আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত একটি রাষ্ট্রীয় আইন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী বাংলাদেশের জনগণের প্রতি যে নৃশংসতা চালিয়েছিল তার বিচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ এই আইনত প্রণয়ন করে। এই আইনই বিশ্বের ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রণীত সর্বপ্রথম যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত আইন, যা কিনা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সংক্রান্ত রোম সনদেরও পূর্বে প্রণীত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের এই আইন বাংলাদেশ কোলাবরেটর (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২-কে প্রতিস্থাপিত করেছে।

এই আইনে গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক, বিচার এবং শাস্তি প্রদান সংক্রান্ত আইনি কাঠামো দেয়া আছে। যেকোন ব্যক্তি, দল, সংগঠন, সশস্ত্র বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহযোগী বাহিনীর যেকোন সদস্য যারা কিনা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এই আইন প্রণয়নের পূর্বে বা পরে এই আইনে বর্ণিত অপরাধ করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে জাতীয়তা নির্বিশেষে এই আইন প্রযোজ্য হবে।

১৯৭৩ সালে প্রণীত হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের ফলে এই আইনের প্রয়োগ বিঘ্নিত হয়েছিল। অতঃপর ২০১০ সালে, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনের পর প্রথম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ২০১২ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয় যার কার্যক্রম ২০১৫ সাল থেকে স্থগিত হয়েছে। এই দুই ট্রাইব্যুনাল সফলতার সাথে অনেক কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করেছে, যাদের মধ্যে অন্যতম হল আবদুল কাদের মোল্লা, আবুল কালাম আজাদ, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মাদ কামারুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

এই আইন প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাক্ষ্য প্রমাণের উচ্চতর মান নির্ধারণ করা। আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের ক্রমবিকাশে ১৯৭৩ সালের আইন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তথাপি, বাংলাদেশের ভেতরে ও বাহিরে বেশ কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এই আইনটিকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে সমালোচনা করেছেন। তাদের প্রধান অভিযোগ, এই আইনে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া রক্ষা করা হয় নি, এবং এতে ন্যায় বিচার প্রক্রিয়ার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। তবে এসকল সমালোচনা নিরপেক্ষ ছিল না, কারণ ১৯৭৩ সালের আইনে পূর্ব প্রচলিত আইন, নীতি, নিয়ম, নজির, এবং আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন (কাস্টমারি ইন্টারন্যাশনাল ল), প্রথাগত আন্তর্জাতি মানবিক আইন এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সুসমন্বয় সাধনের পাশাপাশি সমকালীন আইনবিজ্ঞানের সমন্বয় নিশ্চিত করা হয়েছে। [মিজানুর রহমান]