কাসীদা

কাসীদা  একটি আরবি শব্দ। এর উৎপত্তি হয়েছে ‘কাসদ’ শব্দমূল থেকে। এর অর্থ নিরেট ও পরিপূর্ণ, মস্তিষ্ক বা মজ্জা। কাসদ-এর আরো একটি অর্থ ইচ্ছা করা। যে কবিতায় প্রিয়জনের প্রশংসা বর্ণনা করা হয়, পরিভাষায় সে কবিতাকে কাসীদা বলা হয়। তবে কাসীদার বিষয়বস্ত্তর পরিধি অনেক বিস্তৃত। এতে থাকে সৌন্দর্য ও প্রেম, সময়ের উত্থান-পতন, বসন্ত ও  উদ্যান, নৈতিককতা ও জ্ঞান, দোয়া প্রভৃতি। আর যাঁরা কাসীদা বলতে নিরেট বা মস্তিষ্ক বলে মনে করেন, তাঁদের মতে, কবি তাঁর নিজ বক্তব্যকে বিশেষ এক পদ্ধতিতে কবিতায় উপস্থাপন করেন, অথবা তাঁর কবিতায় তিনি ব্যাপকভাবে পূর্ণাঙ্গ বিষয়বস্ত্তর অবতারণা করেন। কাসীদা প্রধানত প্রিয়জনের প্রশংসা বর্ণিত হলেও এর মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ প্রকাশ পায়।

কাসীদা প্রথম দেখা যায় আরবি কাব্যে। প্রাগ-ইসলাম যুগে আরব কবিগণ এর সূচনা করেছিলেন। কাসীদায় তিনটি অংশ বা স্তর থাকে যথা, প্রথম অংশে নাসবী বা প্রণয়মূলক মুখবন্ধ থাকে। দ্বিতীয় অংশে থাকে যাদের সম্পর্কে তিনি প্রশংসা করতে চান তাদের প্রতি কবির বক্তব্য। শেষ অংশে কবির ঈপ্সিত ব্যক্তি বা গোত্রের প্রশংসা কিংবা নিন্দা স্থান পায়। এ স্তরে কোনো কোনো কবি নৈতিক কোনো শিক্ষার অবতারণা করে কবিতা শেষ করেন। কাসীদা আরবি কাব্য থেকে অন্যান্য ভাষায় বিস্তার লাভ করে। ফলে কাসীদা সম্প্রতি ফারসি, তুর্কি ও উর্দু ভাষায় নিজ নিজ পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী রচিত হয় এবং বিভিন্ন ধারায় বিকাশ লাভ করে।

উপমহাদেশে প্রথম কাসীদা রচনা করেন আমীর খসরু। মুগলপূর্ব যুগে কাসীদা রচয়িতা হিসেবে সালমান সাওয়াজী ও হুম্মাম তাবরিজির নাম উল্লেখযোগ্য। মুগল যুগে কাসীদা বিশেষ পদ্ধতিতে লেখা হতো। এজন্য এ পদ্ধতি ‘সুবক-ই-হিন্দি’ বা ভারতীয় পদ্ধতি নামে অভিহিত। মুগল আমলে যাঁরা কাসীদা রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন, তাঁদের মধ্যে আকবরের সময়কার ফায়জী ও উরফী, জাহাঙ্গীরের আমলের নাজীরী ও তালিব আমিনী, শাহজাহানের আমলের কবি কুদসী মাশহাদী ও কালীম আবু তালিব এবং পরবর্তীকালে কবি আসাদুল্লাহ খানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশে কাসীদা চর্চার স্বরূপ ও আকর সম্পর্কে বলা যায় যে, ঢাকায় মুগল সাহিত্য ও সংস্কৃতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে ছিল কাসীদা। বিশ শতকের প্রথম দিকে হাকিম হাবিবুর রহমান তাঁর ঢাকা পাচাশ বারাশ পাহেলে নামক গ্রন্থে কাসীদার পুনর্জাগরণের কথা উল্লেখ করেন।

