ইরানি

ইরানি  তুর্কিগণ বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা। তুর্কিদের পরে শাসক হিসেবে বাংলায় আসেন যথাক্রমে আফগান ও মুগলগণ। ইরান যদিও বাংলার নিকটস্থ দেশ নয় এবং ইরানিরা এদেশে শাসন কায়েমের কোনো সুযোগ পায় নি, তথাপি বাংলায় মুসলিম শাসনামলে এখানকার সমাজ জীবন ও সংস্কৃতিতে ইরানিদের প্রভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। তাদের ভাষা অর্থাৎ ‘ফার্সি’ সারা মুসলমান আমলে বাংলার সরকারি ভাষা ছিল এবং ফারসি সাহিত্য প্রবলভাবে বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছিল। দেখা যায়, বহু ফারসি শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে গেছে। এসব শব্দ স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যে, সরকারি দলিলে, কোর্টের নথিপত্রে এবং নিত্যদিনের প্রচলিত ভাষায়। মুসলিম বিজয়ের ধারাবাহিকতায় বহুসংখ্যক ইরানি অধিবাসীর বাংলায় অভিবাসনের ফলেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ফারসি শব্দের মিশ্রণ সম্ভব হয়েছিল।

ইরানিরা এদেশে এসে বিভিন্ন পেশায় অথবা সেনাবাহিনীতে কিংবা প্রশাসনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। প্রথম শ্রেণীভুক্তদের মধ্যে ছিলেন উলামা, মাশায়েখ, শিক্ষক ও কবি। সুবাহদার, নাজিম, দীউয়ান, তাদের অনুচর ও অধীনস্থরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত। মুসলমান শাসনের শুরুতে ইরানের বিদ্বান ও পন্ডিত ব্যক্তিগণ বাংলায় আগমন করেন। প্রথম যে দুজন ইরানি বখতিয়ার খলজী-এর সঙ্গে এদেশে আসেন, তাঁদের একজনের নাম বাবা কোতোয়াল ইস্পাহানি এবং অন্যজন কাজী রুকনউদ্দীন সমরকন্দি। প্রথম জন ছিলেন লখনৌতি-এর কোতোয়াল। বখতিয়ার খলজীর সন্দেহভাজন খুনী হিসেবে চিহ্নিত করে আলী মর্দান খলজীকে তাঁর প্রহরায় রাখা হয়। পরের জন সুলতান আলাউদ্দীন আলী মর্দান খলজীর অধীনে লখনৌতির কাজী ছিলেন। সুফি ও আলেম কাজী রুকনউদ্দীন ছিলেন হানাফি শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি কিতাবুল ইরশাদ প্রণয়ন করেন এবং অস্তি-নাস্তিমূলক শাস্ত্র আল-খিলাফি ওয়াল-জাদল প্রতিষ্ঠা করেন। লখনৌতিতে অবস্থানকালে তিনি ভোজর ব্রাহ্মণ নামক জনৈক কামরূপের এক যোগীকে ধর্মান্তরিত করেন। এ যোগী কাজীকে অমৃতকুন্ড শিরোনামে সংস্কৃত ভাষায় লেখা যোগশাস্ত্রের একটি গ্রন্থ উপহার দেন। গ্রন্থটি কাজী হাউজুল হায়াত নামে আরবি ভাষায় এবং বাহর-উল-হায়াত নামে ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন।

সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী-এর রাজত্বকালে ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে একজন ইরানি পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে একটি খানকাহ নির্মাণ করেন। তাঁর নাম বর্তমানে হারিয়ে গেছে, তবে তিনি ছিলেন মুহম্মদ আল-মারাগির পুত্র (মারাগা আধুনিক ইরানের আজারবাইজানের অন্তর্গত)। প্রায় সমসাময়িক কালে বিখ্যাত দরবেশ শেখ জালালউদ্দীন তাবরিজি বাংলায় আগমন করেন। বাংলার দুটি স্থানে শেখ জালালউদ্দীন তাবরিজির স্মৃতি সংরক্ষিত আছে। এর একটি পান্ডুয়া সুলতানি আমলে ফিরুজাবাদ নামে বাংলার রাজধানী ছিল এবং অন্যটি পান্ডুয়া থেকে পনেরো মাইল উত্তরে অবস্থিত দেওতলায়। পান্ডুয়ায় দরবেশের মাযার বড়ি দরগাহ নামে পরিচিত। শেখ নূর কুতুব আলম নামক আরেকজন দরবেশের মাযারও সেখানে আছে। এটি ছোটি দরগাহ নামে পরিচিত। শেখ তাবরিজির সম্মানে দেওতলার নাম পরিবর্তন করে তাবরিজাবাদ রাখা হয়। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে খোদিত বেশ কিছু লিপি এ দুটি স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়। শেখ জালালউদ্দীন তাবরিজি ১২২৬ কিংবা ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং সম্ভবত তাঁকে দেওতলা অর্থাৎ তাবরিজাবাদে সমাধিস্থ করা হয়।

কাজী মিনহাজউদ্দীন উসমান বিন সিরাজউদ্দীন আল জুরজানি ছিলেন একজন আলেম। তিনি উচ্ এবং দিল্লি উভয় স্থানেরই কাজীর পদে নিযুক্ত ছিলেন। ঐতিহাসিক হিসেবে অধিকতর খ্যাত এ কাজী ১২৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার গভর্নর ইজ্জউদ্দীন তুগরল তুগান খানের সঙ্গে বাংলায় আসেন এবং দুবছর পর তাঁর সঙ্গে ফিরে যান। কাজী মিনহাজ-ই-সিরাজ বাংলায় অবস্থানকালে মুসলমানদের প্রথম বাংলা বিজয় সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেন। তদুপরি দিল্লিতে থাকাকালে শাসকশ্রেণীর সঙ্গে চলাফেরার সুবাদে তিনি দিল্লি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত প্রদেশ বাংলা সম্পর্কে দরবার থেকেও তথ্য সংগ্রহের সুযোগ লাভ করেন। মিনহাজ-ই-সিরাজের তবকাত-ই-নাসিরী মুসলমান কর্তৃক বাংলা বিজয়ের পর বাংলায় মুসলমান শাসনের অর্ধ শতকের ইতিহাসের সূত্র সন্ধানের মূল উৎস হিসেবে বিবেচিত।

পরবর্তী পর্যায়ে ইরানের যে বিখ্যাত আলেম ও সুফি বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসে অবদান রাখেন তাঁর নাম মওলানা শরফউদ্দীন আবু তাওয়ামা। বুখারায় জন্মগ্রহণকারী এ আলেম তেরো শতকের শেষদিকে বাংলায় এসে সোনারগাঁও অঞ্চলে একটি মাদ্রাসা ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এখানেই সমাহিত হয়েছেন। তাঁর গ্রন্থ মাকামাত-ই-তাসাওওয়াফ সমকালীন পন্ডিত মহলে জনপ্রিয় ছিল। নাম-ই-হক নামে ফিকাহ শাস্ত্রের আরেকটি গ্রন্থ সে যুগে সুপরিচিত ছিল যার প্রণেতা তিনি অথবা তাঁর কোনো শিষ্য। গ্রন্থটি বর্তমান কালেও পরিচিত। সুলতান নাসিরউদ্দীন নুসরত শাহ-এর (১৫১৯-১৫৩২) রাজত্বকালে সৈয়দ জামালউদ্দীন নামক একজন বিদগ্ধ ব্যক্তি সাতগাঁও-এ একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তিনি ছিলেন সৈয়দ ফখরউদ্দীন আমুলির (আমুল কাস্পিয়ান সাগরের তীরে অবস্থিত একটি শহর) পুত্র। সুলতানি আমলের আরও অনেক আলেম ও সুফি-সাধক তথা জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির নাম রয়েছে ইতিহাসে, তবে তাদের মধ্য থেকে ইরানিদের শনাক্ত করা সহজসাধ্য নয়। অবশ্য কিছু কিছু নাম থেকে ইরানিদের সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যায়। সুতরাং একথা স্পষ্ট যে, প্রাক-মুগল যুগেই বাংলায় ইরানিদের আগমন ঘটে এবং তাঁরা সবাই শান্তিকালীন কর্মকান্ডে নিয়োজিত ছিলেন। এরা সকলেই ছিলেন বিদ্বান ও সুফি-সাধক এবং তাঁরা এ দেশে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রাখেন।

