শিদ কুলী বাংলা প্রদেশকে পূর্ববর্তী চৌত্রিশটি সরকারের পরিবর্তে তেরোটি চাকলায় (প্রশাসনিক বিভাগ) ভাগ করেন। আর সেসঙ্গে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র জমিদারদের চাকলাদারের এখতিয়ারাধীন করেন। এ চাকলাদারগণ মনোনীত হন বৃহৎ জমিদারবর্গ থেকে আর তারা জমির মালিক হিসেবে নয় অধস্তনদের তত্ত্বাবধায়ক কর্মকর্তা হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তাদের কাজ ছিল দক্ষতার সঙ্গে রাজস্বের আদায় ও সংগ্রহ নিশ্চিত করা। তবে প্রধান জমিদারগণকে রাজস্বের রাজকীয় অংশের জন্য খালসা বা রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কাছে জবাবদিহি করার ফলে তাদের সনাতন ক্ষমতা ও মর্যাদাগত অবস্থান আরও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও প্রতিভাবান জমিদারগণকে বিভিন্ন সরকারি পদে নিযুক্তির যে প্রস্তাব দেওয়া হয় তার ফলে রাজদরবারে তাদের অবস্থানগত মর্যাদা বৃদ্ধি ও সেসঙ্গে তাদের নিজ স্বার্থকে আরও এগিয়ে নেবার সম্ভাবনা অনেক দূর প্রসারিত হয়। রাজস্ব ব্যবস্থাপকের ভূমিকা থেকে জমিদারে রূপান্তরিত হওয়ার এ প্রক্রিয়া আঠারো শতকের মাঝামাঝি নাগাদ সম্পূর্ণ হয়।

রাজস্ব ব্যবস্থাপনা  সর্বাগ্রে জমিদারের কর্তব্য ছিল রাজস্ব সংগ্রহ ও সে রাজস্ব নিয়মিতভাবে রাজকোষে পরিশোধ করা। প্রায় সকলক্ষেত্রেই এ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্ধারণ করত। রাজকীয় সনদে জমিদারিতে প্রদত্ত অধিকারগুলির কারণে জমিদারগণ রায়ত বা চাষিদের সঙ্গে একটি রফায় আসতে ও তাদেরকে উৎসাহিত করে আবাদের উন্নতি সাধনে দায়িত্বশীল থাকতেন। এর ফলে গোটা দেশের শ্রীবৃদ্ধি ঘটত এবং দেশের উৎপাদনও বেড়ে যেত। জমিদারদের প্রদেয় রাজস্ব ছিল তিন ধরনের। প্রথম ধরনের রাজস্ব হলো মাল যা আবাদযোগ্য জমি এবং বনভূমি, বাগান, জলা ও পুষ্করিণী থেকে প্রাপ্ত খাজনা বিশেষ। দ্বিতীয় শ্রেণির রাজস্ব ছিল সায়ের। রাজস্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ উৎসের আওতায় ছিল টোল ও আবগারি শুল্ক যা আদায় হতো নৌচলাচল ও বাজার থেকে এবং বিভিন্ন সেবাকর্মে নিয়োজিত শ্রেণির লোকজন প্রদত্ত ফিস থেকে। তৃতীয় শ্রেণির রাজস্ব ছিল জরিমানা, বাজেয়াপ্তি ও বিবাহ ফি বাবদ আয় যা বাজি জমা নামে অভিহিত ছিল। যে নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ জমিদারকে পরিশোধ করতে হবে সেটি জমির যথার্থ পরিমাপ দ্বারা নির্ধারিত হতো না এবং ওই জমিতে উৎপন্ন ফসল বা সম্পদের মূল্য নিরূপণের ভিত্তিতেও স্থির হতো না। বরং এটি নির্ধারিত হতো এক ধরনের সংক্ষিপ্ত মূল্যায়নের মাধ্যমে যার নাম ছিল নসাক। জমিদারগণ একটি নির্ধারিত অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতেন, তবে নবাব তা নিজ ইচ্ছানুযায়ী বৃদ্ধিও করতে পারতেন। অবশ্য এ ক্ষমতা ক্বচিৎ প্রয়োগ করা হতো। মালওয়াজিবি জমিদারদের কাছ থেকে রাজস্বের দাবি আবাদযোগ্য জমির ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো। জমিদারদেরকে পতিত ও বনজঙ্গল থেকে জমি উদ্ধারে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়ে থাকলে তাদেরকে সেসবের নিষ্পত্তির ক্ষমতাও দেওয়া হতো। দাতব্য ও ধর্মীয় ওয়াক্ফ বা দেবোত্তর কাজে এ পতিত জমি ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হতো। এ ধরনের দাতব্য তালুক গড়ে তোলা হতো বিভিন্ন ধরনের বন্দোবস্তধারীদের আওতায়। পুনরুদ্ধারকৃত জমিকে সাধারণত খামার নামে অভিহিত করা হতো। এ খামারের উৎপন্ন দ্রব্য ভাগাভাগি করে নিত জমির চাষি ও জমিদার। এভাবে এ তালুক জমিদারদের জন্য বাড়তি আয়ের স্থায়ী উৎস হয়ে ওঠে। বড় আকারের জমিদারিগুলিতে জমির খাজনা ওই জমির প্রকৃত মূল্যের চেয়ে সাধারণত অনেক কম হতো। সরকার এ তথ্য অবগতির ভিত্তিতে মাঝে মাঝেই জমিদারদের ওপর  আবওয়াব অথবা সেস ধার্য করতেন।

