খিলাফত আন্দোলন: সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

(Added Ennglish article link)
 
(Text replacement - "সোহ্রাওয়ার্দী" to "সোহ্‌রাওয়ার্দী")
 
৩৬ নং লাইন: ৩৬ নং লাইন:
এ সঙ্কটময় সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদ বর্জন প্রশ্লে খিলাফত ও অসহযোগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো মুসলিম নেতা এ ধরনের বর্জনকে মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করেন। ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে ভারতে স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ওই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।
এ সঙ্কটময় সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদ বর্জন প্রশ্লে খিলাফত ও অসহযোগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো মুসলিম নেতা এ ধরনের বর্জনকে মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করেন। ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে ভারতে স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ওই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।


এ গ্রুপের স্বরাজ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, মতিলাল নেহরু, [[ব্যানার্জী, সুরেন্দ্রনাথ|সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী]], আশুতোষ চৌধুরী, [[মুখার্জী, আশুতোষ|আশুতোষ মুখার্জী]] ও [[বসু, শরৎচন্দ্র|শরৎচক্টদন্ড বস]]। একই মতাদর্শী বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, খাজা মুহম্মদ আজম, খাজা আফজাল, নওয়াব  খাজা হাবিবুল্লাহ, [[রহমান, হাকিম হাবিবুর|হাকিম হাবিবুর রহমান]], সৈয়দ [[চৌধুরী, আলী নওয়াব|নওয়াব আলী চৌধুরী]], স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবুবকর সিদ্দিকী, (ফুরফুরার পীর), শাহ আহসান উল্লাহ, কাজেম আলী ও [[সোহ্রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী]]। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা আইন পরিষদে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করেন।
এ গ্রুপের স্বরাজ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, মতিলাল নেহরু, [[ব্যানার্জী, সুরেন্দ্রনাথ|সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী]], আশুতোষ চৌধুরী, [[মুখার্জী, আশুতোষ|আশুতোষ মুখার্জী]] ও [[বসু, শরৎচন্দ্র|শরৎচক্টদন্ড বস]]। একই মতাদর্শী বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, খাজা মুহম্মদ আজম, খাজা আফজাল, নওয়াব  খাজা হাবিবুল্লাহ, [[রহমান, হাকিম হাবিবুর|হাকিম হাবিবুর রহমান]], সৈয়দ [[চৌধুরী, আলী নওয়াব|নওয়াব আলী চৌধুরী]], স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবুবকর সিদ্দিকী, (ফুরফুরার পীর), শাহ আহসান উল্লাহ, কাজেম আলী ও [[সোহ্‌রাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ|হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী]]। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা আইন পরিষদে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করেন।


খিলাফত আন্দোলন সমর্থক বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্ব হলেন বিপিনচন্দ্র পাল, শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়, ড. রায় কুমার চক্রবর্তী, পি.সি ঘোষ, বসন্ত কুমার মজুমদার, [[দত্ত, অশ্বিনীকুমার|অশ্বিনীকুমার দত্ত]], পিয়ারী লাল রায়, গুরুচরণ আইচ, শরৎকুমার গুপ্ত, কবি মুকুন্দ দাশ, হরনাথ ঘোষ, নগেন্দ্র ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র সেন, ড. তারিনী গুপ্ত, সরল কুমার দত্ত, নিশিকান্ত গাঙ্গুলি, মনোরনজন গুপ্ত, শরৎকুমার ঘোষ, নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য, নলিনী দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, ক্ষিতিশচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ।
খিলাফত আন্দোলন সমর্থক বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্ব হলেন বিপিনচন্দ্র পাল, শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়, ড. রায় কুমার চক্রবর্তী, পি.সি ঘোষ, বসন্ত কুমার মজুমদার, [[দত্ত, অশ্বিনীকুমার|অশ্বিনীকুমার দত্ত]], পিয়ারী লাল রায়, গুরুচরণ আইচ, শরৎকুমার গুপ্ত, কবি মুকুন্দ দাশ, হরনাথ ঘোষ, নগেন্দ্র ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র সেন, ড. তারিনী গুপ্ত, সরল কুমার দত্ত, নিশিকান্ত গাঙ্গুলি, মনোরনজন গুপ্ত, শরৎকুমার ঘোষ, নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য, নলিনী দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, ক্ষিতিশচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ।