এ সময়ের অন্যান্য সূত্রও তার উদ্ধৃতি সমর্থন করে। জানা যায় তৎকালীন নওয়াব ও সরদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছিল কাসীদা। তবে এ সময়ের কাসীদার চর্চা সীমিত হয়ে পড়েছিল রমজান মাসের মধ্যে। এ সময়ের সংগৃহীত কালাম থেকেও বোঝা যায় যে, দরবারি বিনোদন থেকে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে কাসীদার উত্তরণ। বিশেষ করে, সেহেরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে কাসীদা। ধর্মীয় পুণ্য লাভের জন্য গভীর রাতে কাসীদা গায়ক দলে সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণির উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ ব্যাপক জনপ্রিয়তা উত্তরণ ঘটায় সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার। এলাকাভিত্তিক কাসীদাকে নিয়ে আসে সাধারণের আরও কাছাকাছি। ধর্মীয় পুণ্য অর্জনের পাশাপাশি কাসীদা হয়ে ওঠে সাধারণের বিনোদনের খোরাক। শুরু হয় কাসীদার কালামে জনপ্রিয় হিন্দি ও উর্দু সিনেমার সুরের ব্যবহার। এর পাশাপাশি কাওয়ালি, শাহেদি, মারসিয়া, নাত-এ-রাসূল, ভৈরবী, মালকোস, উচ্চাঙ্গ প্রভৃতি সুরের প্রভাব তো ছিলই। প্রতিযোগিতার চাহিদা অনুযায়ী রচিত হতে থাকে নিত্য নতুন আঙ্গিকের কালাম। প্রতিযোগিতাগুলি অনুষ্ঠিত হতো রমজান মাসে। দলীয় প্রতিযোগিতায় সাত-আটজন শিল্পী সালারে কাফেলার নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করত। দলনেতা বা সালারে কাফেলা সঙ্গীত রচনা, সুর সংযোজন ও উপস্থাপনে মুখ্য ভূমিকা রাখত। প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করত উর্দু ভাষায় অভিজ্ঞ এবং ধর্মীয় বিষয়ে পন্ডিত ব্যক্তিরা।

কাসিদার বৈশিষ্ট্য হলো গানের কথার মতো ছন্দবদ্ধ চরণ যা উর্দুতে ‘কালাম’ নামে অভিহিত। বিভিন্ন কবি-লেখকরা এসব উর্দুতে লিখে থাকেন। তবে বর্তমানে ঢাকায় প্রায় প্রতিটি মহল্লায় যাঁর লেখা কাসীদা উপস্থাপিত হয় তিনি হলেন ঢাকার উর্দু কবি তালিব কবির।

কাসীদার ক্ষেত্রে আর যা দরকার তা হলো সুর। খুবই মধুর ও করুণ সুর এতে সংযোজনের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় পুরনো দিনের গানের সুরই আরোপ করা হয় নতুন লেখা কাসীদায়। তবে হোসেনী দালান এলাকায় অনেক সময় মর্সিয়ার সুর গ্রহণ করা হয়, যা কাসিদাকে পুরোপুরি হূদয়স্পর্শী করে তোলে। একজন সুরেলা কণ্ঠস্বরের অধিকারী সুন্দরভাবে কাসিদা উপস্থাপন করবেন। যার উর্দু উচ্চারণ অবশ্যই সঠিক হতে হবে, যিনি তাল-লয় সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন; কিন্তু কোনো পেশাদারী গায়ক নন। তিনিই হবেন দলনেতা। এ দলনেতাকে বলা হয় ‘লোকমাদার’। সাত থেকে আটজনের উল্লিলখিত গুণাবলিসম্পন্ন একটা দল থাকবে যারা তাদের দলনায়ক বা ‘লোকমাদার’কে কোরাসে সহযোগিতা করবে। এদেরকে বলা হয় ‘হাদি’।