মুগল যুগেও ইরানিদের বাংলায় আগমন অব্যাহত থাকে অর্থাৎ বহু সংখ্যক আলেম, সুফি ও কবি এখানে আসেন। কিন্তু এ সময় ইরানিরা রাষ্ট্রীয় কাজে প্রাধান্য লাভ করেন। কয়েকজন অত্যন্ত সফল সুবাহদার ও পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। পারস্যদেশীয় কবিগণ সৈন্যদলের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে গমন করতেন এবং বিজয়ের গাথা রচনা করতেন যা জঙ্গনামা নামে অভিহিত। কবিগণ সুবাহদার ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করতেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর রাজত্বকালে কাসিম খান জুইনি নামে একজন খাজাঞ্চি ছিলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট শাহজাহান-এর আমলে তিনি সুবাহদার নিযুক্ত হন। তাঁর পিতা এসেছিলেন খুরাসানের জুয়িন শহর থেকে। তিনি নিজেও ছিলেন কবি এবং তাঁর কবিতা (দীউয়ান) এখনও বিদ্যমান। তিনি অন্যান্য পারস্যদেশীয় কবিদের উৎসাহ দিতেন এবং তাঁদের উপযুক্ত পদে নিয়োগ লাভে সাহায্য করতেন। তাঁর আমলে মুহম্মদ সাদিক বাংলায় আসেন এবং মুগলদের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। তবে কবি হিসেবেই তিনি অধিক গুরুত্ব পেয়েছিলেন। সুবহ-ই-সাদিক নামে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে বাংলায় অবস্থানকারী ইরানিদেরসহ আরও অনেক ইরানি কবির নাম পাওয়া যায়। মুহম্মদ সাদিক ও তাঁর পিতা মুহম্মদ সালিহ ইস্পাহানি তাঁদের জীবনের একটা অংশ বাংলায় অতিবাহিত করেন। মুহম্মদ সাদিক তিনজন সুবাহদার কাসিম খান, আযম খানইসলাম খান মাশহাদি এর অধীনে বাংলায় চাকরিরত ছিলেন। খাজা মুহম্মদ শরীফ ঢাকার একজন খ্যাতনামা কবি ছিলেন। তিনি ধনাঢ্য পারস্য ব্যবসায়ী খাজা হাসান শুস্তারির পুত্র। মরমিবাদে অভিজ্ঞ সৈয়দ মুহম্মদ তাকী দাহদার আমিন পদে, মুখলেস খান তাবরিজি নামে একজন কবি বখশী পদে এবং হাসান বেগ গ্রানী নামে আরেকজন কবি নৌ বিভাগের বখশী পদে নিযুক্ত ছিলেন। কাসিম খানের সময়ের অন্যান্য পারসিক কবিদের মধ্যে ছিলেন মোল্লা দরবেশ হারবি, মোল্লা ওয়াফাই মারবি, মোল্লা হাকিম সিরাজি, মির আবদুল কাইয়ুম প্রমুখ। কাসিম খানের উত্তরাধিকারী সুবাহদার আজম খানও কবিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর সময়ে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন রুহুল্লাহ মাজানদারানি নামে একজন কবি ও গণিতজ্ঞ এবং জিয়াউদ্দীন ইউসুফ তাবরিজি ও মীর মাসুম কাশি নামক দুজন বিখ্যত কবি। সুবাহদার ইসলাম খান মাশহাদির আমলের উল্লেখযোগ্য কবি ছিলেন মীর রুজি, মুহম্মদ শরীফ তালওয়ানি ও মুহম্মদ হুসেন মাশহাদি। মীর রুজি ছিলেন আবু তুরাব মাশহাদির পুত্র। তাঁর ছদ্মনাম ছিল দানিশ।