১৬:৩৫, ১৭ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে সম্পাদিত সর্বশেষ সংস্করণ

খিলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪)  ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রভাবে উদ্ভূত একটি প্যান-ইসলামি আন্দোলন। ওসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯) প্যান-ইসলামি কর্মসূচি শুরু করেছিলেন। নিজ দেশে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নির্মূল করার লক্ষ্যে এবং বিদেশি শক্তির আক্রমণ থেকে তাঁর ক্ষয়িষ্ণু সাম্রাজ্যকে রক্ষা করে বিশ্ব-মুসলিম সম্প্রদায়ের সুলতান-খলিফা’মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে তিনি এ আন্দোলনের সূচনা করেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে তাঁর দূত জামালউদ্দীন আফগানি প্যান-ইসলামবাদ প্রচারের জন্য ভারত সফর করার পর এ মতবাদের প্রতি কিছু ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে অনুকূল সাড়া জাগে।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১), তুরস্কের ওপর ইতালীয় (১৯১১) ও বলকান আক্রমণ (১৯১১-১৯১২) এবং তুরস্কের বিপক্ষে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৮) গ্রেট ব্রিটেনের অংশগ্রহণের ফলে বিশ শতকের শুরুতে প্যান-ইসলামি আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয় এবং সেভার্স চুক্তির (আগস্ট ১০, ১৯২০) অধীনে তুরস্কের ভূখন্ড ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা হওয়ায় ইসলামের পবিত্র স্থানসমূহের ওপর খলিফার অভিভাবকত্ব নিয়ে ভারতে আশংকা দেখা দেয়। এ কারণে তুর্কি খিলাফত রক্ষা এবং গ্রেট ব্রিটেন ও ইউরোপীয় শক্তিগুলির তুরস্ক সাম্রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি গোঁড়া সাম্প্রদায়িক আন্দোলন হিসেবে খিলাফত আন্দোলন শুরু হয়। আলী ভ্রাতৃদ্বয় মুহম্মদ আলী ও শওকত আলী,  আবুল কালাম আজাদ, ড. এম.এ আনসারী ও হসরত মোহানীর নেতৃত্বে এ আন্দোলন সূচিত হয়। উত্তর ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এবং প্রাদেশিক শাখার বিধানসহ বোম্বাই শহরে একটি কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। শেঠ ছোটানী নামীয় এক ধনী ব্যবসায়ীকে এ কমিটির সভাপতি ও মওলানা শওকত আলীকে সম্পাদক করা হয়। ১৯২০ সালে আলী ভ্রাতৃদ্বয় খিলাফত ইশতেহার ঘোষণা করেন। কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটি তুরস্কে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সহায়তা দান এবং দেশে খিলাফত আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য একটি তহবিল গঠন করে।

এসময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ১৯১৯ সালের এপ্রিলে সংঘটিত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড এবং ১৯১৯ সালের রাওলাট অ্যাক্টকে সরকারি নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে অহিংস জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ‘সত্যাগ্রহ’ শুরু করেন। তাঁর আন্দোলনের প্রতি মুসলমানদের সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য গান্ধী খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেন এবং কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির সদস্য হন। সর্ব ভারতীয় কংগ্রেসের নাগপুর সম্মেলনে (১৯২০) গান্ধী ‘স্বরাজ’ কর্মসূচিকে খিলাফত আন্দোলনের দাবির সঙ্গে যুক্ত করেন এবং উভয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য অসহযোগ পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

১৯২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে খিলাফত আন্দোলনের প্রতি গান্ধীর সমর্থনের বিনিময়ে খিলাফত নেতৃবৃন্দ গান্ধীর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। এভাবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায় একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গড়ে তোলে। জামিয়াতুল উলামা-ই-হিন্দের মাধ্যমে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদদের সমর্থনও পাওয়া যায়। কেন্দ্রীয় নির্বাহি ও সাংবিধানিক কমিটিতে বাংলার মওলানা  আকরম খাঁ একজন সদস্য ছিলেন।

