উপকূলীয় বনায়ন

উপকূলীয় বনায়ন (Coastal Plantation)  সমুদ্রতীরের বনায়ন। বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ১৯৬৬ সালে উপকূল ও উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলে ম্যানগ্রোভ গাছপালা লাগানো শুরু হওয়ার পর ইতোমধ্যে প্রায় ১ লক্ষ ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে বনায়ন সম্পন্ন হয়েছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জানমাল রক্ষার জন্যই নয়, নতুন কর্মসংস্থান ও অর্থকরী পণ্য হিসেবে এখানে উৎপন্ন কাঠের জন্যও কর্ম উদ্যোগটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। এ নতুন আবাদে লাগানো হয়েছে মূল্যবান ম্যানগ্রোভ প্রজাতি: কেওড়া (Sonneratia apetala), বাইন (Avicennia officinalis), সাদা বিনা (A. marina), বড় বিনা (A. alba), আমুর (Amoora cucullata, Bruguiera sexangula), গেওয়া (Excoecaria agallocha), পশুর (Xylocarpus mekongensis), সুন্দরি (Heritiera fomes), গরান (Ceriops decandra), এবং গোলপাতা (Nypa fruticans)। এগুলির মধ্যে কেওড়ার আবাদে যথেষ্ট পরিমাণ সুফল পাওয়া যায়। পূর্ব-উপকূলে বাইন ও বিনা প্রজাতির আবাদও উল্লেখযোগ্য। সফল ম্যানগ্রোভ আবাদের মধ্যে এখন কেওড়া ও বিনার অংশভাগ যথাক্রমে ৯৪.৪% ও ৪.৮%।

বাংলাদেশের উপকূল প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ। জোয়ারের সময় ম্যানগ্রোভ বনসহ গোটা তীরভূমি নিয়মিত ডুবে যায়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পুরনো আবাদের বনতল পানিতে ডুবে না। মাটির ধরন পলিকাদা দোঅাঁশ থেকে কাদা-দোঅাঁশ। pH মান ৭.৫-৮.২। অস্থিতিশীল পরিবেশে বনায়ন চলে, তাই গাছগুলি বড় হওয়ার আগে সর্বদাই বিনাশের ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভে বাস্তুসংস্থানিক পর্যায়ক্রম অনুযায়ী  কেওড়া ও বাইন অগ্রবর্তী প্রজাতি। নিয়মিত নিমজ্জিত নতুন আবাদে এ প্রজাতিগুলি ভালোই বাড়ে। কড়া রোদ এসব বৃক্ষের উপযোগী এবং সম্ভবত সেজন্যই এ সাফল্য। কেওড়া চারা লাগিয়ে ও বাইন/বিনা কাদায় বীজ পুঁতে চাষ হয়।

উপকূলীয় বনায়নে স্থান প্রস্ত্ততির কাজ খুবই সামান্য। পানির উপরের জমি সমান করলে সেখানে ঘাস (Portesia coarctataMyriostachya wightiana) গজায়। বর্ষা মৌসুমে ঘাস বড় হওয়ার আগেই চারা লাগানো হয়। প্রায় ০.৬ মিটার লম্বা চারা লাগাতে হয়। উপড়ানো চারাগুলি গাঁট বেঁধে নৌকাযোগে আবাদে আনা হয়। চারার প্রাথমিক বৃদ্ধি যথেষ্ট দ্রুত হওয়ায় আগাছা দমন নিষ্প্রয়োজন। গোড়ার দিকে ২.৪ মি × ২.৪ মি দূরত্বে চারা লাগানো হলেও পরে বেশিরভাগ খামারেই ১.২ মি × ১.২ মি দূরত্ব রাখা হয়। বর্তমানে কেওড়ার জন্য ১.৫ মি × ১.৫ মি ও বিনার জন্য ১ মি × ১ মি দূরত্ব রাখা হচ্ছে। স্থানানুসারে কেওড়ার বৃদ্ধিতে তারতম্য ঘটে। উপকূলীয় অঞ্চলের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকেই বৃদ্ধির হার বেশি। উপযুক্ত জায়গায় ২০ বছরে কেওড়া গাছ গড়ে ২০ মি লম্বা এবং বুকসমান উচ্চতায় ২০ সেমি চওড়া হয়। উৎপাদনশীলতা বছরে হেক্টর প্রতি ১০ ঘন মিটার হতে পারে। আবর্তনকাল নির্ধারিত হয়েছে ১২-১৫ বছর। অবশ্য নানা কারণে এখনও গাছকাটা শুরু হয়নি।

উপকূলীয় বনায়নের সমস্যা অনেক। বন টিকিয়ে রাখার ও পরিপোষকতার (sustainability) জন্য বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। উপকূলীয় বনায়নে কেওড়া বা বিনা গাছের একক চাষ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। বাস্তুসংস্থানিক পর্যায়ক্রম অনুযায়ী উভয়ই অগ্রগামী প্রজাতি এবং অন্যান্য গাছগাছালি প্রাথমিক আবাদের উপযুক্ত প্রমাণিত হয়নি। উপকূলীয় বনায়নে কীটপতঙ্গের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য শুধু কেওড়া ও বিনা গাছের মিশ্রচাষের সম্ভাবনাই আছে যা আজও কার্যকর হয় নি।

[নিয়াজ আহমেদ সিদ্দিকী]

আরও দেখুন জোয়ারধৌত বন