গ্রামীণ ঋণিতা

গ্রামীণ ঋণিতা  একটি সমস্যা হিসেবে সর্বদাই বাংলার ইতিহাসের বিরাজমান ছিল। বিশ শতকের শুরুতে, বিশেষ করে ১৯২০এর দশক থেকে থেকে এ সমস্যা উদ্বেগজনক উয়ে উঠে। বাংলার প্রকৃতিনির্ভর অনিশ্চিত কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে গ্রামীণ ঋণিতা একটি সাধারণ বিষয়। মৌসুমী বৃষ্টির ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীলতার দরুণ বাংলার কৃষিব্যবস্থা সবসময়ই অনিশ্চিত ছিল। কোন কারণে উৎপাদন না হলে বা প্রাকৃতিক কারণে ফসল নষ্ট হলে কৃষককে ঋণ নিতে হতো ও সে ঋণ পরিশোধের জন্য পরবর্তী ফসলের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। যদি সে ফসলও কোন কারণে  ব্যর্থ হতো, তবে কৃষক পরিবারে অনিবার্হ দুর্ভোগ নেমে আসত। তারা মহাজনের কাছ থেকে পুনরায় ঋণ প্রাপ্তির যোগ্যতাও হারাত। দৈবাৎ চড়া সুদে ঋণ মিললেও স্বাভাবিকভাবেই কৃষক সে ঋণ মহাজনকে নিয়মিতভাবে পরিশোধ করতে পারত না। এর মধ্যে যদি আরো একটি ফসল নষ্ট হতো তাহলে কৃষি অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তো।

প্রাচীন ও মধ্যযুগের শাসকগণ ফসলহানি, মন্দা ও দুর্ভিক্ষের সময় কৃষকদের সাহায্য ও সহায়তা করার জন্য এগিয়ে আসতেন, এমন প্রমাণ রয়েছে। রেকর্ড আছে যে, মুগল আমলে সরকার কর্তৃক তাকাভি বা কৃষিঋণ দেয়ার রেওয়াজ ছিল। এ ছাড়াও, বাংলার ইতিহাসের সকল পর্বেই গ্রামীণ সম্প্রদায়ের মাধ্যমে অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধাও সহজলভ্য করা হয়েছিল। মহাজন বা বানিয়া অতি প্রাচীন ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ঋণগ্রহণ ও সুদেরহার সম্পর্কিত বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। মৌসুমী বৃষ্টি নির্ভর কৃষি অর্থনীতিতে ঋণিতা তাই একটি স্বাভাবিক বিষয় ছিল। ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা উভয়ই এ সমস্যাটিতে অভ্যস্ত ছিল। কৃষক সমাজ ও সরকার ঋণগ্রহীতাদের একান্ত প্রয়োজন বিবেচনা করে সামাজিক সহায়তার মাধ্যমে রায়তদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই ঋণ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চেষ্টা করা হতো। কৃষি ঋণ সমস্যার কারণে কৃষকের অর্থনৈতিক ভিত্তি ভেঙে পড়তো অনেক সময়। ফলে, ফসলহানী হলেও আধুনিক যুগপূর্ব কৃষক সমাজ গ্রামীণ সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহায়তা সহযোগিতায় টিকে থাকতে পারতো। গ্রামীণ সম্প্রদায়ের এবং সরকারের সাহায্য কৃষিঋণ গ্রহীতাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও খাদ্যাভাব দূর করতে সাহায্য করেতো এবং তখন ঋণিতা ছিলো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু উপনিবেশিক আমলে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ায় পূর্বেকার ঋণব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে।

উনিশ শতকের শেষ পর্যায়ে পাট ও অন্যান্য বানিজ্যিক ফসলের আধিপত্য দেখা দিলে ক্রমশই গ্রামীণ ঋণিতায় সমস্যা বাড়তে থাকে। বিশ শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যে গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য ঋণিতা সত্যিকারার্থে একটি হুমকিতে পরিণত হয়। বিশ শতকের প্রথম দ’ুদশকের অস্থির পাট বাজার এবং ১৯৩০ এর দশকের মন্দা বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এ সময়ে অর্থনীতির দুই প্রাণশক্তি, পাট ও ধানের বাজার সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে। এই পণ্যদ্রব্যের উৎপাদনমূল্য অপেক্ষা তার বাজার মূল্য অনেক নীচে নেমে যায়। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে প্রয়োজনীয় অ-কৃষিজাত পণ্যোর মূল্য কমেনি। ফলে কৃষক তাদের ক্রয় ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মন্দার ফলে জমি বন্দকীর বিনিময়ে ঋণ গ্রহনের প্রবনতা কমে যায় ও কৃষক সরাসরি জমি বিক্রয়র পথ বেছে নেয়। অবস্থাসম্পন্ন কৃষক ও মহাজন কৃষিপণ্যের মূল্যের অধঃগতির এ সুযোগটি গ্রহণ করে। প্রত্যেক ঋণগ্রস্ত চাষী ধনী কৃষক বা মহাজনের কাছে ভূমি হস্তান্তরের মাধ্যমে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করতে থাকে।