সুবাহদার শাহ সুজা-এর আমলে অনেক ইরানি কবি ও পন্ডিত বাংলায় এসে ঢাকা ও রাজমহলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা শাহজাদার কাছ থেকে উৎসাহ লাভ করেছিলেন। মুহম্মদ হুসেন কাজভিনি নামে একজন কবি ও হস্তলিপি শিল্পী শাহ সুজার সময়ে চাকরিতে নিযুক্ত ছিলেন। আল্লামা মীর সৈয়দ নূরুল্লাহ মারগাশির তিন পুত্র আবুল মালি, আলাউল মুলক এবং আলাউদ্দৌলা ছিলেন পরিশীলিত কবি ও পন্ডিত। আবুল মালি তিনটি গ্রন্থের রচয়িতা। গ্রন্থগুলি হচ্ছে তাফসীর-ই-সুরাহ ইখলাস, মানজাফ-উল-উলুম এবং ফারসি কবিতার একটি সংকলন। শাহজাদা সুজাকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল আলাউল মুলক-এর ওপর। তাঁর গ্রন্থগুলির মধ্যে ছিল মাহাজ্জাব ফিল-মানফিক, আনওয়ার-উল-হুদা ফি ইলম-ই-ইলাহী এবং সিরাত-উল-ওয়াফিল আসবাত-উল-মাওয়াজিব। ভ্রাতৃত্রয়ের তৃতীয় জনও ছিলেন কবি। মির্জা শাহ বাকী ওয়াজদী সিরাজি এবং আরও কয়েকজন উঁচুমানের কবি শাহ সুজা ও তাঁর কর্মকর্তাদের অধীনে কাজ করতেন। পরবর্তী সুবাহদার মীরজুমলা, শায়েস্তা খান, ইবরাহিম খান, মুর্শিদকুলী খান প্রমুখ সুবাহদারের নিকট থেকেও ইরানি কবি ও পন্ডিতগণ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

আওরঙ্গজেব-এর পৌত্র ও বাংলার নাজিম শাহজাদা আজিমউদ্দীন ছিলেন ইরানি কবিদের একজন পৃষ্ঠপোষক। তিনি তাঁদের সঙ্গে কবিতা পাঠের আসরে যোগ দিতেন। তাঁদের সবচেয়ে প্রিয় বই ছিল মওলানা জালালউদ্দীন রুমীর মসনবী। আঠারো শতকে, বিশেষ করে মুর্শিদকুলী খানের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু শিয়া মুসলমান ইরান থেকে বাংলায় এসে বসতি স্থাপন করেন। দ্বিতীয় মুর্শিদকুলী খান রুস্তম জঙ্গ নামে পরিচিত মির্জা লুৎফুল্লাহ ছিলেন একজন গুণী কবি। তাঁর ছদ্মনাম ছিল মাখনূর। সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবাঈ রচিত সিয়ার-উল-মুতাখ্খেরীন-এর মতো সমকালীন ঐতিহাসিক সাহিত্যে আরও অনেক শিয়া মুসলমান পন্ডিত ও কবিদের নাম পাওয়া যায়।

