চৌধুরী, আবু ওসমান

চৌধুরী, আবু ওসমান (১৯৩৬-২০২০) অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৮নং সেক্টরের কমান্ডার। আবু ওসমান চৌধুরী ১৯৩৬ সালের ১লা জানুয়ারি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে এক স¤্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল আজিজ চৌধুরী এবং মাতার নাম মাজেদা খাতুন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষালাভ নিজ গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫১ সালে তিনি স্থানীয় চান্দ্রা ইমাম আলী হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিকুলেশন, ১৯৫৪ সালে চাঁদপুর কলেজ থেকে বিজ্ঞান শাখায় ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৫৭ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন।

আবু ওসমান চৌধুরী

১৯৫৮ সালে পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে যোগদান ও কমিশন প্রাপ্তির মাধ্যমে তাঁর সৈনিক জীবন শুরু। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ-এর সময় তিনি মেজর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী তিনি লে. কর্ণেল পদে উন্নীত হন। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নির্মম হত্যার পর জেনারেল জিয়ার শাসন আমলে তাঁকে সেনা বাহিনীর চাকরি থেকে আগাম অবসরে পাঠান হয়।

আবু ওসমান চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত থাকা অবস্থায় বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈসম্যমূলক আচরণ তাঁর মনে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা কর্মসূচি (১৯৬৬) পেশসহ তাঁর নেতৃত্বে বাঙালির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রতি তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে আসছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ মুক্তিযুদ্ধে যোগদানে তাঁকে দারুনভাবে উদ্বুব্দ করে। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ইয়াহিয়া সামরিক জান্তার লেলিয়ে দেয়া পাকিস্তানি সেনাদের নিরস্ত্র বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়া এবং ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি কমান্ডোদের হাতে গ্রেপ্তার বরণ করারর পূর্বক্ষণে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি ‘স্বাধীনতা ঘোষণা’ এমনই পরিস্থিতিতে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তখন তিনি ইপিআর (বর্তমান বিজিবি)-র চুয়াডাঙ্গা ৪নং উইং-এর কমান্ডার ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজিত ও তাদের অনেক সৈন্য নিহত হয়। মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া, ঝিনাইদাহ, চুয়াডাঙ্গাসহ বিস্তির্ণ এলাকা তিনি হানাদার মুক্ত রাখতে সক্ষম হন। যুদ্ধের প্রথম দিকে পদ্মার দক্ষিণ-পশ্চিম বৃহত্তর অঞ্চলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মে মাসের শেষের দিকে ঐ অঞ্চলকে ৮ ও ৯ নম্বর এ দুটো সেক্টরে বিভক্ত করা হলে, আবু ওসমান চৌধরিূ কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও ফরিদপুরের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ৮নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। ‘মুজিবনগর সরকার’ কর্তৃক আগস্ট মাসের মধ্যবর্তি সময়ে মেজর মঞ্জুর-কে ৮নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে প্রধান সেনাপতি কর্ণেল [পরবর্তীতে জেনারেল] এম এ জি ওসমানীর সদর দপ্তরে নিয়োজিত করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদান সত্ত্বেও, আবু ওসমান চৌধুরীকে কোনো সামরিক পদক দেয়া হয় নি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ‘উর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের হুকুম না মেনে শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা। তবে, ২০১৪ সালে তাঁকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘স্বাধীনতা পদকে’ ভূষিত করা হয়। আবু ওসমান চৌধুরীর জীবনে একটি বড় ট্রাজেটি হলো, ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানে তাঁর স্ত্রী বেগম নাজিয়া ওসমানের করুন মৃত্যু। বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ওসমান চৌধুরী ২০২০ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর ৮৪ বছর বয়সে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। বনানীর সেনা বাহিনীর কবরস্থানে তাঁর মৃতদেহ সমাহিত করা হয়।

ওসমান দম্পতির ২ কন্যা সন্তান রয়েছে। আবু ওসমান চৌধুরী ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি মূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র লে. কর্ণেল আবু ওসমান চৌধুরী, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম (চারুলিপি ২০১০); হারুন-অর-রশিদ (সম্পা.), বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ, ১ম খণ্ড, (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি ২০২০)।