অবশ্য কিছু বড় ধরনের ঘটনা এ আন্দোলনের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও অহিংস উদ্দেশ্য সাধনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। এসব ঘটনার মধ্যে ছিল ১৯২০ সালে ১৮ হাজার মুসলিম কৃষকের হিজরত, এদের অধিকাংশই ছিল সিন্ধু ও উত্তর পশ্চিম প্রদেশসমূহের অধিবাসী; ভারতকে ‘দারুল হারব’ বিবেচনা করে এ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বাড়াবাড়ি; ১৯২১ সালে দক্ষিণ ভারতে মোপলা বিদ্রোহ; ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মধ্য প্রদেশের চৌরি-চৌরাতে উচ্ছৃঙখল জনতা একটি থানাতে আগুন দিলে ২২ জন পুলিশের মৃত্যু। এর পরপরই গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেন। খিলাফত আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এ পদক্ষেপকে বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করেন।

শেষ পর্যন্ত তুর্কিদের কাছ থেকেই আসে খিলাফত নেতৃবৃন্দের বহিরানুগত্যের প্রতি চরমতম আঘাত। তুর্কি জাতীয়তাবাদী নেতা মোস্তফা কামালের চমকপ্রদ সেক্যুলার রেনেসাঁ, হানাদার গ্রিক বাহিনীর ওপর তাঁর বিজয় এবং পরিণামে ১৯২২ সালের নভেম্বর মাসে সালতানাতের বিলুপ্তি ও ১৯২৩ সালের অক্টোবর মাসে তুরস্কের প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর, ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে খিলাফতের বিলুপ্তি ঘটায় খিলাফতীদের মোহভঙ্গ হয়। এরপর প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্বহীন অবস্থায় ১৯২৪ সালে খিলাফত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৯১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের একাদশতম অধিবেশনে সর্বপ্রথম খেলাফত আন্দোলনের উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। বাংলা থেকে আগত .কে ফজলুল হক সভাপতির ভাষণে পরাজিত ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ভূখন্ড ভাগবাটোয়ারা করার জন্য ব্রিটেন ও তার মিত্রশক্তিগুলি যে মনোভাব গ্রহণ করে তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

প্যারিস শান্তি সম্মেলনে (১৯১৯) এ সম্ভাবনা ও উদ্বেগ অনুমোদন লাভ করলে বাঙালি খিলাফত নেতৃবৃন্দ মওলানা আকরম খাঁ, আবুল কাশেম, মুজিবুর রহমান খান কলকাতায় ১৯১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে এক জনসভার আয়োজন করেন। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অখন্ডতা এবং খিলাফতকে রক্ষা করার সপক্ষে জন সমর্থন আদায় করাই ছিল এর লক্ষ্য।

বাংলায় খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন (১৯১৮-১৯২৪) একটি গণআন্দোলনে পরিণত হয় এবং এতে হিন্দু ও মুসলমানরা অংশ নেয়। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের সমন্বিত পদক্ষেপের কারণে বাংলায় আন্দোলন প্রসার লাভ করে। গ্রাম বাংলায় খিলাফত মতাদর্শ প্রচার করেন মওলানা আবুল কালাম আজাদ। প্রাথমিক পর্যায়ে এ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলেন বাঙালি নেতৃবৃন্দ মওলানা আকরম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুজিবুর রহমান খান, মুহজ্ঞঞ্ছদ আবদুত্মদ্দাহ-হিল কাফী, মুহম্মদ আবদুল্লাহিল বাকী, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, আবুল কাশেম ও এ.কে ফজলুল হক। মওলানা আকরম খাঁ ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী বাংলা সফর করেন এবং বিশেষভাবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে খিলাফত সভা সংগঠিত করেন। ‘অসহযোগিতা ও আমাদের কর্তব্য’ শীর্ষক নিবন্ধে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ঘোষণা করেন যে, খিলাফত রক্ষা করা ও স্বরাজ অর্জন করা আমাদের আন্দোলনের দু’টি উদ্দেশ্য এবং এ আন্দোলনকে সমর্থন করা প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য।

