খানম, সাইদা

সাইদা খানম

খানম, সাইদা (১৯৩৭-২০২০) বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী এবং দেশের নারী আলোকচিত্রীদের পথিকৃৎ। তিনি ১৯৩৭ সালের ২৯শে ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। সাইদা খানমের পৈতৃক নিবাস ফরিদপুরের ভাঙ্গায় হলেও, তাঁর জন্ম পিতার কর্মস্থল পাবনায়। তাঁর বাবা আবদুস সামাদ খান এবং মা নাছিমা খাতুন। সাইদা খানমের শৈশব কেটেছে পাবনার ইছামতির তীরে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। লেখা-পড়ার শুরুটাও হয়েছিল সেখানেই। তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে এবং ১৯৭২ সালে গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। সাইদা খানম ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কাজ করেছেন।

ক্যামেরার প্রতি সাইদা খানমের অনুরাগ ছোট বেলা থেকেই। তাঁর বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখনই তিনি হাতে ক্যামেরা তুলে নিয়েছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালে বেগম পত্রিকার আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তবে বেগম ছাড়াও, তাঁর তোলা ছবি বাংলাদেশের প্রথম সারির দৈনিকে যেমন দ্য অবজারভার, মর্নিং নিউজ, ইত্তেফাকসংবাদ ইত্যাদি পত্রিকায় ছাপা হয়। দুটি জাপানি পত্রিকায়ও তাঁর তোলা আলোকচিত্র মুদ্রিত হয়েছিল। তবে আলোকচিত্রী হিসেবে তাঁর চলার পথটি মোটেই নির্বিঘ্ন ছিল না। একজন নারী আলোকচিত্রী হিসেবে অনেক সামাজিক বাধা-বিপত্তি মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। খালা কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, বড়বোন অধ্যক্ষ হামিদা খানম ও মহসিনা আলীসহ অনেকেই তাঁকে পাশে থেকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তাঁকে উৎসাহিত করেছেন এদেশের নারী জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন ও বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম।

সাইদা খানমের তোলা আলোকচিত্রের সংখ্যা ৩ হাজারেরও অধিক। তিনি যেমন ছবি তুলেছেন প্রকৃতি ও নিসর্গসহ নানা বিষয়ের উপর, তেমনি দেশ-বিদেশের রাজনীতিবিদসহ শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের স্বনামধন্য ব্যক্তিদের। তিনি ছবি তুলেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখের। এ তালিকায় আরো আছেন রানী এলিজাবেথ, মাদার তোরেসা, মার্শাল টিটো, অড্রে হেপবার্ন- এর মতো বিখ্যাত মানুষজনও। চন্দ্রবিজয়ী নীল আর্মস্ট্রং, এডউইন অলড্রিনস, মাইকেল কলিন্সের ছবিও তুলেছেন সাইদা খানম নিজ হাতে। ১৯৬২ সালে চিত্রালী পত্রিকার হয়ে একটি অ্যাসাইনমেন্টে নিয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও অস্কারজয়ী সত্যজিৎ রায়ের ছবি তুলে সমাদৃত হন সাইদা খানম। সিনেমাটোগ্রাফার না হয়েও তিনি সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ চলচ্চিত্রের আলোকচিত্রী হিসেবেও কাজ করেছিলেন। সাইদা খানমের অন্যতম আলোচিত কাজ হলো ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ঢাকার আজিমপুর এলাকায় অস্ত্র হাতে প্রশিক্ষণরত নারীদের ছবি।

১৯৫৬ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেন সাইদা খানম। তাঁর আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল ভারত, জাপান, ফ্রান্স, সুইডেন, পাকিস্তান, সাইপ্রাস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশে। আলোকচিত্রী হিসেবে দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ নেন তিনি। সাইদা খানম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কৃত হন। তিনি জার্মানিতে ১৯৫৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড কোলন পুরস্কার পান। জাপানের ইউনেস্কো অ্যাওয়ার্ড, অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কার, বেগম পত্রিকার ৫০ বছর পূর্তি পুরস্কার, বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটির সম্মানসূচক ফেলোসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেন তিনি। এ ছাড়া আলোকচিত্রে অনন্য অবদানের জন্য সরকার ২০১৯ সালে সাইদা খানমকে একুশে পদকে ভূষিত করে।

ক্যামেরায় ছবি তোলার পাশাপাশি লেখালেখি করেছেন আজীবন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ধূলোমাটি (১৯৬৪), স্মৃতির পথ বেয়ে, আমার চোখে সত্যজিৎ রায় (২০০৪) এবং আলোকচিত্রী সাইদা খানম-এর উপন্যাসত্রয়ী'। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর লেখা অনেক ছোট গল্প ও প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।

সাইদা খানম বাংলা একাডেমি ও ইউএনএবির আজীবন সদস্য ছিলেন। যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক সোসাইটি এবং 'বাংলাদেশ মহিলা সমিতি'র সঙ্গেও। তিনি 'বাংলাদেশ লেখিকা সংঘে'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করেছেন। সাইদা খানম ছিলেন একজন সচেতন দেশপ্রেমিক ও সমাজসেবী। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত না থাকলেও, পরোক্ষভাবে ছাত্র গণআন্দোলনে জড়িত ছিলেন। সমাজসেবামূলক কাজেও তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর হাসপাতালে নার্স সংকট দেখা দিলে তিনি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবী নার্সিংয়ের কাজ করেন।

বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম ২০২০ সালের ১৮ই আগস্ট ৮৩ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। [মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান]