ইওজ খলজী

ইওজ খলজী (৬০৯-৬২৪ হি./ ১২১২-১২২৭ খ্রি.)  ১২১২ থেকে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম রাজ্য লখনৌতির সুলতান ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম হুসামউদ্দীন ইওজ খলজী। তিনি ছিলেন হুসেইন-এর পুত্র এবং উত্তর আফগানিস্তানের গরমশির-এর এক নগণ্য বাসিন্দা। কথিত আছে, প্রথম জীবনে তিনি মালবাহী গাধার চালক হিসেবে দূরবর্তী স্থানে মালামাল পৌঁছে দিতেন। এমনি এক সফরে তিনি কয়েকজন দরবেশকে খাদ্য ও পানি দিয়ে তুষ্ট করেন এবং তাঁরা, তাঁকে আশীর্বাদ করে ভারতবর্ষে যেতে নির্দেশ দেন।

পথিমধ্যে বখতিয়ার খলজীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে এবং তাঁরা ১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতে পৌঁছেন। বখতিয়ারের সহকারী হিসেবে তিনি উদন্তপুর বিহার জয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিহারে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদান বখতিয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লখনৌতি বিজয়ের পর ইওজের বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বখতিয়ার তাঁকে দেবকোটের দক্ষিণপূর্বে অবস্থিত কাঙ্গোরীর জায়গির প্রদান করেন।

বখতিয়ারের মৃত্যু তাঁর অধস্তন প্রতিনিধিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এমনি এক সংকটময় মুহূর্তে সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবকের নির্দেশে অযোধ্যার গভর্নর কায়েমাজ রুমী বাংলা আক্রমণ করেন। রাজনীতিতে জ্ঞানসম্পন্ন ইওজ সম্রাটের বাহিনীকে স্বাগত জানান। রুমী সফলতার সঙ্গে বাংলা অধিকার করে ইওজকে দিল্লির অধীন সামন্ত নিযুক্ত করে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। আলী মর্দান খলজী ১২১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সালতানাতের অধীন বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে পুনরায় দায়িত্ব পালনের পূর্ব পর্যন্ত ইওজ এ পদে আসীন ছিলেন। তাঁর আগমনের পর ইওজ প্রদেশের শাসনভার তাঁর নিকট ন্যস্ত করে স্বীয় কর্মস্থলে প্রত্যাবর্তন করেন। অল্পদিনের মধ্যেই আলী মর্দানের কঠোর নীতির ফলে রাজ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয়। এ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ইওজ অসন্তুষ্ট খলজী অমাত্যদের সংগঠিত করে আলী মর্দানকে হত্যা করেন এবং ১২১২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

অতি অল্পকালের মধ্যেই ইওজ খলজী লখনৌতিতে তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় করেন। আলী মর্দান কর্তৃক নির্বাসিত প্রভাবশালী খলজী অমাত্যদের ইওজ খলজী ডেকে পাঠান, তাদেরকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন এবং তুর্কি সৈন্যদের নিজের পক্ষে নিতে সক্ষম হন। তাঁর গৃহীত প্রাথমিক পদক্ষেপগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল দেবকোট হতে লখনৌতিতে (গৌড়) রাজধানী পুনঃস্থানান্তরিত করে এখানে সম্পূর্ণ নতুন একটি নগরের পত্তন ঘটানো। সেসময় নগরটির পশ্চিমপাশ দিয়ে নদী প্রবাহিত ছিল। ইওজ রাজধানীর অপর তিনদিকে মাটির কেল্লা নির্মাণপূর্বক প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। একই উদ্দেশ্যে রাজধানীর সন্নিকটে বসনকোটে দুর্গ নির্মাণ করেন। নদীবহুল বাংলার জন্য নৌবাহিনীর গুরুত্ব সর্বপ্রথম ইওয়াজই উপলব্ধি করেন এবং যে কোনো প্রকার আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ইওজ নৌবাহিনী গঠন করেন। প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনিক সুবিধার্থে গঙ্গা ও অন্যান্য নদীতে বাঁধ ও খেয়ার ব্যবস্থা করে তিনি রাজধানীর সঙ্গে সীমান্ত অঞ্চল দেবকোট ও লখনৌতিকে সংযুক্ত করেন। বার্ষিক বন্যার কবল হতে রাজ্য রক্ষার্থে তিনি অনেকগুলি খাল খনন করেন এবং স্থানে স্থানে খিলানযুক্ত সেতু নির্মাণ করেন।

লখনৌতিতে শান্তি স্থাপনের পর ইওজ খলজী দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করেন। মিনহাজ-ই-সিরাজের মতে, তিনি লখনৌর জয় করে তা নিজ রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করেন এবং বহুসংখ্যক হাতি, প্রচুর ধনসম্পদ ও সেখানকার রাজকোষ অধিকার করে নেন। তিনি সেখানে তাঁর আমীর নিয়োগ করেন। জাজনগর, বঙ্গ, কামরূপ, ত্রিহুত প্রভৃতি প্রতিবেশী রাজ্যগুলি গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজীকে কর প্রদান করত বলে অনুমিত হয়।

সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজী নিজ নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা প্রচলন করেন। তিনি সুলতান ইলতুৎমিশের বিপরীতে তাঁর সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ঘোরের শাসকদের সঙ্গে স্বীয় সম্পর্ক প্রদর্শনের চেষ্টা করেন। অধিকন্তু তিনি তাঁর মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নামাঙ্কণ করেন। স্থানীয় জনগণের দৃষ্টিতে নিজের অবস্থান উন্নীত করে নিজেকে দিল্লির সুলতানের সমকক্ষ প্রতীয়মান করার লক্ষ্যেই তিনি মুদ্রায় খলিফার নাম অংকিত করেন। দেশে ইসলামের উন্নতি বিধানের জন্যও তিনি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। মুদ্রায় তিনি নিজেকে ‘বিশ্বাসীদের নেতার সাহায্যকারী’ হিসেবে ঘোষণা দেন। তিনি বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন এবং বেশ কয়েকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। উলামা, মাশায়েখ এবং সৈয়দদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিদের তিনি ভাতা প্রদান করেন।

বাংলার প্রতি দিল্লির সুলতানদের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদাই ছিল সন্দেহপূর্ণ। আর তাই স্বাধীন শাসকরূপে ইওয়াজের কর্মকান্ডে ইলতুৎমিশ অসন্তুষ্ট হন। অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা এবং মোঙ্গল আক্রমণ হতে অব্যাহতি লাভের পর পরই ইলতুৎমিশ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিহার ও বাংলা স্বীয় অধিকারে নেওয়ার জন্য অগ্রসর হন। ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে বিনা বাধায় তিনি বিহার অধিকার করেন। ইওজ এ অভিযানের সংবাদ পেয়ে রাজকীয় বাহিনী যাতে গঙ্গা অতিক্রম করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে নিজের সেনা ও নৌবাহিনী নিয়ে রাজধানী হতে অগ্রসর হন। সম্ভবত রাজমহল পাহাড়ের তেলিয়াগড়ি গিরিপথে তিনি রাজকীয় বাহিনীকে বাধা প্রদান করেন। মিনহাজের মতে, এখানে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি হয়। সন্ধির শর্তানুসারে, ইওজ সুলতানকে ক্ষতি পূরণস্বরূপ ৮০ লক্ষ মুদ্রা ও আটত্রিশটি হাতি প্রদানে সম্মত হন। তিনি দিল্লির সুলতানের অধীনতা স্বীকার করে তাঁর নামে খুতবা পাঠ ও মুদ্রা জারি করতেও রাজি হন। অন্যদিকে, ইওজ লখনৌতি শাসনের অনুমতি লাভ করেন।

আলাউদ্দীন মাসুদ জানীকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করে ইলতুৎমিশ দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন। কিন্তু তাঁর এ প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই ইওজ আলাউদ্দীন জানীকে বিহার হতে বিতাড়িত করে আরও কিছুদূর অগ্রসর হন। ইওজ খলজী সম্যক উপলব্ধি করেন যে, ইলতুৎমিশ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করবেন। ইতোমধ্যে হিন্দুদের বিদ্রোহের ফলে অযোধ্যায় এক বিশৃংখল পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বিদ্রোহ দমন করতে ইলতুৎমিশ তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে অযোধ্যায় প্রেরণ করেন। অযোধ্যায় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে রাজপুত্রের বেশ কিছু সময় লাগবে অনুমান করে ইওজ তাঁর রাজধানী অরক্ষিত রেখেই ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বাংলা আক্রমণে অগ্রসর হন। এদিকে নাসিরউদ্দীন অযোধ্যা হতে বাংলায় আকস্মিক আক্রমণ চালান। ইওজ ক্ষিপ্রগতিতে প্রত্যাবর্তন করে লখনৌতির নিকট দিল্লি বাহিনীর সঙ্গে খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন, কিন্তু পরাজয় বরণ করেন। এরই সঙ্গে বাংলায় প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রণী ব্যক্তিত্ব সুলতান গিয়াসউদ্দীন ইওজ খলজীর তাৎপর্যপূর্ণ ও গঠনমূলক শাসনকালের অবসান ঘটে।  [এ.বি.এম শামসুদ্দীন আহমদ]