ঋণিতা বৃদ্ধি ও ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতার মধ্যে সম্পর্কের অবনতিতে বিরাজমান পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকার প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়। এভাবে ধারাবাহিকভাবে প্রণীত আইন কিছু সমস্যার সমাধান করতে পারলেও আবার একই সময় নতুন কিছু সমস্যা তৈরিও করে। মন্দার প্রভাব কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার ১৯৩৫ সালে ‘বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস আ্যাক্ট’ (বাডা) পাশ করে। এ আইনে অর্থনৈতিক তদন্ত বোর্ডের (Board of Economic Enquiry) সুপারিশগুলি গ্রহণ করা হয় যা, পূর্বেই অর্থনৈতিক দুর্দশা তদন্ত করার ও তা দূর করার উদ্দেশ্যে সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত হয়েছিলো। বোর্ড ঋণদাতার ও ঋণগ্রহীতা মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের হার কমানোর পরামর্শ করে এবং স্থানীয় ঋণ সালিশি বোর্ড এর (ডিএসবি) মাধ্যমে ঋণ নিষ্পত্তি করতে পরামর্শ দেয়। কর্তৃপক্ষ ঋণ সম্পর্কিত শান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তকেই ক্রমবর্ধমান ঋণ সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে গ্রহণ করে।

কর্তৃপক্ষ আশা করেছিল যে, BADA এর বাস্তবায়ন কৃষি সম্পর্কের উন্নয়ন ও বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার ঘটাবে। কিন্তু নতুন নীতিটি আশানুরূপ ফল প্রদানে ব্যর্থ হয়। ঋণ সালিশি বোর্ড গ্রামীণ ঋণিতার মত বড় সমস্যার আংশিক সমাধান করতে সক্ষম হয়। ডিএসবি-র পরিসংখ্যানগত তথ্য থেকে দেখা যায় যে,  দাবীকৃত ঋণের মাত্র ২৩% শতাংশ BADA এর ধারা অনুযায়ী সমাধান করতে পেরেছিলো। বাডা বাস্তবায়নের প্রথম দিকে মোট কৃষি ঋণের পরিমাণ ধরা হয়েছিলো প্রায় ১০০ কোটি রুপী এবং ১৯৪৫ সালে এর কার্যকারিতা শেষে প্রায় ১৫০ কোটি রুপী ধরা হয়। অর্থাৎ বাডা’র গৃহীত পদক্ষেপ সত্ত্বেও ঋণ সমস্যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে তাড়া করে ফিরছিলো।

গ্রামীণ ঋণিতা সমস্যা সব জেলাতে সমানভাবে প্রকট ছিল না। পূর্ব বাংলার পাট উৎপাদনকারী জেলাসমূহে ঋণের সর্বোচ্চ প্রাদুর্ভাব পরিলক্ষিত হয়। পাট চাষের সঙ্গে নগদ অর্থের সম্পর্ক ছিল বলে মন্দায় পাট চাষীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অর্থ সংকটকালে ধান চাষীরা কোনো না কোনো উপায়ে জীবন ধারনে সক্ষম হলেও, সম্পূর্ণরূপে বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থনীতি হওয়ায় জীবন ধারনের জন্য পাটচাষীদের ঋণ করতে, জমি ও কৃষিসামগ্রী বিক্রয় করতে হতো। শুধুমাত্র পাট চাষীরাই না, তাদের অর্থলগ্নিকারকগণও চরম ভোগান্তির স্বীকার হতো। ঋণ থেকে নিষ্কৃতির কথা দূরে থাকুক, পাটচাষিদের অস্তিত্ব রক্ষার মতো অর্থও পাটের বিক্রয়লব্দ অর্থ থেকে উঠে আসতো না। ডিএসবি’তে জমাকৃত ঋণ মওকুফের দরখাস্তসমূহের জেলাওয়ারি বন্টনে দেখা যায় যে আবেদনপত্রের দুই-তৃতিয়াংশই পাট উৎপাদনকারী জেলাসমূহ, যেমন-ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা, ঢাকা, পাবনা, বগুড়া এবং রংপুর থেকে গৃহীত হতো। [রতনলাল চক্রবর্তী]