করিম, সরদার ফজলুল

সরদার ফজলুল করিম

করিম, সরদার ফজলুল (১৯২৫-২০১৪) জাতীয় অধ্যাপক। বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। সরদার ফজলুল করিম বরিশালের আটিপাড়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে ১৯২৫ সালের ১লা মে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খবির উদ্দিন সরদার কৃষি কাজ করতেন। মা সফুরা বেগম ছিলেন গৃহিণী। তারা দুই ভাই তিন বোন। সরদার ফজলুল করিমের শৈশবকাল কেটেছে গ্রামে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় তাঁর বন্ধু মোজাম্মেল হক তাঁকে এক রাতের মধ্যে ‘পথের দাবী’ পড়ে শেষ করতে দেন। এ বই থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন বিপ্লবী চেতনায়। জেল খেটেছেন, শাসকের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-অনশন করেছেন।

১৯৪০ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি ঢাকায় আসেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ১৯৪২ সালে সরদার ফজলুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। বি.এ অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৬ সালে এম.এ-তেও প্রথম শ্রেণিতে ১ম হন। পরবর্তীতে এ বিভাগেই তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৪৮ সালে রাজনীতির কারণে স্বেচ্ছায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় তিনি ইস্তফা দেন।

বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত থাকার পর্যায়ে তিনি দীর্ঘ ১১ বছর কারান্তরালে বাস করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে সরদার ফজলুল করিম প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৫ সালে গঠিত পাকিস্তান কন্্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলিরও সদস্য হয়েছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা জেলে কারাবন্দিদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে সরদার ফজলুল করিম একটানা ৫৮ দিন অনশনে অংশগ্রহণ করেন। কারাগার থেকেই তিনি পাকিস্তান কন্্সটিটিউয়েন্ট এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৬২ থেকে ১৯৭১ (৭ই সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সরদার ফজলুল করিম বাংলা একাডেমিতে অনুবাদ এবং সংস্কৃতি শাখার অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর সরদার ফজলুল করিম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। একই বিভাগে তিনি সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়েছিলেন।

সরদার ফজলুল করিম অনেকগুলো মৌলিক গ্রন্থের রচয়িতা। তাঁর রচিত ‘দর্শন কোষ’ দর্শন বিষয়ে তাঁর সুগভীর পা-িত্যের প্রামাণ্য দলিল। তাঁর আলোচিত উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রুমীর আম্মা’, ‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ ও ‘সেই সে কাল’ ইত্যাদি। অনুবাদ সাহিত্যে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে তিনি প্লেটো, এরিস্টটল, রুশো, এঙ্গেলস প্রমুখ ইউরোপীয় মনীষীর সৃজনশীল কর্ম অনুবাদ করে বাঙালি মননের যোগাযোগ ঘটিয়েছেন। বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজকে গ্রিক দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সরদার ফজলুল করিম বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। তাঁর অনূদিত বইগুলোর মধ্যে ‘প্লেটোর সংলাপ’, ‘প্লেটোর রিপাবলিক’, ‘এরিস্টটলের পলিটিক্স’ ছাড়াও রয়েছে ‘এঙ্গেলসের অ্যান্টি ডুরিং’, ‘রুশোর সোস্যাল কন্ট্রাক্ট’ ইত্যাদি।

১৯৫৭ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সুলতানা রাজিয়ার সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবন্ধ হন। তাঁদের এক কন্যা ও দুই পুত্র সন্তান রয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০০০ সালে তাঁকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কারে’ ভূষিত করা হয়। ২০০১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার থেকে শিক্ষাবিদ হিসেবে শিক্ষা পুরস্কার পান।

২০১৪ সালের ১৫ই জুন তিনি ঢাকায় পরলোক গমন করেন। [সাব্বীর আহমেদ]