জমিদার-রায়ত সম্পর্ক  জমাবন্দি দ্বারা জমিদারদের ওপর সরকারের রাজস্ব দাবি নির্ধারিত হলেও একজন রায়তের করের পরিমাণ কি হবে তা জমিদারগণ নির্ধারণ করতেন। এ বিষয়ে তথ্যের নিদারুণ অভাবহেতু খাজনার সঠিক হার কি ছিল তা নির্ণয় করা কঠিন। তখন মানুষ ও জমির অনুপাত সর্বদাই মানুষের অনুকূলে থাকায় জমিদারগণ রায়তদের ওপর নিপীড়নমূলক দাবি চাপাতে পারতেন না। এ রায়তদের তালুকে রাখার ব্যাপারে জমিদাররা বুঝতে পারেন যে, রায়তের অধিকার ও সনাতন সুযোগ-সুবিধাগুলির নিরাপত্তা বিধান শেষপর্যন্ত তাদের নিজেদের স্বার্থেরই অনুকূল।

পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকা  মুগল আমলে সকল শ্রেণির জমিদারকে পুলিশ, বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করতে হতো। রাজস্বগত ও রাজনৈতিক কিছু কিছু অধিকার হাতে থাকায় জমিদারগণ স্থানীয় পর্যায়ে বিপুল প্রভাবের অধিকারী ছিলেন। এর ফলে তারা তাদের নিজ নিজ এলাকার চৌহদ্দিতে হয়ে উঠতেন অবিসংবাদিত সার্বভৌম ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তবে বাংলার পল্লী অঞ্চলে এ আমলে পূর্ণাঙ্গ পুলিশ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে নি। আর সেকারণে কিছু রাজস্ব কর্মচারীকে যুগপৎ পুলিশের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রামসরঞ্জামি পাইকের নাম উল্লেখ করা যায়। এ পাইকগণকে প্রধানত জমিদারকে খাজনা আদায়ে ও ক্ষেতের ফসল রক্ষায় সহায়তা করার জন্য নিযুক্ত করা হতো। এরা এলাকায় চোর-ডাকাত ধরা, শান্তি রক্ষা এবং হাট-বাজার ও মেলার মতো জনসমাগমের স্থানগুলিতে আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দায়ী ছিল। বড় বড় জমিদারদের নিয়মিত পুলিশ বাহিনী ছিল এবং তাদেরকে থানা পদ্ধতির আওতায় সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রণ করা হতো। থানা ছিল বৃহত্তম পুলিশ ইউনিট আর এ থানাগুলির আওতায় ক্ষুদ্র এখতিয়ারগুলির নাম ছিল চৌকি কিংবা ফাঁড়ি। মুগল আমলের স্বর্ণযুগে থানায় সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের অধিকারী ছিলেন ফৌজদার। তিনি নামমাত্র জমিদারি নিয়ন্ত্রণের আওতায় থাকতেন। বাংলার নবাবি আমলে এ থানাগুলি ক্রমান্বয়ে এক চেটিয়া জমিদারি তালুকগুলির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

আঞ্চলিক বৃহৎ জমিদারিগুলির জমিদারদের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা ছিল। বিচারক ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা তাদের জন্য এক রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের মর্যাদার অনুরূপ ও সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক ক্ষমতারও অধিকারী হওয়ায় স্বভাবতই এ জমিদারগণ কার্যত তাদের নিজ নিজ এখতিয়ারাধীন অঞ্চলের একচ্ছত্র প্রভু হয়ে ওঠেন। তারা নিয়মিত আদালতে বসতেন। একে বলা হতো জমিদারি আদালত। এ আদালতের সুবাদে জমিদারগণ কেবল ক্ষমতা ও মর্যাদাই পাননি, জরিমানা, নজরানা উপহার ও অন্যান্য মাধ্যমে তাদের কিছু আয়েরও ব্যবস্থা হয়ে যায়। ছোটখাটো জমিদাররা পর্যন্ত দীউয়ানি ও ফৌজদারি বিচার পরিচালনায় কিছু কিছু ভাগ পেতেন। চৌধুরীরা ছিলেন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ রকমের ছোট জমিদার। দেনা দায়, চুরি ও ছোটখাটো কলহ-বিবাদ সম্পর্কিত অভিযোগের বিচার ও জরিমানা তারা করতে পারতেন। দন্ডপ্রদান-সংক্রান্ত কোনো স্থাপনা না থাকায় অপেক্ষাকৃত আরও ক্ষুদ্র জমিদারগণ জেল বা সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড প্রদানের যোগ্য গুরুতর ও জটিল ধরনের মামলাগুলি নিকটবর্তী কাজীর আদালত বা থানাদারের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। বিবাদ-বিসম্বাদের ক্ষেত্রে সুখ্যাতির অধিকারী অভিজাত ও অত্যন্ত কুলীন মর্যাদার জমিদারকেই সবচেয়ে বাঞ্ছিত সালিশদার হিসেবে গণ্য করা হতো। তবে কোনো কোনো প্রধান জমিদার আভিজাত্যের সোপানক্রমে অপেক্ষাকৃত নিচুস্তরের মর্যাদার অধিকারী হলেও দেখা যেত তারাও প্রয়োজনের তাগিদে কুলীনদের বিবাদেরও নিষ্পত্তি দিচ্ছেন। বাস্তবিকপক্ষে, স্থানীয় পঞ্চায়েত (বর্ষীয়ান সভা) ক্ষতিগ্রস্ত তরফকে সন্তুষ্ট করতে ব্যর্থ হলে, জমিদারদের কাছে বিবাদের বিষয়ে আপিল পেশ করা হতো। জমিদারি বিচার সহজে হাতের নাগালে পাওয়া সম্ভব হলেও এবং বিচার-ব্যয় সুলভ ও দ্রুততর হলেও, নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা একই ব্যক্তিতে ন্যস্ত করার সহজাত কিছু দুর্বলতাও ছিল। স্থানীয় স্বশাসনের সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো জমিদার প্রজাবর্গের জন্য অত্যাচারী হয়ে উঠতেন। এ ধরনের আশঙ্কা এড়ানোর জন্য সরকার সর্বদা ব্যক্তি জমিদারদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন।

জমিদারগণ, বিশেষ করে, প্রধান জমিদারগণকে ফৌজদারি সার্কেলে নিয়োজিত ফৌজদার বা সামরিক গভর্নরকে সামরিক সহায়তা যোগানোর শর্ত পালন করতে হতো। তারা কোনো গুরুতর ধরনের বিদ্রোহ বা বহিরাক্রমণের ক্ষেত্রে ফৌজদারকে সীমিত সংখ্যক সেনা ও ভারবাহী পশু যোগান দিতেন। মুগলগণ বড় আকারের স্থায়ী সেনাবাহিনী রাখতনা বলে তাদেরকে আঞ্চলিক সর্দার বা প্রধান, গোষ্ঠী বা গোত্র প্রধানের মধ্য থেকে পরোক্ষ পর্যায়ে বাছাইকৃত সেনা যোগানের ওপর খুব বেশি নির্ভর করতে হতো। এমনকি, কোনো কোনো জমিদার আবার ব্যক্তিগতভাবে মুগল সম্রাটের রাজকীয় বাহিনীর মনসবদারি (অভিজাত রাজপুরুষ, যার সামরিক খেতাব বা পদমর্যাদা থাকত) কর্মকর্তার তালিকারও অন্তর্ভুক্ত থাকতেন। তাদের এ সেবার জন্য (তাদের মর্যাদা অনুপাতে) জায়গির মঞ্জুরির মাধ্যমে বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হতো। এ ছাড়াও সমভূমির ও নদীমাতৃক দেশ বাংলার প্রবল মৌসুমি বর্ষণজনিত কারণে এদেশে অশ্বারোহী বা গোলন্দাজ বাহিনী মোতায়েন কার্যত ছিল নিষ্ফল। তাই এসব বাহিনী যেটুকু কিছু কাজে লাগত তা শুধু গ্রীষ্মেই। এরকম পরিস্থিতিতে বিদ্রোহী সর্দার/প্রধান,  মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের মোকাবেলা করার জন্য মুগলদেরকে জমিদারদের সামরিক সাহায্য-সহায়তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হতো। মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা তখন মাঝে মাঝেই বাংলার দক্ষিণ ও পূর্ব সীমান্তে হানাদারিতে নিয়োজিত ছিল। জমিদাররা সেনাবাহিনীর জন্য রসদ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর যোগান দিতে ও সরকারের দুশমনদের সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দিতে দায়বদ্ধ ছিল। বিরাট অঞ্চলের বড় জমিদারগণ তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে প্রতিরক্ষা, কৃষি ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং রাজস্ব প্রেরণ ইত্যাদির নিরাপত্তা ও রায়ত বা প্রজাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সামরিক স্থাপনা রাখতে পারতেন। তবে কেন্দ্রীয় শক্তি তথা মুগল সম্রাটের কর্তৃত্ব হ্রাস পাওয়া ও পরবর্তীকালে বাংলা সুবার অস্থির পরিস্থিতির কারণে বাংলার জমিদার অভিজাতবর্গের ওপর নবাবের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়ে। নবাব ও মারাঠা এবং নবাব ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সংঘাতের জোয়ার-ভাটার সঙ্গে তাল রেখে জমিদাররা তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করত।

