জনশুমারি

জনশুমারি (Census) আধুনিক অর্থে জনশুমারিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায়িত অঞ্চলের জনসংখ্যা সম্পর্কে জনমিকি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথ্য সংগ্রহ, সংকলন এবং প্রকাশ করার প্রক্রিয়া হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। এটি একটি নির্ভরযোগ্য ও বিস্তৃত তথ্যের এক অনন্য উৎস এবং এটিকে একটি দেশের তথ্য সংগ্রহের সবচেয়ে বড় একক হিসেবে বিবেচনা করা যায়।

১৮৭২ সালে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান উপমহাদেশের অন্যান্য অংশের সাথে বাংলায় প্রথম জনশুমারি হয়। তবে এ প্রচেষ্টা তার লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। জনগণের মধ্যে জনসংখ্যার গণনা সম্পর্কে সন্দেহ ছিল, তাই জনগণ গণনাকারীদের সাথে কোনো সহযোগিতা করেনি। এই কারণে দ্বিতীয় জনশুমারি নেওয়া হয়েছিল ১৮৮১ সালে। ১৮৯১ সালে তৃতীয় জনশুমারি খুব ভালো হয়েছিল, যদিও এর আগের সমস্যাগুলো পুরোপুরি দূর করা যায়নি। জনতত্ববিদদের মতে বিংশ শতাব্দীর প্রথম তিন দশকের (অর্থাৎ ১৯০১, ১৯১১ ও ১৯২১ সালের) শুমারিগুলো মোটামুটি নির্ভরযোগ্য ছিল।

শুমারি তথ্য জালিয়াতির কারণে ১৯৩১ এবং ১৯৪১ সালের জনশুমারি বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। ঐ সময়ে হিন্দু ও মুসলমানরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের পক্ষে মিথ্যা রিটার্ন জমা দেয়ার প্রবণতা দেখিয়েছিল। ১৯৫১ সালের শুমারি, পূর্ববঙ্গ (পূর্ব পাকিস্তান) এর প্রথম জনশুমারি, বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় পড়েছিল। ১৯৬১ সালের জনশুমারিটি ১৯০১ সাল থেকে গৃহীত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গণনা হিসেবে গণ্য করা হয়।

১৮৮১ সালের শুমারি অনুসারে বর্তমানে বাংলাদেশ গঠিত অঞ্চলে প্রতি দশ বছর অন্তর ‘১’ দিয়ে শেষ হওয়া বছরগুলোতে ১৯৬১ সাল থেকে পরবর্তী জনশুমারিগুলো হয়ে আসছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কারণে ১৯৭৪ সালে দেশটির প্রথম জনশুমারি অনুষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৮১ সালের জনশুমারিটি বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে ছিল দ্বিতীয় শুমারি। বাংলাদেশের তৃতীয় দশক শুমারি ১৯৯১ সালে ১২ মার্চ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ, ১৯৯১ এর মধ্যরাত্রিকে শুমারি মূহুর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যখন ১২ থেকে ১৫ মার্চকে শুমারি কাল হিসেবে গণ্য করা হয়।

বাংলাদেশের চতুর্থ জনশুমারি ২০০১ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতি দশকের শুরুতে জনশুমারি পরিচালনার প্রথা অনুসরণ করে বাংলাদেশের পঞ্চম জনশুমারি ২০১১ সালের ১৫ থেকে ১৯ মার্চের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়।

জনসংখ্যার আকার ও বৃদ্ধির প্রভাবিত হার ১৯০১-২০১১ ১৯০১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৯ মিলিয়ন, যা ১৯৩১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৩৬ মিলিয়নে, ৩০ বছরে প্রায় ২৪% বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রায় ৪৩% বৃদ্ধি পায়। মাত্র ২০ বছর (১৯৬১-১৯৮১) সময়ের মধ্যে, ২৬ মিলিয়নের বেশি লোক যা ৭১% বৃদ্ধির মাধ্যমে এ সংক্ষিপ্ত সময়ে যুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে জনসংখ্যা দাড়ায় ১১১.৫ মিলিয়ন। ২০০১ সালের জনশুমারি অনুসারে ১৩০.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যা রেকর্ড করা হয়।

১৯৮১ সাল থেকে ২০ বছরে ৩৯ মিলিয়ন লোকের সংযোজন হয়েছে। পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৮১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬৭ শতাংশ- ৮৯.৯ মিলিয়ন থেকে ১৪৯.৮ মিলিয়ন। ২০০১-২০১১ সালে বৃদ্ধির হার অব্যাহত ছিল ধরে নিলে ২০২১ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ মিলিয়নে।

