চৌধুরী, ঝর্ণা ধারা

ঝর্ণা ধারা চৌধুরী

চৌধুরী, ঝর্ণা ধারা (১৯৩৮-২০১৯) বাংলাদেশের একজন গান্ধীবাদী সমাজকর্মী এবং নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার জয়াগে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’-এর সচিব। তিনি ১৯৩৮ সালের ১৫ই অক্টোবর লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার চ-িপুর ইউনিয়নের কালুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম প্রমথ চৌধুরী ও মাতার নাম আশালতা চৌধুরী। তিনি এগার ভাইবোনের মধ্যে দশম। ঝর্ণা ধারা চৌধুরী চট্টগ্রামের খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ধর্মে অনুপ্রাণিত হয়ে শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রচারে তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেন।

১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর মুসলিম-হিন্দুু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয় ঝর্ণা ধারা চৌধুরীর পরিবার। তাঁদের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং অনেক নিকট আত্মীয়কে হত্যা করা হয়। তিনি নিজ চোখে দেখেন নিরীহ মানুষকে আগুনে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের বীভৎস ঘটনা। তখন তাঁর পরিবার ভারতের আসামে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যদিও সহিংসতা কমে যাওয়ার পর তাঁরা গ্রামে ফিরে আসেন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁর শিশু মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। দাঙ্গার বর্বরতা মহাত্মা গান্ধীকেও হতবাক করে। তিনি এই অঞ্চলে ছুটে আসেন এবং প্রায় চার মাস ধরে খালি পায়ে গ্রামের চারপাশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং অহিংসার আদর্শ প্রচার করেন। ঝর্ণা ধারা চৌধুরী শিশু বয়সেই মহাত্মা গান্ধীর অহিংসা, আত্মনির্ভরশীলতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নীতি দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মহাত্মা গান্ধীর সাথে তাঁন কখনো দেখা হয়নি, তবে তিনি মহাত্মা গান্ধীর দর্শন ও অধ্যবসায়কে অনুসরণ করে এবং গান্ধীবাদী বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্য রেখে তাঁর জীবন অতিবাহিত করেন।

তিনি দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের দুঃখ-কষ্ট নিজ চোখে দেখেন। তিনি লক্ষ্য করেন, অশিক্ষার কারণে সমাজের নারীরা চরমভাবে অবহেলিত ও নিগ্রহের শিকার হয়। এই উপলদ্ধি থেকেই ১৯৫৪ সালে নারীদের শিক্ষার জন্য মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি এবং তাঁর বড় বোন কবিতা দত্ত ‘কল্যাণী শিক্ষায়তন’ নামে একটি স্কুল শুরু করেন। তাঁরা দুই বোন সপ্তাহে দু’দিন উপোস করে অর্থ বাঁচিয়ে শিশুদের জন্য বই ও অন্যান্য সামগ্রী ক্রয় করতেন। কিন্তু নারীশিক্ষা বিরোধীতাকারীদের চক্রান্তের কারণে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৫৪ সালে তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর ১৯৫৬ সালে গান্ধীর প্রতিষ্ঠিত অম্বিকা কালিগঙ্গা চ্যারিটেবল ট্রাস্ট (যা বর্তমানে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’ নামে পরিচিত)-এ যোগ দেন। সমাজসেবার পাশাপাশি তিনি তাঁর পড়ালেখাও চালিয়ে যান।

১৯৬০ সালে ঝর্ণা ধারা চৌধুরী নিজ বাড়ি ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় বিক্রমপুর জেলার বাউতভোগ গ্রামে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সর্বশ্রী সুনীল বসু ও চারু চৌধুরীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘অম্বর চরকা’ প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং সুতাকাটা, মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৬০ সালে তিনি চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক সাইক্লোনে আহত নিঃস্ব গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবর্তক সংঘ’-র স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দীর্ঘদিন এই অসহায় মানুষের জন্য সেবা ও ত্রাণকাজ চালান। এরপর তিনি ‘প্রবর্তক সংঘ’-এর বিদ্যাপীঠের চরকা ও মৌমাছি পালন কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষক পদে যোগ দেন। প্রবর্তক সংঘ-এর শিশু সদনের শিশুদের দেখাশোনা করা, ছাত্রদের পড়ানো এবং শিশুদের কল্যাণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। এভাবেই সংঘের শিক্ষিকা এবং অনাথালয়ের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে তিনি সরাসরি মানবসেবায় নিয়োজিত হন।