সামাজিক ভূমিকা  জমিদারগণ সুবিধাভোগী উত্তরাধিকারমূলক অবস্থানের সুবাদে তাদের নিজস্ব জমিদারি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, আদালত ব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত জীবনধারা গড়ে তোলে আর জাঁকজমক ও বিলাসিতায় একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। প্রাক্-ব্রিটিশ আমলে তালুকে অনুপস্থিত জমিদারের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। যারা কানুনগো বা চৌধুরী হিসেবে তাদের সরকারি অবস্থান বজায় রাখে তারা ছিল একই লোকালয়ের জমিদার। আর সে কারণে ভূম্যধিকারী এ শ্রেণির সামাজিক কার্যকলাপ সাধারণত তাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র রাজ্যের চৌহদ্দিতেই সীমিত থাকে। তাদের বিলাসী জীবনধারার পরিপ্রেক্ষিতে মিহি সুতিবস্ত্র, উৎকৃষ্ট রেশম বস্ত্র ও পণ্য, রত্নালঙ্কার, কারুকার্যখচিত তরবারি ও অস্ত্র তৈরির স্থানীয় নানা শিল্প ও কারুকলা এবং ক্ষুদ্রশিল্পকে সবিশেষ উৎসাহিত করে। সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব-পরবেও এ বড় জমিদারদের ব্যয়বাহুল্য সমাজে সম্পদের সঞ্চালনকেও কমবেশি বৃদ্ধি করেছে। জমিদারদের দরবার ছিল নবাব দরবারের অনুকরণে নির্মিত। তাদের মুগল পোশাক-পরিচ্ছদ, খানাপিনা, শিল্পকলা ও স্থাপত্যকলা চর্চার কারণে তুর্কি-ফারসি এবং দেশজ সংস্কৃতির মধ্যে এক ধরনের সমন্বয়ের পথই প্রশস্ত হয়।

মুগল শাসকদের অধীনে জমিদাররা যত না রাজস্ব সংগ্রাহক প্রতিনিধি ছিলেন তার চেয়েও বেশি ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা বা রাজপুরুষ। জমিদারি তখন উত্তরাধিকারসূত্রে বহাল রাখার অনুমতি দেওয়া হলেও জমিদারদের কিন্তু তাদের তালুকের স্বত্বাধিকারী বলে বিবেচনা করা হতো না। তখন জমিদারি তালুকগুলি কখনও জমিদারদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিভাজনযোগ্য কিংবা কারও কাছে হস্তান্তরযোগ্য ছিল না। আর সে কারণে মুগল আমলে উত্তরাধিকারসূত্রে কেউ জমিদারি পেতো না। তবে মৃত জমিদারের উত্তরাধিকারী সরকারের কাছ থেকে নতুন সনদসূত্রে জমিদারি পেতে পারত। এ ধরনের সনদ অবশ্য সরকার বরাবরই বাতিল বা বাজেয়াপ্ত করার অধিকারী ছিলেন। সনদ ছিল জমিদারের জন্য অলঙ্ঘনীয় কিছু অধিকার ও দায়িত্বাবলির এক ঘোষণাপত্র। জমিদার তার স্ব-মর্যাদায় বহাল থাকতেন তার সু আচরণের সুবাদে, কোনো অধিকারবলে নয়। ইচ্ছাকৃতভাবে বৈধ কর্তৃপক্ষের অবাধ্যতা কিংবা কোনো চক্রান্তে কিছু না ঘটলে, নিয়মিতভাবে রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে রাষ্ট্রের কাছে জমিদারের অধিকার আপনা-আপনি লুপ্ত হতো না। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত অন্যকোন কারণে রায়তগণ রাজস্ব পরিশোধে ব্যর্থ হলে যে কোনো জমিদার সরকারের কাছে ত্রাণ সহায়তা চাইতে পারতেন।

মুগল সরকারের স্বার্থে জমিদারগণ সহযোগিতা ও সেবা প্রদান করলেও, এ দু পক্ষের মধ্যে সহজাত সংঘাত অমীমাংসিতই থেকে যায়। আওরঙ্গজেবের (১৭০৭) মৃত্যুর পর মুগল কেন্দ্রীয় শক্তির অবক্ষয় দেখা দিলে রাজপ্রতিনিধিত্বের তথা মসনদের উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখা দেয়। একই সময়ে বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে কোম্পানির অভ্যুদয়ে নবাবের দরবারে বিভিন্ন পক্ষের কোন্দল-কলহের কারণে জমিদারদের ওপর নবাবের নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যায়। উদীয়মান অর্থলগ্নিকার তথা ব্যাংকিং শ্রেণি ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে যোগসাজশক্রমে বড় জমিদারগণ রাজনীতির মূলধারায় প্রবেশ করেন আর নবাবির জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগীর পক্ষাবলম্বন করেন। এভাবে দেশের আর্থ-রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় জমিদারদের ভূমিকা গভীর প্রভাব ফেলে। সরকারের নিষ্ক্রিয়তা, কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দুর্নীতির সম্মিলিত কারণে ১৭৬৫ সালে কোম্পানির কাছে দীউয়ানি (রাজস্ব কর্তৃপক্ষীয় ক্ষমতা) হস্তান্তর অবধি জমিদারদের ক্ষমতা বাড়তে থাকে।