পন্ডিত ও কবিগণ ব্যতীত ইরানি বংশোদ্ভূত আরও বহু লোক মুগল যুগে প্রশাসনিক কাজে যোগ দেন। বেশ কয়েকজন সুদক্ষ ও সফল সুবাহদার এবং নাজিম ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। মুজাফফর খান তুরবতী প্রথম যুগের বাংলার একজন মুগল সুবাহদার ছিলেন। খুরাসানের তুরবত গোত্রভুক্ত ছিলেন বলে তাঁকে তুরবতী বলা হতো। তিনি রাজস্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং দীউয়ানের পদে উন্নীত হন। ১৫৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর তাঁকে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত করেন। কিন্তু তিনি মুগল বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। মেহেরুন্নেসার (নূরজাহান) সঙ্গে সম্রাট জাহাঙ্গীর-এর বিবাহের পর সম্রাজ্ঞীর পিতা মির্জা গিয়াস বেগ ইতিমাদ-উদ-দৌলার পরিবার প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। শিয়া সম্প্রদায়ের এ পরিবার ইরান থেকে এদেশে আসে। নূরজাহানের ভাই ইবরাহিম খান ফতেহ-জঙ্গ ১৬১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সুবাহদার পদে নিযুক্ত হয়ে একদল শিয়া অনুচরসহ ঢাকা আগমন করেন। সে সময় ইবরাহিম খানের ভ্রাতুস্পুত্র মির্জা আহমদ বেগও তাঁর সঙ্গে এসেছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে মুগল কর্মকর্তাদের অনেকেই ছিলেন ইরানি এবং শিয়া। বাংলায় মুগল শাসন কায়েমে আরও দুজন ইরানির ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তাঁরা হলেন: মীর-ই-বহর ইহতিমাম খান এবং তাঁর পুত্র বাহারিস্তান-ই-গায়েবী প্রন্থের রচয়িতা মির্জা নাথান। ইবরাহিম খানের পরে মহববত খান বাংলার সুবাহদার হন। তাঁর পরিবার ইরানের সিরাজ নামক স্থান থেকে এসেছিল। তিনি তাঁর পুত্র ও প্রতিনিধি খানজাদ খানের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের জন্য বাংলা শাসন করেন। শাহজাহানের আমলে বাংলার দুজন সুবাহদার কাসিম খান জুয়িনি ও ইসলাম খান মাশহাদিও ছিলেন ইরানি।

ইরানি শিয়া কর্মকর্তাগণ, অভিজাতবর্গ, কবি ও পন্ডিতগণ কর্তৃক পরবর্তী সুবাহদার শাহজাদা শাহ সুজা পরিবেষ্টিত ছিলেন। তাঁর চারজন প্রভাবশালী অমাত্য ছিলেন ইরানি। তারা হলেন উড়িষ্যার নায়েব নাজিম মুহম্মদ জামান তেহরানি, ঢাকার নায়েব নাজিম মীর আবুল-কাসিম আল-হোসায়নি-আল তবাতবাঈ আল-সিমনানী, সুজার শিক্ষক মীর আলাউল মুলক এবং তাঁর রেকাব রক্ষক মীর রুকন আলী। যে সকল কবি ও পন্ডিত তাঁর দরবার অলঙ্কৃত করেছিলেন এবং যাঁরা তাঁর অধীনে নিয়োজিত ছিলেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন শিয়া এবং ইরানি বংশোদ্ভূত। তাঁর মাতা ছিলেন একজন শিয়া এবং তাঁর দুজন স্ত্রীর উভয়েই ছিলেন শিয়া পরিবারের কন্যা। বলা হয়ে থাকে যে, শাহজাদা সুজা তাঁর সঙ্গী করে তিন শত শিয়া অভিজাত ব্যক্তিকে নিয়ে বাংলায় এসেছিলেন। সুজার ব্যক্তিগত পরিচারক এবং তারিখ-ই-শাহ সুজাই গ্রন্থের রচয়িতা মীর মাসুমও ছিলেন ইরানি। মাসুম ও তাঁর পিতা হাসান দুজনেই বাংলায় চাকরি করতেন।