এক একজন বিচারক কাসীদার এক একটি অংশের উপর লক্ষ রাখেন। মোট চারটি অংশ যেমন, ‘মিয়ারে কালাম’ অর্থাৎ কাসীদাটি ব্যাকরণসম্মত কিনা তা নির্ধারণ, ‘তালাফ্ফুস’ বা উর্দু উচ্চারণ সঠিক কিনা তা নির্ধারণ, ‘তারান্নুম’ বা সুর-তাল-লয় ঠিক আছে কিনা তা নির্ধারণ। এ ছাড়াও রয়েছে সময়ের সীমাবদ্ধতা। বারো মিনিটের মধ্যেই শেষ করতে হবে কাসীদা উপস্থাপন। সবাইকে পরতে হবে পাজামা-পাঞ্জাবি অথবা কাবলি স্যুট। জমা দিতে হবে উর্দুতে লিখিত কাসীদার কপি এবং পরিমাণে অতি অল্প (পঞ্চাশ বা এক’শ টাকা) এন্ট্রি ফি। কিন্তু পুরস্কারগুলি হয় খুব ভালো।

বিষয়বস্ত্ত, সুর ও পরিবেশনায় কালের সাপেক্ষে বিভিন্ন ধরনের রমজানের কাসীদা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

চাঁনরাতি আমাদ রহমত, বরকত ও মাগফেরাত বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে মাহে রমজানের চাঁদের। পবিত্র মাহে রামজানের চাঁদ নিয়ে আসে নতুন এক আমেজের কাসীদা যা চাঁনরাতি আমাদ নামে পরিচিত। চাঁদের আগমনে খুশি হয়ে চাঁদকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এ কাসীদা চলতে থাকে চতুর্থ এমনকি পঞ্চম রোজা পর্যন্ত। এর বিষয়বস্ত্ত মূলত রমজান মাসের ফজিলত, আল্লাহ-রাসুলের প্রশংসা বর্ণনা। চাঁনরাতি কাসীদার প্রচলন বিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।

খুশ আমদিদ উর্দু খুশ আমদিদ-এর শাব্দিক অর্থ সু-স্বাগতম। রমজান মাসকে আনন্দের সাথে স্বাগত জানিয়ে প্রথম পনেরো রোজা পর্যন্ত খুশ আমদিদ গাওয়া হয়। এ কাসীদাকে অনেকে বলে ‘সদা’। আবার কেউ কেউ বলে ‘খুশ গাওয়ালি’। এ ধরনের কাসীদার বিষয়বস্ত্ত হলো রামজান মাসে মাহাত্ম, আল্লাহ-রাসুলের প্রশংসা বর্ণনা ইত্যাদি। ঢাকার কাসীদা প্রতিযোগিতায় খুশ আমদিদ এর প্রচলন অপেক্ষাকৃত কম।

আলবিদা রমজান মাসের বিদায়ের প্রাক্কালে অর্থাৎ ষোলো রোজার পর থেকে আফসোস ও বিরতি সুরে আলবিদা গাওয়া হয়। এর বিষয়বস্ত্ত মূলত রমজানে বিরহ, হজরত আলীর শাহাদাতের দুঃখ প্রকাশ, কেয়ামতের বর্ণনা ইত্যাদি। পুরনো ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বিশ রামজান থেকে সাতাশ রমজান পর্যন্ত কাসীদা প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। কাসীদা প্রতিযোগিতায় সাধারণত আলবিদা পরিবেশিত হয়।

ঈদ মুবারক ঢাকায় ঈদের পরদিন ঈদের মিছিলে জাঁকজমকপূর্ণভাবে ঈদ মুবারক কাসীদা গাওয়া হতো। সারা রমজান জুড়ে কাসীদায় বাদ্যযন্ত্র অনুপস্থিত থাকলেও ঈদ মুবারক কাসীদায় বাদ্যযন্ত্র হিসেবে হারমনিয়াম ও তবলা ব্যবহার করা হতো।

বিশেষ কাসীদা রমজান মাসের সেহেরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য যে কাসীদা গাওয়া হতো তা নির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতিকে অনুসরণ করত না। এ ক্ষেত্রে দলীয় পরিবেশনা বা সুনির্দিষ্ট চরণও রচনা করা হতো না। বিশেষ এ কাসীদা গায়কেরা ইবাদতের অংশ হিসেবে রোজাদারদের ঘুম ভাঙ্গাতেন। এ কাসীদা গায়কেরা আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন না।

[শায়লা পারভীন]