উপনিবেশিক আমল মুগল আমলের জমিদারি প্রথায় ঔপনিবেশিক শাসনামলে নানা বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। জমিদাররা তাদের পুরানো অনেক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা হারান এবং একই সঙ্গে নতুন অনেক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করেন। পরিবর্তিত এ প্রথার রূপান্তর ১৯৫১ সালে জমিদারি ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক বিলোপের পূর্বপর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার দীউয়ানি লাভ ছিল জমিদারদের নতুন পদমর্যাদার প্রথম পদক্ষেপ। তবে ১৭৭২ সালে খাজনাদাতা জোতদাররা জমিদারদের স্থলাভিষিক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিদারি প্রথায় তেমন কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। নায়েব দেওয়ান সৈয়দ মোহাম্মদ রেজা খান কোম্পানির পক্ষে দীউয়ানি ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন মুগল রাজস্ব ব্যবস্থার প্রতি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল। তাই তার কার্যকালে জমিদাররা কোনো প্রকারে তাদের পদমর্যাদা রক্ষা করতে পেরেছিলেন, যদিও সে সময়টিতে জমিদারি ক্ষমতার অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছিল। আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা ছাড়াই জমিদাররা তাদের চিরাচরিত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা হারিয়ে নিছক খাজনা আদায়কারীতে পরিণত হয়েছিলেন।

ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথমে বাংলায় ফোর্ট উইলিয়ম এর গভর্নর (১৭৭২-১৭৭৪) ও পরে গভর্নর জেনারেল (১৭৭৪-১৭৮৫) নিযুক্ত হন। তিনি কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর নির্দেশে দীউয়ানি ব্যবস্থার দায়িত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন এবং নায়েব দেওয়ান রেজা খানকে অব্যাহতি দেন। ভূমি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় হেস্টিংস এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। শতাব্দী প্রাচীন কর ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে তিনি প্রতিষ্ঠিত জমিদার ও তালুকদারদের স্থলে সেইসব ইজারাদার বা খাজনাদাতা জোতদারদের নিয়োগ করেন, যারা সর্বোচ্চ খাজনা প্রদানের অঙ্গীকার করেন। সনাতন জমিদারদের জন্য এ পদক্ষেপ ছিল নিঃসন্দেহে একটি বড় আঘাত। কিন্তু তবুও তারা এ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ করেননি, কারণ তাদের জন্য সংগৃহীত রাজস্বের দশ শতাংশ হারে অনর্জিত মালিকানা ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে তাদের ক্ষোভ অনেকটা প্রশমিত হয়। মালিকানা ভাতা বরাদ্দ করার ফলে তারা আর্থিক দিক থেকে আদৌ কোনো ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে বরং লাভবান হন। কারণ খাজনা আদায়ের ঝামেলা ও অর্থ ব্যয় ছাড়াই তাদের উপার্জন রয়ে যায় কম-বেশি আগের মতোই।

জমিদারি প্রথায় প্রত্যাবর্তন   পাঁচসনা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত এক ধরনের ইজারা বন্দোবস্ত থেকেও প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যায় নি। খাজনাদাতা জোতদারদের অধিকাংশই ছিলেন বণিক শ্রেণির। ভূমি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে তাদের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। সরকারকে কর পরিশোধ করা এবং নিজেদের জন্য মুনাফা করার বেপরোয়া প্রয়াসে তারা সাধারণভাবে রায়তদের কাছ থেকে উচ্চ হারে জমির খাজনা আদায় করতেন। তাদের অনেকেরই ভূমির সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে কোনো সম্পর্ক ছিল না। উচ্চ হারে খাজনার চাপ এবং নিপীড়নের ফলে রায়তরা ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেত এবং নানা গোলযোগ সৃষ্টি করত। ফলে রাজস্ব আদায় হ্রাস পেতে থাকে এবং অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে।

