খাদ্যবাহিত রোগ

খাদ্যবাহিত রোগ (Food-borne Disease)  বিভিন্ন রোগ উৎপাদক জীবাণু, সাধারণত ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য অণুজীব এবং সেগুলি থেকে নিঃসৃত বিষদ্রব্য দ্বারা দূষিত খাদ্যগ্রহণের ফলে সৃষ্ট রোগ। জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে উন্নয়নশীল দেশসমূহে এসব রোগের প্রাদুর্ভাব সাধারণ ঘটনা। অণুজীবদের মধ্যে ব্যাকটেরিয়াই সম্ভবত খাদ্যবাহিত রোগের প্রধান কারণ। খাদ্যবাহিত রোগের অন্যান্য সংঘটকদের মধ্যে আছে বিভিন্ন পরজীবী কৃমি (helminths), প্রাণীদেহনিঃসৃত বিষ, রাসায়নিক বর্জ্য, পরিবেশদূষক, পরিষ্কারক দ্রব্যাদি, জীবাণুনাশক ইত্যাদি।

সারণি খাদ্যবাহিত রোগসংশ্লিষ্ট প্রধান জীবাণুগুলি সম্পর্কিত তথ্য।

অণুজীব খাদ্যের উৎস জীবাণুর উপ্তিকাল (ঘণ্টা) রোগের ব্যাপ্তিকাল রোগ
Salmonella species কাঁচা মাংস, হাঁস-মুরগির ডিম, দুধ ১২-২৬ ১-৭ দিন উদরাময়, পেটব্যথা, বমি, জ্বর
Staphylococcus aureus ঠান্ডা মাংস ও দুধ, দুগ্ধজাত সামগ্রী ২-৬ ৬-২৪ ঘণ্টা   বমনেচ্ছা, বমি, উদরাময়, পেটব্যথা, জলশূন্যতা
Clostridium perfringens কাঁচা মাংস, হাঁস-মুগরির ডিম, শুকনো খাদ্য, ঔষধি, মসলা, শাকসবজি ৮-২২ ২৪-৪৮ ঘণ্টা  উদরাময়, পেটব্যথা, বমনেচ্ছা
Clostridium botulinum অযত্নে রক্ষিত মাংস, মাছ, শাকসবজি ১২-৯৬ (সাধারণত ১৮-৩৬) ২৪ ঘণ্টা থেকে ৮ দিনের মধ্যে মৃত্যু অবসন্নতা, অবসাদ, মাথাঘোরা, উদরাময় ও পরে কোষ্ঠবদ্ধতা ও কেন্দ্রীয় স্নায়ুবৈকল্য
Bacillus cereus ও অন্যান্য প্রজাতি দানাশস্য, শুকানো খাদ্য, দুধ, দুগ্ধজাত সামগ্রী, মাংস ও মাংসজাত খাদ্য, ঔষধি, মসলাপাতি, শাকসবজি ১-৬ ৬-২৪ ঘণ্টা বমনেচ্ছা, বমি, উদরাময়
Escherichia coli বিভিন্ন কাঁচা খাদ্য, বিশেষত প্রাণিজ সামগ্রী ১৭-৭২ ১-৭ দিন  উদরাময়, রক্ত ও শ্লেত্মাসহ
Vibrio cholera পানি এবং দূষিত খাদ্যদ্রব্য   ২-৪৮ ২-৫ দিন বমি, উদরাময়, পেটব্যথা, জলশূন্যতা
Vibrio parahaemolyticus  কাঁচা ও রান্না মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাদ্য ২-৪৮ ২-৫ দিন উদরাময়, বমি, জ্বর, পেটব্যথা, জলশূন্যতা
Yersinia enterocolitica কাঁচা মাংস, হাঁস-মুরগির ডিম, মাংসজাত দ্রব্য, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্য, শাকসবজি ২৪-৩৬ ৩-৫ দিন উদরাময় ও আন্ত্রিক প্রদাহ
Streptococcus species কাঁচা দুধ, কাঁচা মাংস এবং হাঁস-মুরগির ডিম, সংক্রমিত ব্যক্তির প্রস্ত্ততকৃত খাদ্য ৩-২২ ২৪-৪৮ পেটব্যথা, বমি, উদরাময়
Compylobacter jejuni হাঁস-মুরগির ডিম, কাঁচা মাংস, কাঁচা অথবা কম ফুটানো দুধ, অশোধিত জল ৩-৫ দিন কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ  জ্বর, মাথাধরা, পেটব্যথা, রক্ত ও শ্লেষ্মাসহ উদরাময়
ভাইরাস কাঁচা চিংড়ি, কাঁকড়া, সংক্রমিত লোকের হাতে প্রস্ত্তত ঠান্ডা খাবার, পানি - - টাইফয়েড জ্বর
Listeria monocytogenes মাংস, হাঁস-মুরগির ডিম, নরম পনির ও অন্যান্য দুগ্ধজাত খাবার, শাকসবজি, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি  ১-৭০ দিন কয়েক দিন থেকে কয়েক বছর। মৃত্যুহার ৩০% সামান্য ফ্লু-র মতো অসুখ, মেনিনজাইটিস, গর্ভপাত