পরবর্তী দু সুবাহদার মীর মুহম্মদ সৈয়দ মুয়াজ্জেম খান খানখানান, ইতিহাসে যিনি তাঁর পদবি মীর জুমলা নামেই সমধিক পরিচিত এবং আমির-উল-উমরা শায়েস্তা খান ছিলেন ইরানি বংশোদ্ভূত। মীর জুমলা ইরানের এককালের রাজধানী ইস্পাহানের আরদিস্তানে এক দরিদ্র সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কিছু লেখাপড়া শিখে তিনি এক বণিকের অধীনে কেরানি নিযুক্ত হন। এ চাকরির সূত্রে তাঁর গোলকুন্ডা আসার সুযোগ ঘটে। গোলকুন্ডা ছিল হীরক খনির জন্য বিখ্যাত। অসাধারণ পরিশ্রম ও মেধার বলে তিনি হীরক ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। এ ছাড়া তিনি নৌবাণিজ্যে নিজেকে নিয়োজিত করেন এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী ও ইউরোপীয় বণিক কোম্পানিগুলির সংস্পর্শে আসেন। অত:পর তিনি গোলকুন্ডার সুলতানের উজির পদে যোগ দেন এবং সুলতানের পক্ষে কর্ণাটক জয় করেন। কিন্তু কর্ণাটকের দখল নিয়ে সুলতানের সঙ্গে তাঁর বিরোধ দেখা দেয় এবং মীর জুমলা স্বীয় নিরাপত্তার জন্য মুগল শাহজাদা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন। আওরঙ্গজেব ছিলেন তখন দাক্ষিণাত্যের সুবাহদার। মীর জুমলা সম্রাট শাহজাহানের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। সম্রাট শাহজাহান তাঁকে আনুকূল্য ও উপাধি প্রদান করেন। শাহজাহানের রাজত্বকালের শেষ কয়েক বছরে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার যুদ্ধে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের পক্ষ অবলম্বন করে শাহ শুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে শাহ সুজা পরাস্ত হয়ে আরাকানে পালিয়ে যান। ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে মীর জুমলা বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হন। বাংলায় তাঁর সুবাহদারি আমলে মীর জুমলা কুচবিহার, কামরূপ ও আসামে সফলভাবে অভিযান পরিচালনা করেন। আসাম অভিযান শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনকালে মীর জুমলা ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ মার্চ খিজিরপুর (আধুনিক নারায়ণগঞ্জের নিকট) দুর্গের অদূরে নৌকায় মারা যান। মীর জুমলার স্মৃতির সাক্ষ্য বহন করছে দুটি সড়ক ও দুটি সেতু। বর্তমানে ময়মনসিংহ সড়ক নামে পরিচিত ঢাকা-টঙ্গি সড়ক এবং অন্যটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়ক। সেতু দুটির একটি নারায়ণগঞ্জ সড়কের উপর পাগলা সেতু এবং অন্যটি তুরাগ নদীর উপর টঙ্গি সেতু।

আমীর-উল-উমরা শায়েস্তা খান ছিলেন আসফ খানের পুত্র। আসফ খান ছিলেন মির্জা গিয়াস বেগ ইতিমাদউদ্দৌলার পুত্র এবং নূরজাহানের ভ্রাতা। অতএব তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের মাতুল। মীর জুমলার পর শায়েস্তা খান সুবাহদার হন এবং ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে তিনি ঢাকা আগমন করেন। শায়েস্তা খান দুবার বাংলা শাসন করেন। মধ্যে স্বল্পকালীন বিরতি বাদ দিয়ে তাঁর পূর্ণ শাসনকাল ছিল ২২ বছর। প্রশাসনিক কাজে তাঁকে সহায়তা করতেন তাঁর সুযোগ্য পুত্রগণ। তাঁরা হলেন বুজুর্গ উমেদ খান, আকিদাত খান, জাফর খান, আবু নসর খান এবং ইরাদাত খান। এঁরা প্রত্যেকেই এক একটি জেলার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। বুজুর্গ উমেদ খান ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার পক্ষে চট্টগ্রাম জয় করেন। শায়েস্তা খান তাঁর স্থাপত্যকর্মের জন্য বিখ্যাত। তিনি নিজে একজন ফারসি কবি ছিলেন এবং অন্যান্য কবিদের বিশেষত ইরানি বংশোদ্ভূত শিয়া কবিদের অনুপ্রাণিত করতেন। ইরানি বংশোদ্ভূত পরবর্তী বিখ্যাত সুবাহদার আলী মর্দান খানের পুত্র ইবরাহিম খান। বাংলায় আগমনের সময় তিনি ছিলেন বৃদ্ধ ও দুর্বল। কিন্তু ফারসি গ্রন্থপাঠে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। তাঁর আমলে শোভা সিংহ নামে একজন জমিদার আফগান নেতা রহিম খানের সঙ্গে মিলিত হয়ে মেদিনীপুর, বর্ধমান, হুগলি ও নিকটবর্তী এলাকায় বিদ্রোহ করেন। ইবরাহিম খান তখন নিষ্ক্রিয় ছিলেন। সম্রাটের নির্দেশে তাঁর পুত্র জবরদস্ত খান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন এবং ভীষণ ক্ষতিসাধন করে তাদের হটিয়ে দেন।