পাকিস্তান আমলে প্রায় সকল গান্ধীবাদী জেলে ছিলেন। সে সময় ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ছাড়া তাদের দেখাশোনার জন্য কেউ ছিল না। ঐ গান্ধীবাদীদের জন্য তিনি নিয়মিত বিভিন্ন কারাগারে যেতেন। তখন একজন তরুণীর একার পক্ষে এতো কাজ করা খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু তিনি সানন্দে এ দায়িত্ব পালন করে চলেন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘প্রবর্তক সংঘ’ ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। ঝর্ণা ধারা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন। নিজেকে তৈরি করেন সেবিকা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবর্তক সংঘের সেক্রেটারিসহ সকল সংগঠক (যাঁরা মাস্টারদা সূর্য সেনের অনুসারী ছিলেন)-কে পাকহানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। সে সময় ঝর্ণা ধারা চৌধুরী জীবনের প্রচ- ঝুঁকি ও প্রবল সাহসের সাথে প্রবর্তক সংঘের প্রায় ৫০০ শিশু ও কিশোরীকে ক্যাথলিক মিশনের সহায়তায় পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচিয়ে ভারতে নিয়ে যান। সেখানে তিনি বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করার জন্য ত্রিপুরার সুরিয়া মণি নগরে একটি বিশেষ ত্রাণ শিবিরে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি বিধ্বস্ত প্রবর্তক সংঘ, প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ এবং প্রবর্তক শিশু সদন পুনর্গঠনে নিরলসভাবে কাজ করেন।

১৯৭৯ সালে পুনরায় ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’-এ ফিরে আসেন। তিনি নারী উন্নয়ন, হস্তশিল্প প্রশিক্ষণ ও প্রচার, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ, কৃষিকর্ম, পশুসম্পদ ও হাঁস-মুরগি পালন, আবাসন, পানি ও স্যানিটেশন, দরিদ্রদের জন্য আয়-উপার্জন বৃদ্ধি, শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রচার করতে, দলিতদের জীবনমান উন্নয়ন এবং সর্বোপরি, মানব উন্নয়নে স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা করতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা- গ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালের ১৩ই জুন চারু চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করে জনকল্যাণমুখী এই প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। ১৯৯৫ সালে বেইজিং-এ চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশে ফিরে তিনি নতুন উদ্যমে গান্ধী আশ্রমে কুটির শিল্প স্থাপন করে তার বিকাশ ও প্রসারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেন। নীরবে নি:স্বার্থভাবে কাজ করা এই মানবদরদী নিজের অজান্তেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির পর্যায়ে ‘গান্ধী আশ্রম ট্রাস্ট’-কে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি কুমিল্লা জেলার ‘অভয় আশ্রম’ এবং ফেনী জেলার ‘খাদি প্রতিষ্ঠান’-কে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেন।

গান্ধীবাদী ঝর্ণা ধারা চৌধুরী সমাজকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ দেশে-বিদেশে নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। যেমন- আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরস্কার (১৯৯৮); আমেরিকার নিউইউয়র্কের ওল্ড ওয়েস্টবেরি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক শান্তি পুরস্কার (২০০০); নারী উদ্যোক্তার স্বীকৃতি স্বরূপ অনন্যা পুরস্কার (২০০২); সমাজসেবার জন্য নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক (২০০৩); শান্তি, সম্প্রীতি ও অহিংসা প্রসারে ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ বিভাগ কর্তৃক শান্তি পুরস্কার (২০০৬); নোয়াখালী জেলা প্রশাসন কর্তৃক সাদা মনের মানুষ (২০০৭); শ্রীচৈতন্য পদক (২০১০); চ্যানেল আই এবং স্কয়ার কর্তৃক কীর্তিমতী নারী পুরস্কার (২০১০); হরিয়ানা কর্তৃক রণবীর সিং গান্ধী স্মৃতি শান্তি সদ্ ভাবনা পুরস্কার (২০১১); ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কার (২০১৩); বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পদক (২০১৩); একুশে পদক (২০১৫); এবং ডেইলি স্টার কর্তৃক সম্মাননা (২০১৬) পদক উল্লেখযোগ্য।

ঝর্ণা ধারা চৌধুরী ব্যক্তিগত জীবনে অবিবাহিত ছিলেন। মানবসেবায় নিজেকে ব্রহ্মচারিণী রূপে উৎসর্গ করেন। ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে থেকে একজন মানুষ মানবতার প্রতি কতটুকু সংবেদনশীল হতে পারেন, তা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর কর্ম দিয়ে। সাধারণ মানুষ থেকে সহকর্মী সবার প্রিয় ‘দিদি’ হিসাবেই আমৃত্যু কাজ করেন। তিনি ২০১৯ সালের ২৭শে জুন রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পরও তাঁর দেহখানি মানবকল্যাণের জন্য সন্ধানীকে দান করে যান। সমাজসেবা ও জনকল্যাণে আত্মনিবেদিতা পরম শ্রদ্ধেয়া মহীয়সী ঝর্ণা ধারা চৌধুরী মানবসেবার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। [আশরাফুন নাহার মালা]