১৯১৯ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম খিলাফত দিবস পালনের সময় কলকাতার অধিকাংশ ভারতীয় মালিকানাধীন দোকানপাট বন্ধ থাকে, বিভিন্ন মসজিদে প্রার্থনা করা হয় এবং সারা বাংলায় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১৯ সালের ২৩-২৪ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলা থেকে আগত এ.কে ফজলুল হকের সভাপতিত্বে নিখিল ভারত খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। খিলাফত সমস্যা ঝুলিয়ে রাখায় প্রস্তাবিত শান্তি সম্মেলনে অংশ না নেওয়া, ব্রিটিশ পণ্য বর্জন করা এবং সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার নীতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। মওলানা আবদুর রউফকে কমিটির সভাপতি, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে সহসভাপতি, মওলানা আকরম খাঁকে সাধারণ সম্পাদক এবং মুজিবুর রহমান ও মজিদ বখশকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। কলকাতার কলুটোলা স্ট্রীটের হিরণবাড়ি লেনে সংগঠনের কার্যালয় স্থাপিত হয়।

১৯২০ সালের ২৮-২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতা টাউন হলএ প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক খিলাফত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় নেতা এ সম্মেলনে যোগ দেন। সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট বাঙালি খিলাফত নেতৃবৃন্দ এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যরা খিলাফত সমস্যা সম্পর্কিত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ ও বয়কট অব্যাহত রাখার কর্মসূচি পুনর্ব্যক্ত করেন। সম্মেলনে ১৯২০ সালের ১৯ মার্চ দ্বিতীয় খিলাফত দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯২০ সালের মার্চ মাসে খিলাফত প্রশ্নে আলোচনার জন্য মওলানা মুহম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি খিলাফত প্রতিনিধি দল ইংল্যান্ড গমন করে। এ দলে আবুল কাশেম বাংলা থেকে প্রতিনিধিত্ব করেন। স্থানীয় খিলাফত কমিটিও গঠিত হয়। কলকাতা খিলাফত কমিটিতে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মৌলবি আবদুর রহমান যথাক্রমে সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকার আহসান মঞ্জিল এ ঢাকা কমিটি গঠিত হয়। কমিটির সভাপতি হন খাজা হাবিবুল্লাহ, বিকল্প সভাপতি সৈয়দ আবদুল হাফিজ এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন গোলাম কুদ্দুস। ঢাকা শহরের নাগরিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে একটি ‘সদর খিলাফত কমিটি’ গঠিত হয়। খাজা সুলায়মান কাদের কমিটির সভাপতি, মওলানা আবদুল জব্বার আনসারী, হাফেজ আবদুর রাজ্জাক, হাফেজ আবদুল হাকিমকে সহ-সভাপতি এবং মৌলবি সামসুল হুদাকে সম্পাদক করা হয়।

১৯২০ সালের ১৯ মার্চ বাংলায় দ্বিতীয় খিলাফত দিবস পালিত হয়। এ দিনে কলকাতার জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে এবং ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহে বহুসংখ্যক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সবচেয়ে বড় সভাটি অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইলে এবং এতে সভাপতিত্ব করেন উদার জাতীয়তাবাদী মুসলিম জমিদার আবদুল হালিম গজনবী। এ সভায় মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী খিলাফত আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে ‘সত্যাগ্রহ’ অনুশীলনের জন্য জনসাধারণের প্রতি আহবান জানান।

কংগ্রেস কমিটিগুলির পাশাপাশি বাংলার অধিকাংশ জেলায় বহুসংখ্যক খিলাফত কমিটি গড়ে ওঠে। এসব কমিটিতে প্রায়শ একই সদস্যের পুনঃ পুনঃ অন্তর্ভুক্তি দেখা যেত। এটা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম গণ-আন্দোলন যেখানে হিন্দু মুসলমান সমান উদ্দীপনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে। হিন্দু-মুসলিম সংবাদপত্রগুলি আন্দোলনে গণসমর্থন লাভের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এসব পত্রিকার মধ্যে মোহাম্মদী, আল-ইসলাম, ও দি মুসলমান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