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুগল সাম্রাজ্যের সর্বত্র গোলযোগ দেখা দেয়। সে পরিস্থিতিতে মুর্শিদকুলী খান অত্যন্ত দক্ষতা ও কৌশলে বাংলার শাসনক্ষমতা আয়ত্তে রাখতে সক্ষম হন। মুর্শিদকুলী খান ইরানি বংশের ছিলেন না। তিনি দক্ষিণ ভারতের এক ব্রাহ্মণের সন্তান ছিলেন। হাজী শফি নামক একজন ইরানি মুগল কর্মকর্তার নিকট তাঁকে বিক্রি করা হয়। হাজী শফি তাঁকে ইরানি কায়দায় লালন পালন করে তোলেন। তাঁর ধর্মপিতার মতো তিনিও শিয়া মতাবলম্বী ছিলেন এবং পদোন্নতির সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন। তাঁর সময় থেকে ইরানি বংশোদ্ভূত শিয়া সম্প্রদায়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, উলামা ও মাশায়েখগণ বাংলার গুরুত্বপূর্ণ শহর মুর্শিদাবাদ, ঢাকা, হুগলি প্রভৃতি স্থানে খ্যাতি অর্জন করেন। এ অবস্থা মুগল শাসনামলের শেষ অবধি বিরাজমান থাকে। যখনই কোনো একজন ইরানি কর্মকর্তা বাংলায় আসতেন, তাঁর সঙ্গে থাকত অসংখ্য অনুগত সঙ্গী ও সমর্থক। এভাবেই ইরানি বংশোদ্ভূতদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁদের কেউ কেউ এদেশকেই স্বদেশ হিসেবে গ্রহণ করে এখানে বসতি স্থাপন করেন এবং এদেশেই মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ কেউ নিজের দেশে কিংবা উত্তর ভারতে চলে যান।

সাধারণভাবে মন্তব্য করা যায় যে, বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম দিকে ইরানিরা এদেশে আসেন নিজেদের ভাগ্যোন্নতির জন্য। তাঁদের কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে যোগ দেন, তবে অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষক, উলামা ও মাশায়েখ। তাঁরা শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এবং দেশব্যাপী শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া কেউ কেউ ব্যবসা বা অন্যান্য পেশা গ্রহণ করেন। মুগল আমলে ইরানিদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায়। তাঁরা নিজেদের উন্নতির জন্য এদেশে আসলেও প্রশাসনিক কাজেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। সুবাহদার, দীউয়ান ও অন্যান্য কর্মকর্তা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন ইরান থেকে আগত কিংবা ইরানি বংশোদ্ভূত।  [আবদুল করিম]

গ্রন্থপঞ্জি Sarkar, J N (ed.), History of Bengal, II, Dhaka University, Dhaka, 1948; Karim, A, Social History of the Muslims in Bengal, Dhaka, 1959; Karim, A, History of Bengal, Mughal perioed, I, II, Rajshahi, 1992, 1995; Karim, A, Murshid Quli Khan and His Times, Dhaka, 1964.