১৯১১ সালে মোট জনসংখ্যার ২.৬% ছিল শহরের জনসংখ্যার অংশ যা বেড়ে ১৯৬১ সালে দাড়ায় ৫.২%। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের আদমশুমারির গণনায় শহরের জনসংখ্যা ছিল ৬.২৭ মিলিয়ন। এটা বেড়ে ১৯৯১ ও ২০০১ সালে দাঁড়ায় যথাক্রমে ২০.৮৬ ও ২৯.২৫ মিলিয়ন। ১৯৯১-২০০১ সালে শহর এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৩৪ শতাংশ এবং ২০০১-২০১১ তে তা কমে ১.৩৭ শতাংশে নেমে আসে।

জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৯১১ সালের জনশুমারিতে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১৪ জন ছিল যা ২০০১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৭৬ জন। ১০০ বছরের মধ্যে এই ঘনত্ব প্রায় ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

লিঙ্গ অনুপাত ১৯০১ সালে লিঙ্গ অনুপাত ১০৪.৫ ছিল, যা ১৯৫১ সাল পর্যন্ত ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়ে ১০৯.৭ এ পৌঁছেছে, ৫০ বছরে এই বৃদ্ধি প্রায় ৫ শতাংশ। পরবর্তীতে এটি কমতে শুরু করে এবং ২০১১ সালে ১০০.৩ এ নেমে আসে এবং দেখা যায় এটি ৬০ বছরে প্রায় ৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।

নির্ভরতার অনুপাত নির্ভরতার অনুপাত হল একটি গুরুত্বপূর্ণ জনমিতিক সূচক যা কার্যক্ষম বয়সের জনসংখ্যার সঙ্গে তাদের উপর নির্ভরশীল জনসংখ্যার অনুপাত। জনশুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছরের কম এবং ৬০ বছর বা তার বেশি বয়সীরাই হলেন নির্ভরশীল জনসংখ্যা। এই অনুপাতগুলো নির্ণয় করা হয়েছে ১৯১১-২০১১ সময়কালের ১১টি জনশুমারির বয়স বিন্যাস থেকে যা ১৯১১ সালে ৮৮ শতাংশ থেকে ২০১১ সালে ৭৩ শতাংশে পরিবর্তন হয়।

বিবাহের গড় বয়স জনশুমারির তথ্য থেকে আমরা বিবাহের গড় বয়স নির্ণয় করতে পারি না, তবে এটি পরোক্ষভাবে নির্ণয় করা সম্ভব। এই গড়কে সিঙ্গুলেট বিবাহের গড় বয়স (এস.এম.এ.এম) বলা হয়ে থাকে। এটি পুরুষ বা মহিলাদের অবিবাহিত অনুপাত থেকে নির্ণয় করা হয়। মেয়েদের সিঙ্গুলেট বিবাহের গড় বয়স ১৯৩১ সালে খুব কম ছিল, মাত্র ১২.৬ বছর। ১৯৩১ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে বিবাহের গড় বয়স ৩.৩ বেড়েছে। ১৯৭৪ সাল থেকে মহিলাদের সিঙ্গুলেট বিবাহের গড় বয়স ১৫ বছর থেকে বেড়ে ১৯.৬ বছর হয়েছে ২০১১ সালে।

ধর্মীয় মিশ্রণ বাংলাদেশ মূলত একটি মুসলমান অধ্যুষিত দেশ যেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। বাকি ১০ শতাংশ অন্যান্য ধর্মের বিশ্বাসী যাদের মধ্যে রয়েছে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধধর্মের। গত ২০ বছরে ধর্ম ভিত্তিক জনসংখ্যার সামান্য পরিবর্তন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৯১ সালে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৮৭ শতাংশ যা ২০১১ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৯ শতাংশে।

শিক্ষার হার ৭ বছরও তদুর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার হল ঐ সময়কালীন শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যার সঙ্গে একই বয়সের মোট জনসংখ্যার অনুপাত যা শতাংশে প্রকাশ করা হয়। জনশুমারির প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে এই হার ছিল ২৬.৮ শতাংশ, ২০১১ সালে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১.৮ শতাংশে, ৩৭ বছরে এটি ৯৩ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই হার মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল : ২ গুণের বিপরীতে ৩ গুণ। ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব জনসংখ্যার শিক্ষার হার হলো ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সের শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যার সঙ্গে একইভাবে নির্ণিত ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সের জনসংখ্যার শিক্ষার হার পরপর ৩টি জনশুমারি অর্থাৎ ১৯১১, ২০০১ এবং ২০১১ সালের প্রাপ্ততথ্য থেকে সহজে পাওয়া যাবে। এই হার ১৯৯১ সালে ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১ সালে ৫৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে, মহিলাদের মধ্যে এই হারটি বেশি দেখা যায়। [এম. আতাহারুল ইসলাম]

তথ্যসূত্র বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০১৫), জনসংখ্যা ও আবাসন ব্যবস্থা শুমারি ২০১১, জাতীয় রিপোর্ট, ১ম খণ্ড; বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (২০১৮), বাংলাদেশের বাৎসরিক পরিসংখ্যান রিপোর্ট, ২০১৮।