মওলানা আজাদ, আকরম খাঁ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, বিপিনচন্দ্র পাল ও চিত্তরঞ্জন দাসের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন সারা বাংলায় একটি মুসলিম রাজনৈতিক চেতনাকে বিকশিত করে। খিলাফত আন্দোলন মূলত একটি গোঁড়াপন্থি আন্দোলন হলেও হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সমঝোতার ফলে মুসলমানদের মধ্যে উদার মনোভাবের সৃষ্টি করে। কলকাতার কর্মসূচির অনুসরণে বিদেশি পণ্য বর্জন, আদালত ও সরকারি অফিস বয়কট কার্যক্রম জোরদার করার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য গ্রামবাংলায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলা হয়। এসব স্বেচ্ছাসেবকদের চরকায় সুতা কাটা, দেশিয় দ্রব্যাদি জনপ্রিয় করে তোলা এবং খিলাফত আন্দোলনের অনুদান সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হয়। ঢাকার কিছু কিছু এলাকায় মুসলিম জমিদারগণ নিজেদের তুর্কি সুলতানের প্রতিনিধি ঘোষণা করে মুসলিম প্রজাদের কাছ থেকে ‘খিলাফত সালামী’ আদায় করেন। জমিদারগণ খিলাফত অবলুপ্তির বহুকাল পরেও প্রজাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে এ সালামী আদায় অব্যাহত রাখে।

আন্দোলনের জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে বাংলা সরকার ১৯২১ সালের ১৯ নভেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে খিলাফত ও কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের কার্যক্রম অবৈধ ঘোষণা করে। সরকারি কর্মকর্তারা খিলাফত অফিসসমূহে হানা দিয়ে দলিল দস্তাবেজ বাজেয়াপ্ত করে, সভা নিষিদ্ধ করে এবং সংগঠনের কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় মওলানা আজাদ,  চিত্তরঞ্জন দাস, আকরম খান ও অম্বিকা প্রসাদ বাজপেয়ীসহ প্রায় দেড়শ’ নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

এ সঙ্কটময় সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আইন পরিষদ বর্জন প্রশ্লে খিলাফত ও অসহযোগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো মুসলিম নেতা এ ধরনের বর্জনকে মুসলমানদের জন্য আত্মঘাতী বলে মনে করেন। ১৯১৯ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টে ভারতে স্ব-শাসিত প্রতিষ্ঠানের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তার পরিপ্রেক্ষিতে তারা ওই আইনের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন।

এ গ্রুপের স্বরাজ নেতৃবৃন্দের মধ্যে বিশিষ্ট ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিনচন্দ্র পাল, মতিলাল নেহরু, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, আশুতোষ চৌধুরী, আশুতোষ মুখার্জীশরৎচক্টদন্ড বস। একই মতাদর্শী বিশিষ্ট মুসলিম নেতৃবৃন্দ ছিলেন এ.কে ফজলুল হক, আবুল কাশেম, খাজা মুহম্মদ আজম, খাজা আফজাল, নওয়াব  খাজা হাবিবুল্লাহ, হাকিম হাবিবুর রহমান, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা, স্যার আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবুবকর সিদ্দিকী, (ফুরফুরার পীর), শাহ আহসান উল্লাহ, কাজেম আলী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদীরা আইন পরিষদে যোগদানের তীব্র বিরোধিতা করেন।

খিলাফত আন্দোলন সমর্থক বিশিষ্ট হিন্দু ব্যক্তিত্ব হলেন বিপিনচন্দ্র পাল, শ্রীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কামিনী কুমার বন্দোপাধ্যায়, ড. রায় কুমার চক্রবর্তী, পি.সি ঘোষ, বসন্ত কুমার মজুমদার, অশ্বিনীকুমার দত্ত, পিয়ারী লাল রায়, গুরুচরণ আইচ, শরৎকুমার গুপ্ত, কবি মুকুন্দ দাশ, হরনাথ ঘোষ, নগেন্দ্র ভট্টাচার্য, সতীন্দ্র সেন, ড. তারিনী গুপ্ত, সরল কুমার দত্ত, নিশিকান্ত গাঙ্গুলি, মনোরনজন গুপ্ত, শরৎকুমার ঘোষ, নগেন্দ্র বিজয় ভট্টাচার্য, নলিনী দাস, শৈলেন্দ্র নাথ দাস, ক্ষিতিশচন্দ্র রায়চৌধুরী প্রমুখ।