দেশে প্রাণিজ খাদ্যগুলিই বেশির ভাগ জীবাণুঘটিত রোগের প্রাথমিক উৎস। হাঁস-মুরগির ডিম পাড়ার সময় ডিম Salmonella ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। গোবর বা দুগ্ধশালার পরিবেশ ও যন্ত্রপাতি থেকে গরুর দুধে দূষণ ঘটতে পারে। দেশি মদের দূষণ প্রায়শই ঘটে এবং দূষিত দেশি মদ খেয়ে লোক মারাও যায়। মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়া উৎসস্থলে বা পরবর্তী প্রক্রিয়াজাতকরণের সময় দূষিত হতে পারে। রান্নার তাপে অনেক জীবাণু ধ্বংস হলেও রান্নার পর দূষণ ও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো কোনো জীবাণুর স্পোর (spore) অত্যধিক তাপসহিষ্ণু। ব্যাকটেরিয়া থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থে তাপ সহিষ্ণুতায় তারতম্য থাকে। Clostridium botulinum থেকে নির্গত বিষাক্ত পদার্থগুলি তাপসহিষ্ণু নয় এবং ফুটানো পানিতে বিনষ্ট হয়। কিন্তু Staphylococcus aureus এবং Bacillus cereus থেকে উৎপন্ন আন্ত্রিক বিষগুলি অত্যন্ত তাপসহিষ্ণু। রান্না খাবার স্পর্শ বা নাড়াচাড়ার প্রক্রিয়ায় বহু রকমের অণুজীব দ্বারা সংক্রমিত হতে পারে। খাদ্য পরিবেশকও খাদ্যে জীবাণুর স্থানান্তর ঘটাতে পারে। হাত দিয়ে খাবার নাড়াচাড়ার সময় নাকের বা ত্বকের জীবাণুগুলি খাদ্যে স্থানান্তরিত হওয়া খুবই সহজ। উদর বা আন্ত্রিক রোগী খাদ্য নাড়াচাড়া করলে খাদ্যে মলদূষণের ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বা পরিবেশদূষক খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটায় সেগুলির মধ্যে আছে ছত্রাকনাশক, আগাছানাশক, কীটনাশক ও অন্যান্য কৃষি রাসায়নিক সামগ্রী।

রাসায়নিক দূষণের প্রধান রোগলক্ষণ হচ্ছে দূষিত খাদ্য গ্রহণের কয়েক মিনিট থেকে আধঘণ্টার মধ্যে বমি শুরু। পরিবেশদূষক, যেমন সীসা বা ভারি ধাতুগুলি খাদ্যের সঙ্গে দেহে প্রবেশের পর দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে।  [মোঃ কবিরউল্লাহ]