কৃষি বন্দোবস্তের এমন ধ্বংসাত্মক পরিণতির পরিপ্রেক্ষিতে কোর্ট অব ডিরেক্টরস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসনা বন্দোবস্তের মেয়াদ শেষে পুরানো জমিদারি প্রথা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য কলকাতা প্রশাসনকে পরামর্শ দেয়। ১৭৭৭ সালে পাঁচসনা বন্দোবস্তের মেয়াদ শেষ হলে কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর পরামর্শ অনুযায়ী জমিদারদের সঙ্গে এক থেকে তিন বছর মেয়াদে রাজস্ব আদায় বিষয়ক বন্দোবস্ত করা হয়। ১৭৭৮-৭৯ সালে আবার জমিদারদের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদি রাজস্ব বন্দোবস্ত হয়। কিন্তু ১৭৬৫ সালে কোম্পানির দীউয়ানি লাভের সময় থেকে শ্রেণি হিসেবে জমিদার ও তালুকদারদের মধ্যে যে অবক্ষয় শুরু হয় তা ওই  শতকের সত্তরের দশকে আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ফলে ভূমির মালিকরা একটি দারিদ্র্যপীড়িত ও অজ্ঞ শ্রেণিতে পরিণত হন। নতুন পরিবেশ-পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা ব্যর্থ হন। জমিদাররা কৃষি বন্দোবস্ত আমলের অনর্জিত ভাতায় জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং জমিদারি প্রথায় প্রত্যাবর্তনের পর যখন তারা নিজেদের নামে জমির বন্দোবস্ত লাভ করেন তখন তাদের একই ইজারা ব্যবস্থার শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। সকল বড় বড় জমিদার তাদের জমিদারি এস্টেটকে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করে ইজারাদারদের কাছে ইজারা দিতেন। সে কারণে ১৭৭৮ সালের পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতপক্ষে অবস্থার কোনো উন্নতি ঘটে নি, অর্থনীতির অধোগতি রোধ করা সম্ভব হয় নি, কর সংগ্রহে নিশ্চয়তা ফিরে আসে নি।

'পিট্স ইন্ডিয়া অ্যাক্ট', ১৭৮৪  স্থায়ী ভিত্তিতে উপনিবেশিক রাজ্য গঠনের লক্ষ্যে এ আইনের অধীনে কলকাতা প্রশাসন অনেকগুলি বিধিবিধান প্রণয়ন করে। জমিদারদের সঙ্গে ভূমি বন্দোবস্তের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, এ লক্ষ্যে দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য শাসন এবং শাসক ও শাসিত উভয় শ্রেণির কল্যাণের উদ্দেশ্যে স্থায়ী বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়। নতুন রাজ্যকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করার নির্দেশ দিয়ে লর্ড কর্নওয়ালিসকে গভর্নর জেনারেল করে পাঠানো হয়। পিট্স ইন্ডিয়া অ্যাক্ট-এর অধীনে এবং কোর্ট অব ডিরেক্টরস-এর নির্দেশ অনুযায়ী লর্ড কর্নওয়ালিস ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথ পরিহার করে দেশের জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূম্যধিকারীদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা কার্যকর করেন।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত  কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ সালে জমিদারদের সঙ্গে  চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সম্পাদন করেন। এ বন্দোবস্তের অধীনে জমিদারদের পদমর্যাদা ও ভূমিকা বেশ ভিন্নরকম হয়ে ওঠে। জমিদার, তালুকদার প্রভৃতিসহ যারা ভূমির দখলিস্বত্ব ভোগ করছিলেন তাদের সকলকে ঐসব ভূমির মালিক ঘোষণা করা হয়। মালিক হিসেবে জমিদারদের ভবিষ্যতে কোনোরকম ব্যতিক্রম ছাড়াই সুনির্দিষ্ট হারে সরকারকে রাজস্ব পরিশোধ করতে হতো। অন্য যে কোনো সম্পত্তির মতোই জমিদারি সম্পত্তিও কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন গ্রহণ ছাড়াই হস্তান্তর করা বা বন্ধক দেওয়া যেত। জমিদারির অধিকার হিন্দু ও মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুসারে উত্তরাধিকারীদের প্রাপ্য হতো। জমিদাররা সম্পত্তির এ মালিকানা লাভ করেন সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে জমিদারদের নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মিত রাজস্ব পরিশোধ করতে হতো। অন্যথায় তাদের জমিদারি সম্পত্তি প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করা হতো। স্থানীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি হিসেবে জমিদাররা যেসব রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা ঐতিহ্যগতভাবে ভোগ করে আসছিলেন সেগুলি তাদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আদালত কর্তৃক সনাতন জমিদারি নিষিদ্ধ করা হয়। জমিদারদের ‘সায়ের’ আদায়ের অধিকার বিলোপ করা হয় এবং সকল সায়ের মহাল (হাট, বাজার,গঞ্জ, নগরশুল্ক, মৎস্যখামার) পুনঃগ্রহণ করে জেলা কালেক্টরের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে নেওয়া হয়। আইনের দৃষ্টিতে জমিদার ও রায়তদের মধ্যে সমতা বিধান করা হয়।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রতি জমিদাররা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কিন্তু তারা এ বন্দোবস্ত মেনে নিয়েছিলেন কারণ তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। তাদেরকে বলা হয় যে, হয় তাদের বন্দোবস্ত মেনে নিতে হবে, নয় একটি বার্ষিক বৃত্তির বিনিময়ে জমিদারি স্বত্ব ছেড়ে দিতে হবে। অধিকাংশ জমিদার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বটিকা গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করেন, কারণ তারা ভীতির সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, যারা এ নতুন ব্যবস্থাকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছেন তাদের নির্মমভাবে দমন করা হয়েছে।

সূর্যাস্ত আইন  জমিদারদের জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধিবিধানগুলির মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক দিক ছিল রাজস্ব বিক্রয় আইন, যাকে তারা মোলায়েম ভাষায় বলতেন সূর্যাস্ত আইন। এ আইনের শর্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বারোটি কিস্তিতে জেলা কালেক্টরেটে পরিশোধ করতে হতো। কোনো জমিদারের প্রদেয় কিস্তি বকেয়া পড়লে পরবর্তী মাসে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর ওই  জমিদারের জমি থেকে বকেয়া কিস্তির সমমূল্যের জমি বিক্রয় করে সে টাকা উসুল করতেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার একেবারে শুরু থেকে রাজস্ব বিক্রয় আইনের (সাধারণ্যে সূর্যাস্ত আইন নামে পরিচিত) অধীনে শত শত জমিদারি সম্পত্তি বিক্রয় হয়ে যায়। সেকালের লোকেরা এ আইনকে সূর্যাস্ত আইন বলত এ অর্থে যে, এর ফলে একটি শাসক পরিবারে অন্ধকার নেমে আসত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার দশ বছরের মধ্যে বাংলার জমিদারি সম্পত্তির প্রায় অর্ধেকের মালিকানা বদল হয়।

নবাগত জমিদার  খোদ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কার্যপদ্ধতির মধ্যে পুরানো জমিদারদের স্থলে এক নতুন জমিদার শ্রেণির উদ্ভবের সুযোগ নিহিত ছিল। এ ব্যবস্থার প্রণেতারা সচেতন ছিলেন যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যকর হওয়ার পর ভূমির একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার সৃষ্টি হবে এবং তার ফলে দুর্বল ও অদক্ষ জমিদাররা ভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবেন, ভূমির মালিকানার ক্ষেত্রে নতুন রক্তের সঞ্চালন ঘটবে। আগেই ধারণা করা হয়েছিল যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে ভূমিনিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডে টাকাওয়ালা ও উদ্যমী এক শ্রেণির লোকের প্রবেশ ঘটবে, যারা কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনে পালন করবে সহায়ক ভূমিকা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে ভূমি ব্যবস্থাপনায় নয়া জমিদার ও পুরানো জমিদারদের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য ছিল না। নয়া জমিদারদের অধিকাংশেরই আগমন ঘটে জমিদারদের চাকুরে, সরকারি চাকুরে এবং বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণির মধ্য থেকে। সনাতন জমিদারদের মধ্যে দেখা যেত প্রণোদনার অভাব এবং আলস্য, আর ভূমি নিয়ন্ত্রণে নবাগতরা কৃষি খাতের উন্নয়নকল্পে কোনো পুঁজি বিনিয়োগ না করে নিজেদের আয় বাড়ানোর চেষ্টা করতেন বর্গাচাষিদের ওপর উচ্চ হারে খাজনা আরোপের মধ্য দিয়ে।

জমিদার ও রায়ত  ঊনিশ শতকের প্রথম ভাগে জমিদার ও রায়তদের মধ্যকার সম্পর্কের ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। জমিদাররা চলতি খাজনা বৃদ্ধি করতে থাকে এবং মূলত এ কারণেই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চাপ এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মামলা-মোকদ্দমা, পারিবারিক কলহ, পূর্বপুরুষের ভূসম্পত্তি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগাভাগি ইত্যাদি কারণে জমিদারির আয় হ্রাস পেতে থাকে। এর ফলে জমিদারদের মধ্যে রায়তের খাজনার হার বৃদ্ধি করার প্রবণতা দেখা দেয়। কিন্তু রায়তরা এ ধরনের প্রয়াসের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তারা দাবি করে যে, পরগনা নিরিখ বা খাজনার প্রচলিত হার পরিবর্তন করার অধিকার জমিদারদের নেই। কিন্তু জমিদাররা রায়তদের এ ধরনের দাবি খন্ডন করে যুক্তি দেখান যে, যেহেতু তারা তাদের ভূমির নিরঙ্কুশ মালিক তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং জমির দামের পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে জমির খাজনার হার পুনর্নির্ধারণ করার অধিকার তাদের রয়েছে। এ বিরোধের পরিণামস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এ বিক্ষোভ থেকে ওই শতকের আশির দশকে জমিদার বিরোধী কয়েকটি বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এগুলি ছিল তুষখালি কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫), পাবনা কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩) ছাগলনাইয়া কৃষক বিদ্রোহ (ফেনী) ও মুন্সীগঞ্জ কৃষক বিদ্রোহ (১৮৮০-৮১)।

জমিদারি ক্ষমতার অবক্ষয়  কর্নওয়ালিস কোড-এ অস্পষ্টভাবে কৃষকদের প্রথানুগ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কখনওই সেগুলি সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয় নি। দেশ জুড়ে ব্যাপক কৃষক অসন্তোষের ফলে ঔপনিবেশিক সরকার সমগ্র পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে এবং পল্লী অঞ্চলে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ভূমিনিয়ন্ত্রণ কর্মকান্ডে একটি মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির উদ্ভব ছিল আরও একটি সমস্যা। অধিকাংশ জমিদার, বিশেষ করে পূর্ববাংলার জেলাগুলিতে মধ্যস্বত্ব নামে স্থায়ী এক ধরনের মধ্যবর্তী দখলিস্বত্ব কায়েম করেন, যার ফলে রায়তদের সঙ্গে জমিদারদের দূরত্ব অনেক বেড়ে যায়। জমিদার ও রায়তদের মাঝামাঝি পর্যায়ক্রমে কয়েকটি স্তরের মধ্যস্বত্বভোগী ছিল যাদের প্রত্যেকেই একই রায়তের একই জমি থেকে খাজনা আদায় করত। খাজনারাপে অতিষ্ট রায়তরা এমন পরিস্থিতিতে হয় ভিটেমাটি ছেড়ে পালাত, নয় সংঘবদ্ধ প্রতিরোধের পথ বেছে নিত। সংঘটিত সকল কৃষক আন্দোলন (ঔপনিবেশিক যুগ) থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ভূমির ওপর নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা ছিল। তারা জমির ওপর তাদের অধিকারের কথা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করত, যা জমিদাররা মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাত এবং এ নিয়ে আদালতগুলি পরস্পরবিরোধী রায় দিত।

বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন, ১৮৮৫  কৃষির পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দানের উদ্দেশ্যে ১৮৮০ সালে একটি রেন্ট কমিশন গঠন করা হয়। রেন্ট কমিশনের রিপোর্টের (১৮৮৩) ওপর ভিত্তি করে বঙ্গীয় বিধান সভা বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন (১৮৮৫) নামে একটি আইন পাস করে। এ আইনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা এবং তার ফলে উদ্ভূত কৃষি পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনা করা হয়। সকল স্তরের রায়ত, মধ্যস্বত্বভোগী এবং জমিদারসহ ভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল মহলের অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস নেওয়া হয়। এ আইনের অধীনে ভূমির সঙ্গে জড়িত ঊর্ধ্বতন মহলের ইচ্ছামাফিক খাজনার হার বাড়ানোর অধিকার ব্যাপকভাবে খর্ব করা হয়। এ আইনে জমির মালিককে নামজারি সেলামি নামে এক ধরনের রেজিস্ট্রেশন মাশুল প্রদান সাপেক্ষে বড় রায়তদের নিজ দখলিস্বত্ব হস্তান্তরের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সকল মধ্যস্বত্বভোগীর অধিকারও স্বীকৃতি লাভ করে। কোনো কারণ না দেখিয়ে খাজনা বৃদ্ধি করার অধিকার জমিদাররা হারান। এ আইনের অধীনে তারা কেবল তখনই খাজনার হার বাড়াতে পারতেন যখন তারা প্রমাণ করতে পারতেন যে ভূমির উন্নয়নে তারা পুঁজি বিনিয়োগ করেছেন এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ইত্যাদি। এইসকল বিধি-নিষেধের উদ্দেশ্য ছিল জমিদারি ক্ষমতার গুরুতর সংকোচন ঘটানো। ধনী কৃষক ও দখলি স্বত্বভোগীদের ভোগদখলের বিশেষ মেয়াদের আইনগত স্বীকৃতি লাভের ফলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিধি-বিধানের আওতায় জমিদারদের প্রদত্ত পদমর্যাদা নাকচ হয়ে যায়।

জমিদারি প্রথার বিলোপ  বিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, বিক্ষোভের রাজনীতি, প্রথম মুসলিম নির্বাচকমন্ডলী, বিভাজনপন্থি রাজনীতি, কম্যুনিস্ট ভাবধারার অনুপ্রবেশ প্রভৃতি ঘটনা দ্বারা ব্রিটিশ রাজের অনুগত ও রাজনৈতিকভাবে মধ্যপন্থি জমিদার শ্রেণির সামাজিক কর্তৃত্ব গুরুতরভাবে হ্রাস পায়। কৃষক রাজনীতি ছিল সম্পূর্ণরূপে জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অধিকাংশ জমিদার হিন্দু ছিলেন বলে পল্লী অঞ্চলের জনসংখ্যার সিংহভাগ মুসলমান কৃষকসমাজ ছিল প্রবলভাবে জমিদারদের বিরোধী। জমিদার ও রায়ত সম্পর্কের গভীর পরিবর্তন ঘটে, ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় সকল রাজনৈতিক দল অঙ্গীকার করে যে, তারা নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় গেলে জমিদারি প্রথা বিলোপ করা হবে। সে অনুসারে মুসলিম লীগকৃষক প্রজা পার্টি এর কোয়ালিশন সরকার জমিদারি প্রথা সম্পর্কে রিপোর্ট দানের জন্য একটি কমিশন গঠন করে। ফ্লাউড কমিশন নামে পরিচিত সে কমিশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের সুপারিশ করে। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি, সাম্প্রদায়িক বিরোধ এবং দেশ বিভাগের রাজনীতির ডামাডোলে সরকার ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন থেকে বিরত থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট-এর অধীনে জমিদারি প্রথার বিলোপ ঘটে।  [সিরাজুল ইসলাম ও শিরীন আখতার]