আকস্মিকভাবে খিলাফত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটলেও এ আন্দোলনের ফলে যে রাজনৈতিক তৎপরতার সৃষ্টি এবং অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় তা ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তির পর বাঙালি মুসলমানদের নিকট খুবই মূল্যবান বিবেচিত হয়। বাংলা থেকে খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অসংখ্য ব্যক্তিদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (যাঁর আদি নিবাস ছিল পাবনা, পরে টাঙ্গাইল জেলার কাগমারিতে বসতি করেন), জহিরুদ্দীন তরফদার (ময়মনসিংহ),  আবুল মনসুর আহমদ (ময়মনসিংহ), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (ময়মনসিংহ), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (কলকাতা), মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ (পাবনা), হাবিবুর রহমান চৌধুরী (কুমিল্লা), আশরাফ উদ্দীন আহমেদ চৌধুরী (কুমিল্লা), শাহ বদরুল আলম (চট্টগ্রাম), মৌলবি আমান আলী (চট্টগ্রাম), নূরুল হক চৌধুরী (চট্টগ্রাম), মুহম্মদ ওয়ালীউল্লাহ (চট্টগ্রাম), কাজেম আলী মিয়া (চট্টগ্রাম), তমিজউদ্দীন খান (ফরিদপুর), পীর বাদশা মিয়া (ফরিদপুর), মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ওরফে লাল মিয়া (ফরিদপুর), বিচারপতি মোহাম্মদ ইবরাহিম (ফরিদপুর), মজিদ বখশ (বরিশাল), আবুল কাশেম (বরিশাল), খান বাহাদুর হেমায়েত উদ্দীন আহমেদ (বরিশাল), কবি মোজাম্মেল হক (ভোলা), হাশেম আলী খান (বরিশাল), ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী (উলানিয়া, বরিশাল), সুলতান আহমেদ চৌধুরী (বরিশাল), মাজেদ কাজী (কসবা, বরিশাল), খান সাহেব হাতেম আলী জমাদার (বরিশাল), সৈয়দ মুহম্মদ আফজল (পিরোজপুর), ইসমাইল খান চৌধুরী (বরিশাল), মৌলবি মুহম্মদ ইবরাহিম (নোয়াখালী), আবদুল জববার খদ্দর (নোয়াখালী), আবদুল গোফরান (নোয়াখালী), সৈয়দ আহমদ খান (নোয়াখালী), নাসির আহমদ ভূইয়া (নোয়াখালী), সুরেনচন্দ্র দাসগুপ্ত (বগুড়া), হোসেন আহমদ (গাইবান্ধা), রাজিব উদ্দীন তরফদার (বগুড়া), কবিরাজ শেখ আবদুল আজিজ (বগুড়া), ইসহাক গোকুলী (বগুড়া), মওলানা মনিরউদ্দীন আনওয়ারী (দিনাজপুর), সোমেশ্বর প্রসাদ চৌধুরী (বর্ধমান), শাহ আবদুল হামিদ (রংপুর), আফসার উদ্দীন আহমেদ (খুলনা), সুকুমার বন্দোপাধ্যায় (কুষ্টিয়া), মৌলবি শামসুদ্দীন আহমেদ (কুষ্টিয়া), সৈয়দ মজিদ বখ্শ (যশোর) এবং মওলানা আহমদ আলী (খুলনা)।

খিলাফত আন্দোলনের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দ ছাড়াও এ সময়ে শহর এলাকা এবং প্রধানত বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি নতুন মুসলিম নেতৃশ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। জনগণকে সংগঠিত ও উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে তাঁরা অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। খিলাফত আন্দোলন মফস্বল ভিত্তিক এক নতুন নেতৃত্বের সুযোগ সৃষ্টি করে। এ নেতৃত্ব বাঙালি মুসলমানদের একটি সমন্বিত আত্মসচেতন রাজনৈতিক পরিচিতি তুলে ধরার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। [সুফিয়া আহমেদ]